ফিচার I অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
নবান্ন কৃষিনির্ভর বাংলায় নতুন জীবনের আশ্বাসে পূর্ণ হয়ে ওঠার উৎসব। লিখেছেন অতনু সিংহ
প্রথম ফসল গেছে ঘরে-
হেমন্তের মাঠে মাঠে-
ঝরে শুধু শিশিরের জল;
পেঁচা, জীবনানন্দ দাশ
বাংলা দিনপঞ্জির প্রতিটি মাসই উৎসবে পরিপূর্ণ। বাঙালি, মারমা, চাকমা, সাঁওতাল, নেপালি, রাজবংশীসহ প্রতিটি জাতিসত্তার নানা উৎসবে পরিপূর্ণ বাংলার গণজীবন। এসব উৎসবের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখে বাংলার বেশ কিছু পর্ব। নবান্ন এগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই পার্বণ পরিচিতিসত্তায় বাঙালির উৎসব হলেও তা সামগ্রিকভাবে এই ভূখন্ডের কৃষিসম্পর্কিত। ঋতুরঙ্গের বাংলায় অগ্রহায়ণ আসে ফসলের নতুন বার্তা নিয়ে। বাংলার মানুষের যৌথনির্জ্ঞানজুড়ে যে সামান্যটুকু চাওয়া রয়েছে, যে বাক্য গাঁথা আছে বাংলার মানুষের মনে, যাপনকাব্যে- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’- নতুন অন্নের গন্ধ ছড়িয়ে কুয়াশা-ঢাকা হেমন্ত বাংলার মানুষের সেই আশা পূর্ণ করে তোলে।
নবান্ন অর্থাৎ নতুন অন্ন। অঘ্রান বা অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসব নব অন্নে মুখরিত হয়ে ওঠার উৎসব। সোনালি ধান ঘরে তোলবার উৎসব। বাংলার কৃষি ও কৃষিকেন্দ্রিক লোকজীবন সময়ের ধারায় প্রবাহিত করার উৎসব। কৃষিবন্দনারও বটে। নবান্ন সম্পর্কে দু-এক কথা আমরা প্রত্যেকেই যা কম-বেশি জানি, সেসব নিয়ে লিখতে হলে প্রথমেই আসবে হেমন্ত ঋতুর কথা।
যে ঋতু নতুন ফসলের, যে ঋতু জীবনানন্দের, সেই হেমন্তই ছিল বাংলার মানুষের বর্ষসূচনা ও বর্ষসমাপনের ঋতু। কেননা, দিল্লির সম্রাট আকবরের অধীনে বাংলা শাসিত হওয়ার আগে, অগ্রহায়ণ ছিল বাংলার বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। আর কার্তিক ও অগ্রহায়ণ- এই দুই মাস নিয়েই হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণ শব্দটি অগ্র ও হায়ণ এই দুই শব্দের সন্ধি। অগ্র অর্থাৎ প্রথম বা সূচনা আর হায়ণ শব্দের মানে বর্ষ বা বছর। নতুন আমন ধান ঘরে তোলার মধ্য দিয়েই বাংলার ক্যালেন্ডারের দিনযাপনের সূচনা হতো। পরে ফসলের কর সংগ্রহের সুবিধার্থে সম্রাট আকবরের রাজসভা থেকে সৌরগণনা আর চান্দ্রগণনা মিলিয়ে বৈশাখ মাসে বর্ষগণনার সূচনা হয়। সে ভিন্ন আলাপ, কিন্তু অগ্রহায়ণ থেকে শুরু হওয়া বাংলার একদা নববর্ষ আর একই মাসে নতুন ধান ঘরে তোলার মধ্যকার কৃষিকেন্দ্রিক দিনযাপনের সম্পর্ক ঘিরে নবান্ন উৎসবের তাৎপর্য।
বাংলার লোকগাথা, লোকসংস্কৃতির মধ্যে যা কিছু টোটেম, সবই মূলত নদ-নদী গাছগাছালি, বৃক্ষমালা আর কৃষিকেন্দ্রিক। নবান্নে নতুন ফসল বাংলার যৌথনির্জ্ঞান ধারণের গুরুত্বপূর্ণ টোটেম। এ মাসেই খেজুরগাছে হাঁড়ি বাঁধার সূচনা হয়, উঁকি দেয় শীত। তাই নতুন চালের গুঁড়ি আর নতুন গুড়সহযোগে পিঠাপুলির আয়োজনে বাংলার কৃষিনির্ভর লোকমানুষ ফসলের লোকবন্দনায় মেতে ওঠে। রস ও রসনাতেই শুধু নয়, নবান্ন আসে গান হয়ে, লোকবাদ্যের তালে তালে, পরবের ছন্দে। হেমন্তের অগ্রহায়ণ বাংলার বুকে হয়ে ওঠে যূথজীবনের চালচিত্র, হৈমন্তীর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা নিজেকে প্রকাশ করে প্রেমে, সংগীত ও কাব্যে এবং কবিতায়…বাংলার লোকসাহিত্যে তাই নানা সময় ঘুরেফিরে আসে এই নবান্নের কথা। নব-অন্নকে নবজাতকের মতো করে স্বাগত জানাতে প্রাণস্পন্দনে নবান্ন হয়ে ওঠে জীবনের উৎসব, চিরজীবিতের উৎসব।
