এডিটর’স কলাম I মানুষ ও প্রকৃতির উৎসব
শারদোৎসব যে মানুষের উৎসব তার বড় প্রমাণ হলো, ঈদ কিংবা নববর্ষের মতোই এই উৎসব ঘিরে নানা মানুষের পেশা ও অর্থনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়। এই পূজা উপলক্ষে পোশাকের আয়োজন, পূজার দিনগুলোতে রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে মেলার মাঠে কেনাবেচার ওপর অনেক মানুষের অর্থনীতি যুক্ত হয়ে যায়
ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে প্রকৃতির হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি নিয়ে প্রতিবছর হাজির হয় শরৎকাল। বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে শরতের হাওয়ার পরে হিমের পরশ হয়তো আর সেভাবে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু পেঁজাতুলোর মেঘে ভরা নীল-সাদা আকাশ দেখে আমরা টের পাই, শরৎকাল চলে এসেছে। এই আগমনী বার্তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের শৈশবের স্মৃতি আর সাংস্কৃতিক সত্তা। এই বাংলায় ঈদের পরেই সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয়া। ধর্মীয় রীতিপ্রথার বাইরে বাংলার মানুষ এটি উদ্যাপন করছে বহুদিন থেকেই।
বাংলায় দুর্গাপূজার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণমানুষের উৎসব হয়ে ওঠার আগে জমিদারবাড়ির ঠাকুরদালানে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অঙ্গ ছিল দেবী দুর্গার আরাধনা। কিন্তু পরে যখন বারোজন ইয়ার-দোস্ত মিলে সাধারণ মানুষের সাহায্য নিয়ে দুর্গাপূজাকে ‘বারোয়ারি’ বা সর্বজনীন করে তুলেছিলেন, তখন এটি হয়ে ওঠে গণমানুষের উৎসব। আঠারো শতকের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে দুর্গাপূজার সর্বজনীন প্রচলন ঘটে। ক্রমে তা একটিমাত্র ধর্মীয় স¤প্রদায়ের গন্ডি অতিক্রম করেছে। আজও গ্রাম-বাংলায় গেলে দেখা যায় দুর্গাপূজাকে ঘিরে মেলা, পালাগান, যাত্রা, নাটক, গানবাজনা ও খেলাধুলায় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব বয়সের সব মানুষের অংশগ্রহণ। এর কারণ, বাংলার সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। শরিয়ত-তরিকত-মারেফত-শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব-সহজিয়া-তন্ত্র-বজ্রযানী-মহাযানী-লোকায়ত-খ্রিস্টসহ বহু বিশ্বাস ও আচারের মানুষের সহাবস্থানের তীর্থ এই বঙ্গভূমি। এখানে তাই বিভিন্ন মত ও পথের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানও হয়েছে। বাংলায় ইসলাম এসেছে প্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের হাত ধরে, আর্যদের বৈদিক ভাব, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ বিনির্মিত হয়েছে বৌদ্ধতন্ত্রে। এখানে শ্রীচৈতন্য প্রভাবিত হয়েছেন ইসলামের সহজ ধারায় আবার শ্রীচৈতন্যে আকৃষ্ট হয়েছেন নিম্নবর্গের মানুষেরা, বাংলার বৈষ্ণব আর ইসলামের সহাবস্থানে গড়ে উঠেছে ফকিরি ধারা, আবার তন্ত্র ও লোকায়ত প্রকৃতিনিবিড় বিশ্বাসগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে শাক্ত ধারা। এত বিশ্বাস, ভক্তি ও ইবাদতের ধারায় বাংলার উৎসব হয়ে উঠেছে সবার মিলনস্থল, আনন্দের উৎস। এর দৃশ্যরূপ মেলা ও মোচ্ছবের নানা তরিকার সঙ্গে একসময়ে মিশে গেছে দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক উৎসবও। চন্ডীপুরাণে দেবীমাহাত্ম্য যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, বাংলায় দুর্গাপূজা ঠিক ততটা ধর্মীয় প্রকরণে আবদ্ধ নয়। বরং এখানে দুর্গা পূজিতা হন গৌরী, শিবানী বা উমা রূপে; যিনি প্রকৃতি তিনিই উমা। কৃষিঘনিষ্ঠ বাংলায় উমা আসলে প্রকৃতির এক রূপ। বাংলার বিশ্বাস, এই উমা তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাংলায় আসেন বাপের বাড়িতে, সব বাঙালিই তাঁর আত্মীয়। তাই উমাকে ঘরের মেয়ে হিসেবে দেখা হয় এখানে। বোঝা যাচ্ছে, লৌকিক প্রেক্ষাপটে শারদোৎসব যত না ধর্মীয়, তার চেয়ে বেশি লোকজীবনের অংশ।
বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজা নিয়ে গোটা বিশ্বের আগ্রহ রয়েছে। তবে বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বাংলার শারদোৎসবের আঙ্গিকে বদল আসছে। করপোরেট ব্যবস্থাপনাতেও আয়োজিত হচ্ছে দুর্গাপূজা। পরিবর্তন ভালো। কিন্তু খেয়াল রাখা দরকার, পরিবর্তনের জেরে যাতে উৎসব শিকড়বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতার মেলবন্ধনেই সামাজিক উন্নতি ও সাংস্কৃতিক প্রগতির পথ আমরা দেখতে পারি। কেননা দুর্গাপূজা এলেই পূজামন্ডপ নির্মাণ, প্রতিমা তৈরি, মন্ডপে আড্ডা, কিশোরবেলার খেলাধুলা, বিসর্জনের বাজনা- এগুলোর কথাই মনে আসে, এই সহজ আনন্দকে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা দরকার।
শারদোৎসব যে মানুষের উৎসব তার বড় প্রমাণ হলো, ঈদ কিংবা নববর্ষের মতোই এই উৎসব ঘিরে নানা মানুষের পেশা ও অর্থনৈতিক জীবন আবর্তিত হয়। ফ্যাশন হাউজগুলোর এই পূজা উপলক্ষে পোশাকের আয়োজন, জামাকাপড় থেকে জুতার কেনাবেচা, পূজার দিনগুলোতে রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে মেলার মাঠে ছোট ছোট দোকানের কেনাবেচার ওপর অনেক মানুষের অর্থনীতি যুক্ত হয়ে যায়। পূজার দিনগুলোয় ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দর্শনের বিষয়টার ওপরেও ক্ষুদ্র পুঁজির বাণিজ্য ভীষণভাবে উপকৃত হয়।
তবে দুর্গাপূজাকে মানুষের উৎসব ও প্রকৃতির উৎসব হিসেবে ধরে রাখার দায়দায়িত্ব আমাদেরই। আর এই দায়িত্বের বিষয়টা নির্ভর করছে সামাজিক ও পরিবেশগত সচেতনতার ওপর। সামাজিক সচেতনতা হলো, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’। আর পরিবেশ সচেতনতা হলো উৎসবকে পরিবেশবান্ধব রাখা। মেলায়, পূজামন্ডপের আশপাশে, রাস্তাঘাটকে আমরা চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার। অযথা প্লাস্টিকের ব্যবহার যাতে আমরা না করি, খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও যাতে আমরা নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রাখি, এই সচেতনতা সবার দরকার। তাহলেই উৎসব হয়ে উঠবে আনন্দমুখর, শরতের আকাশের মতো মলিনতামুক্ত। সুন্দর হয়ে উঠুক দিনগুলো।