আলাপন I সহজ মানুষ বড়ই কঠিন -পার্বতী বাউল
শৈশবের নাম মৌসুমী পারিয়াল। জন্ম আসামে। বাবা-মায়ের শিকড় চট্টগ্রামের রাউজানে। আসামে শৈশব। বাঙালি-অহমিয়া জাতিদাঙ্গার কারণে চলে যেতে হয় পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনের কলাভবনে। পার্বতী সনাতন দাসের দেওয়া নাম। পড়াশোনা শেষে চলে যান কেরলে। নিজেকে নিয়োজিত করেন সুফিসাধনায়। সেখানেই এক পুতুলনাট্যের শিল্পীর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন। তৈরি করেছিলেন আশ্রম। দেশ-বিদেশে নিজের গান আর পারফরম্যান্স নিয়ে ছুটে বেড়ান পার্বতী। এসেছিলেন ঢাকায়। ক্যানভাসের তরফে তাঁর সঙ্গে আলাপ। পেশ করছেন অতনু সিংহ
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহড়াকক্ষের ভেতরে গান হচ্ছে তখন, ‘আনন্দে বলো জয় গুরু জয়…’ ক্যানভাসের ক্যামেরায় ধরা পড়লো সেই দৃশ্য। দুহাত তুলে পার্বতীর সঙ্গে সবাই তখন গাইছে, ‘জয় রাধে রাধে, গোবিন্দ জয় রাধে…’। দোতারা, খোল-কত্তালের সঙ্গে বেজে উঠছে সিঙ্গা, শঙ্খ… এই আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে শেষ হলো গানের ওয়ার্কশপ। এদিকে সাংবাদিকদের ভিড় বাড়ছে।
চিত্রকলা-নৃত্য ও থিয়েটারে প্রশিক্ষিত শহুরে একটি মেয়ের সহজিয়ার সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার বাস্তবিক গল্প, গুরুর সন্ধান পাওয়া, সাধুসঙ্গ করতে করতে একদিন তাঁর সাধনায় মগ্ন হয়ে যাওয়া, গান ও বাউল-ফকিরি তত্ত্ব নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো…এসব কথা থেকেই শুরু হলো পার্বতীর সঙ্গে সহজ এই আলাপন। আমরা জানতে চাইলাম তাঁর এই যাপনের পেছনে কিসের তাগিদ?
পার্বতী বলতে শুরু করলেন-
-বোলপুরে সনাতন দাস বাউলের কাছ থেকেই আমার বাউলজীবন শুরু। সনাতন বাবার ওখান থেকে আমি চলে যাই কেরলে। সেখানে এক সুফি গুরুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ওনার নাম আবদুল সালাম। সেখানে আমি পাঁচ বছর ছিলাম। ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে যাতায়াত করলাম। অবশ্য এখনো তাই করি। শান্তিনিকেতন থেকে বারো কিলোমিটার দূরে কোপাইয়ের কাছে কামারডাঙ্গা গ্রামে আমরা একটা আশ্রম বানিয়েছি। নাম সনাতন সিদ্ধাশ্রম। তখন যেহেতু আমার গুরুরা জীবিত, আমি তাই ছয় মাস থাকতাম কেরলে, বাকি ছয় মাস বোলপুরে। আমায় অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, এত গুরু কেন? আসলে গুরু নানা ধরনের হয়, যেমন দীক্ষাগুরু, শিক্ষাগুরু ইত্যাদি… সাধনা বা উপলব্ধির অগ্রসরতার জন্য গুরুরাই বলে দেন, এইটুকু ব্যাপার আমার কাছে রপ্ত করে বাকিটুকুর জন্য তুমি অমুকের কাছে যাও… যাতে বিভিন্ন গুরুর দর্শন বা চিন্তাজগতের মাধ্যমে নিজের জগৎকে পরিপুষ্ট