সেলুলয়েড I দেবী
প্রযোজনা: জয়া আহসান
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অনম বিশ্বাস
চিত্রায়ণ: কামরুল হাসান খসরু
সংগীত: প্রীতম হাসান, অনুপম রায়
অভিনয়: জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অনিমেষ আইচ, শবনম ফারিয়া, লাবণ্য চৌধুরী প্রমুখ
সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে মূল সমস্যার জায়গাটা হলো সাহিত্যকে সরাসরি চলচ্চিত্রায়িত করা। সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুটো ভিন্ন জ্ঞাপন বা কমিউনিকেশন মাধ্যম। উভয় মাধ্যমের মধ্যে পারস্পরিক ভাষার আদান-প্রদান বা ভাববিনিময় হতে পারে। কিন্তু একটি মাধ্যমকে যদি অন্য মাধ্যমে রূপান্তর করা হয়, তাহলে রূপান্তরিত মাধ্যমটি তার নিজস্ব চরিত্র হারাবে। সৌভাগ্যের বিষয়, ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে তেমনটা হয়নি বললেই চলে।
হুমায়ূন আহমেদের টেক্সটের ন্যারেটিভকে আধার করে জয়া আহসানের প্রযোজনায় ও অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘দেবী’ নামক ছবিটির ক্ষেত্রেও এটা সত্য। চলচ্চিত্রকে ‘বই’-এর রূপ দেওয়া হয়নি। অবশ্য তারপরেও হুমায়ূনের ‘দেবী’ আর জয়া-অনমের ‘দেবী’র মধ্যে তুলনা টানার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ, সেই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্রের ‘দেবী’ হুমায়ূনের ‘দেবী’র তুলনায় ভালো কিংবা খারাপ- যা-ই হোক না কেন- এর স্ক্রিপ্ট, ন্যারেটিভের ফিল্মি ট্রিটমেন্ট, ক্যামেরা-সাউন্ড-এডিটিং-মিউজিক মিলিয়ে চলচ্চিত্রটি স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের বিচার-বিবেচনার ওপর তা নির্ভর থাকেনি। এটা ছবির সাফল্য।
ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, রানুদের বাড়িওয়ালার মেয়ে নীলুকে প্রেমিকের ছদ্মবেশে তুলে নিয়ে গেছে বিকৃতমনা রক্তখেকো এক পুরুষ, নীলুকে ধর্ষণ করে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চাইছে ছেলেটা, অন্যদিকে অলৌকিক শক্তির অধিকারী রানু বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারে নীলুকে পাঠানো ছদ্মপ্রেমিকের চিঠিটা হাতে পেয়েই। উপন্যাসে রয়েছে, শেষ মুহূর্তে নীলু এমন এক শক্তি অর্জন করে, যাতে সে রক্তখেকো পুরুষের নিশানা প্রতিহত করতে পারে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। অন্যদিকে রানু মারা যায়। উপন্যাসে রানুর মারা যাওয়ার সঙ্গে নীলুর শক্তি অর্জনের বিষয়টির যোগসূত্রের ব্যাপারে লেখক ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন। উপন্যাসে পরিষ্কার হয়নি যে, আদৌ কোনো অলৌকিক শক্তি নীলুকে উদ্ধার করেছিল, নাকি শেষ মুহূর্তে নিজের অদম্য শক্তি দিয়েই সে রুখে দিতে পেরেছিল ধর্ষক পুরুষটিকে। কিন্তু চলচ্চিত্রে রানুর অভিব্যক্তি, নীলুর