কিন্তু নবান্নকে ঘিরে বাংলার লোকজীবনের শাশ্বত যে যাপনচিত্র, তা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। কেননা, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার বদলে আমরা নগরকে প্রসারিত করছি গ্রামীণ জীবনে। শহর বাড়ছে। শহরের সূত্রে বাড়ছে উদার-অর্থনীতির প্রকোপ। গায়েবি লগ্নিপুঁজি আর ভুবনায়নের রাজনীতি ক্রমে গিলে ফেলছে নিজ নিজ পরিচিতিসত্তার একেকটি লোকায়ত স্পেস। পিঠা-পুলি, গান-বাজনা, মেলা-সমাগমে মেট্রো শহরেও নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, ঠিক কথা। কিন্তু তার ব্যাপ্তি, আবেদন, তাৎপর্য লোকজীবনের মতো নয়। বরং লোকজীবন যা কিছু ধরে রেখেছিল, সেসব উজাড় করার খেলার সূচনাও মেট্রো পরিসর থেকেই। যেমন ধরা যাক, বাংলার বহু শস্যবীজের পেটেন্ট দখল করে নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া। জল-জমি-জঙ্গল দখল করার পাশাপাশি ধ্বংস করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার শস্যবীজ। আমাদের নানা প্রকার ধান হারিয়ে গেছে বাংলার ক্ষেতখামার থেকে। তাই নবান্নর পুনর্পাঠের দরকার।
আমাদের ফসল, প্রকৃতি, ঋতুচক্র, যাপন, সংস্কৃতি ও ভাষাকে রক্ষার জন্য কৃষিনিবিড় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা জরুরি, নবান্নের পুনর্পাঠে তা সঞ্চারিত হতে পারে। গোলকায়ন বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ধরনের সম্পদ কুক্ষিগত করে পণ্যবাদের মোড়কে একমাত্রিক কনজিউমার সোসাইটি তৈরি করতে চায়। এটা করতে গিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয় সংস্কৃতিগুলোর তাৎপর্য বা অভিমুখ ধ্বংস করে তাকে মিউজিয়ামে সাজানো কালচারাল ফসিল বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গায়েবি লগ্নিপুঁজির স্বার্থের অভিমুখে ভোক্তাসংস্কৃতি নির্মিত হয়। ভেঙে পড়ে যাপন, স্বপ্ন, ঘর। গ্রামজীবনে, কৃষকের কৃষির স্বাধীনতা, কৃষির সার্বভৌমত্ব আর কৃষিবৈচিত্র্যের স্পেস নষ্ট হয়ে গেলে নবান্ন তার তাৎপর্য হারায়, তখন হয়ে ওঠে তা শহুরে শৌখিনতায় টেবিল শোপিস।
নবান্নকে ঘিরে কৃষিনিবিড় বাংলার যে সংস্কৃতি ও অর্থনীতি, তা কিন্তু অতীতেও রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের কথা। ব্রিটিশ বাংলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী, ভূস্বামীদের অনুগত বাংলার কায়েমি স্বার্থবাহী গোষ্ঠী আর উত্তর ভারতীয় ও মাড়োয়ারি মজুতদারদের কারণে ১৯৪৩ সালে যে দুর্ভিক্ষ আর মহামারির সৃষ্টি হয়েছিল, তার জেরে ৪৩-৪৬ সাল অবধি বাংলায় মৃত্যু হয়েছিল ৩৮ লাখ মানুষের। যে বাংলা কৃষিসম্পদে সমৃদ্ধ, নবান্নে যেখানে ধানের গোলা উপচে পড়তো সোনালি আমন ধানে, সেই বাংলা প্রদেশে লাখে লাখে মানুষ মারা গেল, ক্ষুধা-অপুষ্টি আর তা থেকে সৃষ্ট মহামারি থেকে। এরই প্রেক্ষাপটে বিজন ভট্টাচার্য লিখলেন তাঁর কালজয়ী নাটক ‘নবান্ন’। কলকাতার গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় ও শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় সে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। পরে ১৯৪৮ সালে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় ও কুমার রায়ের নির্দেশনায় তা ফের মঞ্চস্থ হয়।
অর্থাৎ নবান্ন নিছকই বাংলার একটি লোকায়ত উৎসব নয়; কৃষিনিবিড় বাংলার যে প্রাণস্পন্দন, তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই উৎসব। তাই আমরা যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ও সুরকে কণ্ঠে ধারণ করে গেয়ে উঠি, ‘ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি, মধুর হাসি…’; তখন আমাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় বাংলার কৃষিসম্পদ, মাঠঘাট, ক্ষেত-খামার, জল-জমি-জঙ্গল রক্ষা করার। তাতেই রক্ষা পাবে বাংলা, বাংলার নবান্ন।
ছবি: সংগ্রহ