করা যায়… তবে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ঘুরে ঘুরে বেড়ান কৌতূহল থেকে, কিন্তু কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে থাকেন না। আমি ঠিক তেমন নই, আমি গুরুর নির্দেশমতোই কেরলে গিয়েছিলাম। কেরলে থাকার আরও বড় একটা কারণ হচ্ছে, ওখানেই আমার গুরুজি আমার বিবাহ দিয়েছিলেন গোপালন নায়ারের সঙ্গে। আর কেরালায় থাকার ফলে এই সাধনার অন্তর্জগৎকে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। বাউলজীবনে আমার পঁচিশ বছর হয়ে গেছে, সনাতন বাবার কথাতেই আমি গান গাইতে শুরু করেছিলাম। আমি প্রথম গান শুরু করেছিলাম নিজের ভালোবাসা থেকেই। মানুষের জন্য গান গাইবো- এসব চিন্তা মাথায় ছিল না। একবার ইউরোপে গিয়ে বাউলদের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখেছিলাম, সেখানে দেখলাম খালি গাঁজা খাওয়া আর সেটা হলো উন্মাদনা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ফকিরির মধ্যে, বাউলদের মধ্যে যে গভীর দর্শন আছে, সেটা ওই ছবিতে না দেখে আমি খুব দুঃখ পাই। ব্যাপারটা গুরুজিকে বললাম। তিনি বললেন, আসলে ওরা গানের অর্থ বুঝতে পারছে না, কেবল সুর শুনছে, নাচ দেখছে, কিন্তু বাউল-ফকিরের গান তো সুরের গান নয়। বরং শব্দগান। আসলে বাউল-ফকিরি গান গাওয়ার জন্য, এমনকি শোনার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়। সাধুগুরুদের সঙ্গ করতে হয়, তাতে গানের অর্থ টের পাওয়া যেতে পারে। বাউলগান গাইতে হলে যেমন সাধনার প্রয়োজন, তেমন শ্রোতাদেরও প্রস্তুত হতে হয়। তবে এসব গান হাজার বছর ধরে টিকে আছে, এখন এই গানগুলোর তত্ত্ব, অর্থ অনেকের কাছে খুব কঠিন কিছু মনে হলেও একটা সময় গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই গান শোনার চর্চা ছিল। চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে, তাই অর্থ বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই এই চর্চাকে রি-কাল্টিভেট করাটাও দরকার। কারণ, একা কেউ বাঁচতে পারে না, শ্রোতা না থাকলে এসব গানের শিল্পীদের গানও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তো ইউরোপে বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে ভুল ধারণা আন্দাজ করে এবং গুরুজির সঙ্গে সে বিষয়ে আলাপ করে বুঝলাম, আমাদের জীবনদর্শন, সাধনা সম্পর্কে ঠিক বার্তা যাতে বাইরের জগতে পৌঁছায়, সে ব্যাপারে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। আমি গুরুজিকে বললাম, দেশে-বিদেশে কীভাবে ঘুরে ঘুরে বাউলতত্ত্ব বোঝাবো, আমার তো টাকাপয়সা নেই। গুরুজি তখন তাঁর ঝোলা থেকে দশ টাকা আমার হাতে নিয়ে বললেন, এই নে, এবার ঘুরে বেড়া। তারপর থেকেই দেশে-বিদেশে আমার ঘুরে বেড়ানো শুরু। যদিও ওই টাকা আজ অবধি আমি খরচ করিনি। আমি থামি না, আমি চলতেই থাকি, চলতেই থাকি… মোট কথা, বাউলতত্ত্ব, সহজধারার ভাব পৃথিবীর সামনে মেলে ধরাটাই আমার কাজ। এটাই আমার সেবা।
