বিশেষ ফিচার I ফ্যাশন-পোশাক-আশাক: বাঙালিনীর বদলতি তসবির -যশোধরা রায়চৌধুরী
গত সংখ্যার পর…
বোকা বাক্সের বিধান
ÒIt is on them that the universal reign of the normative is based; and each individual, wherever he may find himself, subjects to it his body, his gestures, his behaviour, his aptitudes, his achievements.” Michel Foucault, Discipline and Punish.
সত্তর থেকে আশিতেই যদি দেখি সবচেয়ে বড় রূপান্তর বাঙালি মেয়ের সৌন্দর্যচেতনায় , সাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক রচনায়, তাহলে এই প্রশ্নটা উঠেই পড়ে, যে রুচিবদলের জন্য দায়ী কে বা কারা? কোন প্রযুক্তি সম্পর্কই বা, উড়ে এসে জুড়ে বসল, আর বদলে দিল ফ্যাশনে বাঙালিনীর অংশগ্রহণের পদ্ধতি বা রীতি?
সুনীল-সমরেশের নির্মিত সাহিত্যের প্রেক্ষিতে, আগেই দেখেছি যে মেয়েদের বেশি সাজগোজটাকে উদারভাবে নিতে বেশ ব্যথা ছিল কোথাও। উদাহরণ দীর্ঘতর না করেই বলা যায়, ভালো-খারাপ, পিশাচিনী-মাতৃমূর্তির দ্বন্দ্বে, সাজ না-করা সহজ সুন্দরীরাই ছিলেন মনপসন্দ। ষাটের দশক শেষতক ফ্যাশন বাঙালির নিজস্ব মুদ্রায় এক ট্যাবু শব্দ। একদিকে বামপন্থী চিন্তাধারা, পার্টিশন-পরবর্তী দুঃখী কেজো মেয়েদের লড়াকু সত্তা, এর সঙ্গেও ঠিকঠাক যেত কেজো আটপৌরে সাদাসিধে পোশাক, প্রসাধনহীনতা।
পশ্চিমঘেঁষা পোশাকের প্রতি মূলধারার ঈষৎ পক্ষপাতদুষ্ট তির্যক দৃষ্টিটা থেকেই যাচ্ছিল তাই। ফ্যাশনদুরস্ত হওয়াটা খুব হাতে গোনা কয়েকজনের সাহসী পদক্ষেপের ব্যাপার। অথবা বাবার মোটা ব্যাংক ব্যালান্সের সঙ্গে সমার্থক। যেমন সিনেমায় প্রতিফলিত অপর্ণা সেনের পারসোনা, রাতের রজনীগন্ধা অথবা বসন্ত বিলাপের প্যান্ট-টপ পরিহিতা স্মার্ট লুক, তখনো আপামর বাঙালির ভুরু তুলে দেখার উপযোগী এক সাময়িক বিলাসিতা। আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেন্টি সিক্স-এর চটুলতায় শেষ মেশ পর্যবসিত।
এই ফ্যাশন দুষ্প্রাপ্যতা, ফ্যাশনেবলদের স্বল্পতা, বা মাইনরিটি স্ট্যাটাস ঘুচিয়ে দেবে দ্য গ্রেট লেভেলার, টিভি। দূরদর্শন বোধ হয় ৭০ দশক থেকে ২০১১ অব্দি বাঙালি মেয়েদের রুচি-ফ্যাশনের হালহকিকত পাল্টাতে একেবারে অব্যর্থ অনুঘটকের কাজ করেছে। মনে রাখব এই তথ্য যে, ১৯৭৫ সালে সবে কলকাতা দূরদর্শনের অবতরণ, মধ্যবিত্ত জীবনের বলয়ে। তারপর দশকে দশকে রূপবদলে বদলে কেবল টিভি, ডিশ অ্যান্টেনা এবং শেষত ইন্টারনেট-কম্পিউটারের হাত ধরে রুচির ছক বলে দিতে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে অবতীর্ণ হচ্ছেন প্রথমে অ্যানালগ পরে ডিজিটাল মিডিয়া। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনগুলো সবই থাকছে, তাদের বিশেষ ভূমিকা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশই নেই। ওই পরিবর্তনগুলোকে চিহ্নিত করতে বা শনাক্ত করতেই সাহায্য করেছে এই ছোট ছোট লক্ষণাক্রান্ত টিভি শোগুলোর ইতিহাস; ফ্যাশন স্টেটমেন্টে যারা অগ্রণী।