প্রত্যয় আর নীলু ও তার ছদ্মপ্রেমিকের ইন্টার্যাকশনের মধ্যে এমন কিছু স্পেশাল ইফেক্ট ও ফ্লাশব্যাক ব্যবহার করা হয়েছে, যার অবধারিত অর্থ- রানুর ভেতরে থাকা রু´িণী দেবী রানুকে ছেড়ে নীলুর ভেতরে চলে যাচ্ছে, যেভাবে বিষ্ণু মন্দিরে ধর্ষকের হাত থেকে কিশোরী রানুকে উদ্ধারের জন্য দেবীমূর্তি রানুর ভেতরে প্রবেশ করে পুরুষকে প্রত্যাঘাত করেছিল! ছবিতে মনে হয় রু´িণী দেবীকে রানুই তার শরীর থেকে নীলুর কাছে পাঠিয়ে দেয় এবং নিজের দেবীসত্তার অন্যত্র গমনে প্রাণ বিসর্জন ঘটে রানুর! উপন্যাসের ধোঁয়াশার বদলে চলচ্চিত্রে অনিবার্য অর্থ তৈরির মাধ্যমে ন্যারেটিভের পরিসমাপ্তি হয়েছে, এটা ছবিটির স্বতন্ত্র অবস্থান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে, ‘দেবী’র মধ্যে নারীভাষ্যের বা নারীশক্তির উত্থানের যে ভাবনা বা বোধ বেশি করে ক্রিয়াশীল হওয়ার কথা ছিল, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে নারীর লড়াইয়ে মুড তৈরির অবকাশ ছিল, তা ওই অনিবার্য অর্থ তৈরির প্রবণতায় অনেকটাই অন্তরালে চলে গেছে। পুরুষের ‘মেলগেজ’, পুরুষের জন্য তৈরি বিনোদনের উপকরণে নারীকে ভোগ্যপণ্য করা থেকে শুরু করে খুন-ধর্ষণের মতো চূড়ান্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে পুরুষতন্ত্র আবর্তিত হয়, উপন্যাসের রানুর অডিটরি হ্যালুসিনেশন ছাপিয়ে সেই সবকিছু অতি অন্তরালে চলে গেছে আধিভৌতিক বিষয়গুলোকে ওভাররেটেড করার জন্য। এ ছবির সাউন্ড ডিজাইন ও স্পেশাল ইফেক্ট মাঝেমধ্যে পাতি হরর ফিল্মের মতো, যা বেশ পীড়াদায়ক এবং এ ক্ষেত্রে নারীচেতনার বা নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি আড়ালে চলে গিয়ে হয়তো অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে অতিলৌকিক বিষয়-আশয়।
তবে মিসির আলির চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীকে বেশ ভালো মানালেও তিনি তাঁর ‘উচ্চমান’-এর অভিনয় করতে গিয়ে অতিসচেতন হয়ে উঠেছেন কোথাও কোথাও, যা চোখে লেগেছে। জয়া দারুণ, তাঁর অ্যাপিল, অভিনয়- সবই ভালো। নীলু চরিত্রে শবনম ফারিয়া দর্শকের মন কেড়েছেন। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি প্রশংসনীয়। এডিটিং ভালো। কস্টিউম, মেকআপ পারফেক্ট। তা সত্ত্বেও ছবিটি ভালো। সুন্দর। কয়েকবার ‘দেবী’দর্শন করা যেতেই পারে।
অতনু সিংহ
কুইজ
১। নীলু চরিত্রে কে অভিনয় করেছেন?
ক. নুসরাত ফারিয়া খ. শবনম ফারিয়া গ. পরীমনি
২। কোন হিন্দু দেবীর প্রসঙ্গ ‘দেবী’তে বারবার উঠে এসেছে?
ক. কালী খ. সরস্বতী গ. রু´িণী
৩। কলকাতার কোন গায়ক ছবিতে গান গেয়েছেন?
ক. কবীর সুমন খ. রূপঙ্কর গ. অনুপম রায়
গত সংখ্যার বিজয়ী
১. ফারজানা আক্তার, ধানমন্ডি, ঢাকা।
২. মো. জহিরুল ইসলাম, বনানী, ঢাকা।
৩. পারভীন সুলতানা, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।