বাউল-ফকিরির দর্শনের কথা বলছেন পার্বতী। বাউল-ফকিরি ধারার তো অনেক ঘর আছে, ঘরানা আছে, এসব নিয়ে পার্বতীর ভাবনা আমরা জানতে চাইলাম।
তিনি বলতে থাকলেন-
-বাউল-ফকিরদের অনেক ঘর আছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু প্রতিটি ঘর কোথাও একটা সূত্রে বাঁধা আছে, এমনকি গানের ক্ষেত্রেও যদি দেখা হয়, পর্যায় ধরে যদি দেখা হয়, তাহলে একইভাবে পর্যায় আসে। শব্দ প্রকাশের ক্ষেত্রে, সুরের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তরিকা আছে, কিন্তু অন্তর্নিহিত ভাব একই। বাংলার ভাবসাধনার বিষয়ে বলি, শ্রীচৈতন্যের চিন্তাজগৎ থেকে চারটে ঘর তৈরি হলো। অদ্বৈতানন্দ, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস ও দামোদরের চারটে ঘর অর্থাৎ চার ধরনের পথ। নিত্যানন্দের তরিকায় অন্যান্য শিষ্য এলেন; যেমন বীরভদ্র, নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবীও একজন গুরু ছিলেন। নিত্যানন্দের ঘরের যাঁরা, তাঁরা হলেন অবধূত পরম্পরার। অদ্বৈতের আবার অন্য ঘর। তো একেক গুরু থেকে একেকভাবে ভাবনা বিকশিত হয়েছে। মূল ভাবটা এক। কিন্তু একেক গুরুর অভিজ্ঞতা ও ভাবনা থেকে তাঁদের আলাদা আলাদা ঘর তৈরি হয়েছে। আমরা মানুষ ভজনার কথা বলি। মানুষে মানুষে প্রেমের কথা বলি। সেবার কথা বলি।
পার্বতীর গানে, কথায়, সহজ সাধনার নানা পর্যায়ে রাধাভাবের কথা বারবার উঠে এসেছে। এমনকি তাঁর একটি অ্যালবামের নামও ‘রাধাভাব’। রাধাভাব কী- এই বিষয়ে তিনি বললেন-
-বাউল-ফকিরি সাধনায় যে আকুলতা রয়েছে, সুফি সাধকদের মধ্যে যে আকুতি রয়েছে, রাধার মধ্যেও সেই আকুতি দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের সাধুগুরুদের মধ্যে, সুফি সাধকদের মধ্যে একটা অহেতুকি প্রেম আছে, কৃষ্ণের জন্য রাধার যে অহেতুকি প্রেম- এই প্রেমের জন্য জাগতিক বাধা-বন্ধনের মধ্যে রাধা থাকতে পারেন না। তার বাইরে চলে যান। সুফিরা বা সহজ সাধকেরা তাই জগৎ যেভাবে চলে, তার উল্টো দিকে হাঁটেন। রাধাও তাই। ধারা হচ্ছে বৃষ্টি আর রাধা হচ্ছে যা উপর দিকে ধায়। আমি আমার সুফিগুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সুফি কী? সুফি কে? উনি বলেছিলেন, সুফি হচ্ছে ষোলো বছরের একটি মেয়ে। রাধাও তো তাই। ষোলো বছর, কারণ ওই সময়টায় তার ইনোসেন্স, এবং সে উদার, শুদ্ধ, জগতের নানা কিছু ওই বয়সেই গ্রহণ করা যায়… ওই সময়ে একদম নতুন, নতুন মন, নতুন দেহ… নতুন সময়ে নতুন করে পাওয়া…
এরপর আমরা জানতে চাইলাম, চারপাশে এত লোকজন যে বাউল গান করেন, তা আপনি কীভাবে দেখছেন?
পার্বতী একটু থেমে উত্তর দিলেন।
-এ ক্ষেত্রে আমি একটু ভয় পাই। যদিও বাউলের ভয় থাকা উচিত নয়। তবু আছে। কারণ, আমাদের সাধনার জায়গাটা যদি চলে যায়, তাহলে নতুন গান বা নতুন পদ লেখা হবে না। নতুন গান না লেখা হলে বাউল-ফকিরি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মতো হয়ে যাবে। বাঁধাধরা গন্ডির মধ্যে পড়ে যাবে। বাউলের যাপন আসলে একটা ডায়নামিক ট্র্যাডিশন। এটা ফল্গুনদীর মতো অন্তরালের এক বহমান ধারা। তাই নতুন সাধকের দরকার, নতুন গানের দরকার। মুশকিল হচ্ছে আমরা যখন অ্যানথ্রোপলজিক্যাল স্টাডিজের বিষয়ে কাজ করি, তখন তা খুব পাশ্চাত্যমুখী ছকে বাঁধা একটা বিষয় হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশ, আমাদের সংস্কৃতি তো ছকে বাঁধা কোনো বিষয় নয়, অথচ আমরা বারবার নিজেদের ছকে বাঁধতে চাই। আর একটা কথা হলো, যাঁরা বাউল গাইতেন, তাঁদের কাছে সাধনাটা বড় ছিল। বাউল-ফকিরি গানে সাধনাটাই বড় জিনিস। গানটা অনুষঙ্গ মাত্র। সে জন্য, আগে বাউল-ফকিরি গানের মজাটা আলাদা ছিল। এখন দেখি বাউল গান নামে যা কিছু করেন, সেগুলো নানা ধরনের যন্ত্রানুষঙ্গে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে এ ধরনের গান তার অর্থ ও তাৎপর্য হারাচ্ছে। একইভাবে কিন্তু ভরতনাট্যম নষ্ট হয়ে গেছে, মন্দিরের নাচ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কোরিওগ্রাফি ফিক্স করে ওই নাচগুলো হচ্ছে, কিন্তু এসব নাচের মধ্যে যে একটা স্টোরি টেলিং ছিল। আগে মন্দিরে এই নাচগুলো হতো, যারা নাচতেন, গাইতেন তারাই, নৃত্যগীতির মাধ্যমে স্টোরি টেলিং ফুটে উঠতো। আর এখনকার মতো উদ্ভট মুভমেন্ট ছিল না, এখন যেমন পা-টা উপর দিকে তুলে দিয়ে হাতটা নিচে রেখে অদ্ভুত কান্ড ঘটানো হয়, এই সবকিছুই হতো না। অনেক সিম্পল ছিল। বাউলগানেও যদি এমন সব চটক হাজির করা হয়, তাহলে সেটা আর বাউল-ফকিরির গান থাকে না।
তবে কি যা কিছু লৌকিক, সেগুলোকে পণ্যায়িত করার আয়োজন চলছে ভোগবাদী আজকের দুনিয়ায়? এই প্রশ্নে পার্বতী বলতে থাকলেন-
-আমি কঠিন কথা বলতে ভালোবাসি না। কারণ, এই জগতে প্রত্যেকেরই একটা এগজিসটেন্স আছে। তারা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকেন। কিন্তু আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে এ ব্যাপারে আমাদের কী করা উচিত। কোনো রকম কম্প্রোমাইজ না করে নিজেদের টিকিয়ে রাখাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এটা আমি শিখেছি খুব বয়স্ক একজন বাউল মাতাজির থেকে। আমার গুরুজির আশ্রম ছিল বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। পাশেই অনেক পুরোনো একটা আখড়া ছিল, সেখানে ওই মাতাজি থাকতেন। এটাও কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনি যে কত পুরোনো আখড়া রয়েছে, সেগুলোর সংরক্ষণ প্রয়োজন, আমরা বড় বড় ইমারত-স্থাপত্য সংরক্ষণের ব্যাপারে কত ভাবি, কিন্তু এই ৫০০ বছরের পুরোনো আখড়া, ৭০০ বছরের পুরোনো আখড়াগুলোকে যে বিশেষ সম্মান দিয়ে ধরে রাখা দরকার, এটা ভাবি না। যা বলছিলাম, ওই মাতাজির সঙ্গে আমার দেখা হয় যখন, আমি ওনাকে বলি এই আখড়ায় আপনি একা থাকেন, ভয় করে না? উনি বলেন, গ্রামের লোকেরা এখানে এসে থাকতেও চায়, কিন্তু ওরা তো সাধু নয়, আখড়ার আচার-আচরণ জানে না, তাই আমি একাই থাকি। আমি ওনাকে বললাম, বিভিন্ন লোকজন তো এই আখড়া নিয়ে নানা কিছু ভাবে। তখন উনি বললেন, লোকে কী ভাববে, তা দিয়ে আমি কী করবো? আমায় তো আমার মতো করে চলতে হবে। হ্যাঁ, বাউলদের, ফকিরদের তাঁদের মতো করেই চলতে হবে।
পার্বতী তাঁর গানের মতোই সুন্দরভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। মঞ্চে কিংবা অঙ্গনে তাঁর গান ও নৃত্য- নৃত্যগীতি- যেমন মুগ্ধ করে দর্শককে। তেমনই তাঁর কথা শুনে যাচ্ছেন মহড়াকক্ষে উপস্থিত মানুষেরা। এবার তাঁর নৃত্যগীতির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলো- আপনার পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়, নৃত্য ও থিয়েটারের প্রথাগত শিক্ষা নিয়েছেন ও অনুশীলন করেছেন আপনি। এই বিষয়ে একটু বলবেন?
তিনি জানালেন, আমরা ঠিকই ধরেছি।
-আমি ছোটবেলায় চার বছর বয়স থেকে নাচ শিখতাম। কত্থকসহ ধ্রুপদি নৃত্যের তালিম নিয়েছি বেশ কিছুদিন। ধ্রুপদি সংগীতের তালিম নিয়েছি। বেশ কিছুদিন থিয়েটারও করেছি। আর শান্তিনিকেতনে আমার পড়াশোনা ভিজ্যুয়াল আর্টের ওপর।
-আপনার পারফরম্যান্সকে এসব শিক্ষা কতটা নতুনত্ব দিয়েছে?
-আমার গুরু সনাতন বাবা আমায় বলেছিলেন একা গাইতে। মঞ্চে বা অন্য কোথাও আমি একতারা নিয়ে একাই গাই, একাই নাচি। এককভাবে গান গেয়ে, নেচে আমি কিন্তু নতুন করে বাউল-ফকিরির আদি ধারাটাকে শহুরে পরিসরে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমার গুরুর পরামর্শেই এটা করেছি। কারণ, আমি যখন গান করতে এসেছি, তখন শহরের মঞ্চে বাউলগানের মধ্যে অর্কেস্ট্রার অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। একতারার আওয়াজটাই আমাদের গানের মূল আওয়াজ, সেখানে এত যন্ত্র কী করে থাকতে পারে!
আমাদের আলাপ পরে আরও এগিয়েছে। শান্তিনিকেতনে পার্বতীর জীবন, ছবি আঁকার ক্লাস, প্রথম বাউল দেখা, গুরুর দেখা পাওয়া, রেলের কামরায় পার্বতীর মাধুকরী, কেরলের জীবন… এই সব একসঙ্গে লিখে ফেলা সম্ভব নয়। এই গদ্যে ইতি টানবো পার্বতীর উদ্দেশে উপস্থিত ভক্তদের মধ্য থেকে উঠে আসা একটা প্রশ্নের উল্লেখ রেখে।
ওঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বাউল-ফকিরেরা তাঁদের গানে এই যে সহজ মানুষের কথা বলেন, সহজ মানুষ কে?
পার্বতী হেসে উত্তর দিলেন-
-সহজ মানুষ বড় কঠিন। একটা গান আছে, তার থেকে সহজ ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে, বেদ-বিধি পর সৃষ্টি ছাড়া, তারপরে সহজ শুরু। যেখানে বেদ-বিধি সব শেষ, সেখানে সহজের শুরু। তার মানে আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে ধরা সম্ভব নয়। যেখানে বিশাল অস্তিত্বের সঙ্গে আমাদের যোগ রয়েছে, সেটাই সহজ। অর্থাৎ ধরো, তুমি যে ঘরে বসে আছ, সেই ঘরটা যদি তুমি নিজেই হয়ে যাও, তাহলে তোমায় ঘর নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হবে না। ঘরে কোথায় কী আছে, তা-ও ভাবার দরকার নেই। বিশাল অস্তিত্বের সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব এক করে ফেলাটাই সহজ মানুষের কাজ।
ছবি: সৈয়দ অয়ন