যদি বলি, ৭০ এর দশকে বাঙালিনিকে সাজতে শেখালেন দুই রমণী। চৈতালি দাশগুপ্ত আর শাশ্বতী গুহঠাকুরতা? শুনতে খুবই কি অতিসরলীকৃত শোনাচ্ছে? শাড়ি পরিহিতা বাঙালি মেয়ের মডেলে চুলে ফুল, লম্বা হাতা ব্লাউজ এবং চওড়া পাড় দক্ষিণী সুতি বা সিল্কের শাড়ির ঘরানা সম্বন্ধে চৈতালি নিজেই কদিন আগের এক টিভি ইন্টারভিউতে জানালেন। বললেন, আমাদের দুই বোন ভাবত অনেকে, আমরাও প্ল্যান করে একই রকম শাড়ি পরতাম। ফ্যাশনকে জনমানসে প্রথমে জানান দেওয়া তারপর গ্রহণীয় করে তোলা তারপর তাকে বিধিবদ্ধ, স্বতঃসিদ্ধপ্রায় করে তুলেছেন নিজেদের রুচিসম্মত কিছুটা ‘শান্তিনিকেতনী’ সাজ, অই দুই নারী, বারংবার মধ্যবিত্তের নাগালে চক্ষুপথে নিজেদের বারবার উপস্থিত করে, তারপর সেই পথে একেবারে মধ্যবিত্ত বাঙালির মানসপটেই নিজেদের বিধৃত করে। যে কাজ অবলীলায় ঘটে গেছে, কোনো প্ররোচনা ছাড়াই।
এর পরপর ‘সানন্দা’ পত্রিকার ফ্যাশন পাতা আমাদের বেশ কিছুদিন শাসন করবে, শেখাবে আটপৌরে অথচ রুচিশীল সাজের নতুন ভাষা, যা আশি ও নব্বইকে প্রায় অধিকার করে রাখবে। বাঙালি চেটে নেবে দক্ষিণাপণের নানা রাজ্যিক এথনিক কাপড়চোপড়ের স্বাদ, উড়িষ্যা রাজস্থান গুজরাটের ছাপ ছোপ ইক্কতের অ আ ক খ শিখে আপ টু ডেট হবে; সঙ্গে উঠে আসবে অ্যাকসেসরির মতো কঠিন শব্দের জলভাত উদাহরণ, সম্বলপুরী শাড়ির সঙ্গে রুপোর গয়না চলে, গুর্জরী ছাপার শাড়ির সঙ্গে পুঁতির। মাটি দিয়ে তৈরি শান্তিনিকেতনী গয়নার এক অদ্ভুত জনপ্রিয়তা দেখব। যা কিছু ডিফারেন্ট তাই মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠবে। কিছুদিন পরে বিরক্তিকর হয়ে যাবে কাঁথা স্টিচের নতুনত্ব অথবা বালুচরীর দেখনধারী সুতার কাজের ভার। এসব ফ্যাশনের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমাদের মতো অনেক মেয়েরই বয়স বাড়বে, কিন্তু সাজ কমবে না। বরঞ্চ হাতে আর একটু কাঁচা টাকা আসার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োগও ক্রমশ বেড়েই চলবে।
যে মা-মাসিরা চল্লিশ পেরোলেই হালকা রং, সাদা, বা ম্যাটমেটে খোলের শাড়িতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে প্রৌঢ়ত্বের স্বর্গে সসম্মানে উত্তরণ করতেন, তাঁরা অবলুপ্ত হয়ে যাবেন, থাকবেন শুধু যৌবন ছাড়তে না চাওয়া ল্যাকমে-নির্ভর নতুন মা-আন্টি গোষ্ঠী। ‘আমার মা সব জানে’ পড়া জিকে-তাড়িত মায়েরা ও আন্টিরা, খাদ্য-পানীয়ের আঠাশটি পুষ্টিগুণের বিস্তারিত বিবরণ ঠোঁটস্থ করা মায়েরা ও আন্টিরা, অ্যাগ্রেসিভ, ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ দেখানো, অথবা ঘরের ভেতরটাকে আমূল পাল্টে দিয়ে বাইরের মতো করে তোলা পালিশমারা চিরযৌবনারা। মধ্যবয়সিনী, প্রৌঢ়া, এই শব্দগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যাদের বায়েঁ হাত কা খেল।
আসলে আশির দশক আমাদের দিয়েছে আমেরিকা থেকে আমদানি হওয়া নারীবাদ ও বিউটি ম্যাগাজিন, দুইই। আর দিয়েছে, মধ্যবিত্তের পাড়ায় পাড়ায় বিউটি পার্লার, লিপস্টিকের সর্বত্রগামিতা। আর, তার পরপরই নব্বই দিল তসলিমা নাসরিনের আনন্দ পুরস্কারধন্য ব্র্যানডেড নারীবাদ, বিদেশ থেকে আসা কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে সিজন করা, একবার এখানকার জলহাওয়ায় পাতন করে নেওয়া, তাই বিশুদ্ধ, নারীবাদ। হিন্দু মুসলিম আদি দিশি ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে পড়ে নেওয়া এই নারীবাদের ঢেউ এসেছিল, পাশাপাশি দু-চারটি অন্য ঘটনার সঙ্গে।
ভুললে চলবে না যে নব্বই দশকে উঠে এসেছে মনমোহন ইকোনমিকস, ফেটেছে লিবারালাইজড অর্থনীতির ধামাকা। মেয়েরা কীভাবে জড়িত এই ঘটনার সঙ্গে? কেউ এ প্রশ্ন আর জিগ্যেস করবেন না, কারণ সবারই মনে আছে, ১৯৯৪-তে অবাক করা সেই বাঙালি মেয়েটিকে- সুস্মিতা সেন। মিস ইউনিভার্সের শিরোপা নিয়ে যে নিজেই কম অবাক হয়নি। আসল খেলাটার যোগাযোগ আরও স্পষ্ট হলো আরও কয়েক দিন পরে, সেই ১৯৯৪-তেই মিস ওয়ার্ল্ডের শিরোপাও যখন জুটল আমাদের দেশের মেয়ে ঐশ্বর্য রায়ের কপালে। কাকতালীয়? না এশিয়ার অন্যতম বাজারের দরজা পাশ্চাত্যের যাবতীয় প্রসাধনসামগ্রীর বিক্রেতাদের কাছে খুলে যাওয়া? ঘরের মেয়েটির পদাঙ্ক অনুসরণ এরপর শুধু। একের পর এক বিউটি প্রেজেন্টে নেমে আসছে ভারতীয় মেয়েরা, বাঙালি মেয়েদের জীবনে ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে রেভলন-মেবিলাইন-এল-এইটিনের মতো সব ম্যাজিক শব্দ; ডিপ রাস্ট, কফি ব্রাউন আর লাইট অ্যাম্বারের মতো সব দূরদূরান্তের হাতছানি ভরা রঙের শেড। মন কেমন করা গন্ধ পারফিউম আর সাবানের। ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ, আহা, মেয়েদের কাছে খুলে দিল নানা পশরার দ্বার।
যেভাবে নব্বই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে সহজতর করল এস টি ডি বুথের সাহচর্যে দূরভাষী প্রেম, আনল পোশাকে সালোয়ার কামিজের গ্রহণীয়তা, বাসে ট্রামে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে চলাফেরার যোগ্যতা ও গ্রহণীয়তা। দু-চারটে ধর্ষণ, দু-চারখানা অশøীল ইঙ্গিত, কিছু কিছু ভুলভাল প্রেম তার কাছে কিছু না।
ভুলে গেলে চলবে না, এই নব্বই আমাদের দিয়েছে কিছু প্রডাক্ট, ওয়াশিং মেশিন অথবা মাইক্রোওয়েভের স্বাধীনতারও আগে। তার একটা অবশ্য উল্লেখ্য। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও একেবারে অনস্বীকার্য এক বিপ্লব এনেছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের শুষ্কতার বহুলপ্রাপ্যতা। স্মল ইজ বিউটিফুল নিয়ম মেনে আর এনেছে সহজে ব্যবহার্য এক টাকা দু টাকার পাউচে সর্বজনের আয়ত্তাধীন শ্যাম্পু। ভুললে চলবে না, গরম গরম ফেমিনিস্ট ভাষণের একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কন্যাভ্রূণ হত্যার জন্য লিঙ্গ নির্ধারণের ক্লিনিকরা, পাশাপাশি সৌন্দর্য রক্ষায় প্ল্যাস্টিক সার্জারি, নানা ধরনের স্কিন ট্রিটমেন্টের ক্লিনিকগুলোও ব্যাঙের ছাতার মতো।
পণ্যায়ন আর বিশ্বায়নের ঢেউ কুড়ি বছরের দেরিতে মার্কিনি নারীবাদকে নিজস্ব বয়ানে আনল এ বঙ্গে, ব্রেসিয়ার পোড়ানোর বদলে যারা ব্রেসিয়ারের সেল দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সবার সামনে বিনা দ্বিধায়!
চোখ রাখুন আগামী সংখ্যায়…
[লেখা: লেখকের ব্লগ থেকে]মডেল: সামিন ও তিশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস