ফিচার I রিমেম্বারিং মীনা
নারীর বেড়ে ওঠার আদর্শ মীনা নতুন করে হাজির হয়েছে ফ্যাশনে। সঙ্গে ডিজাইনের চমক
মীনা রাজু মিঠু- এই ট্রায়োকে কারও ভোলা সম্ভব নয় নিশ্চয়ই। নব্বইয়ের দশকের শিশুদের বেশির ভাগ সময় কাটতো মীনা-রাজুর মতো হতে চেয়ে। সেই দশক গত হয়েছে অনেক আগেই। সেই শিশুরা এখন তরুণ। কিন্তু ভুলে যায়নি তাদের ছেলেবেলা। চাওয়াটা খানিক ভিন্ন হলেও এখনো অনেক তরুণের সুপ্ত ইচ্ছে মীনা-রাজুর দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো। মীনা ফিকশনাল চরিত্র হয়েও এই উপমহাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সুস্থতা নিয়ে কাজ করে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। তার পেছনে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার ও ইউনিসেফ। মীনার আর্ট ডিরেকশনের দিকে একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, খুবই সাধারণ সে। তা সত্ত্বেও গভীর বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মীনার নির্মাতারা। গোলাপি টপস আর লাল স্কার্ট পরা মীনা মোটেও সাধারণ কেউ নয়। মীনা আমাদের শিখিয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতা। একই সঙ্গে মীনা বাঙালি ফেমিনিজমের পথিকৃৎ। গোলাপি রং প্রতিনিধিত্ব করে কোমলতা, স্নেহ, মায়া, মমতা। একই সঙ্গে রঙটি বাচ্চাদের খুব প্রিয়। লাল রঙ সাহসী মনোভাবের দ্যোতক। মীনা একই সঙ্গে কোমল ও সাহসী নারীর রূপক হয়ে থাকবে। বাঙালি ফ্যাশনে যুক্ত হলে ভিন্ন এক মাত্রা পায় এই চরিত্র। ছোট থেকে বেড়ে উঠতে উঠতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মাধ্যমে তার প্রভাব বেশি পড়েছে আমাদের মধ্যে। তাই মীনা থিম ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে, সেটা স্বাভাবিক। কিছুটা দেরিতে হলেও মীনা ফ্যাশন ভাবনায় জায়গা করে নিয়েছে; তবে কাজটা খুব সহজ ছিল না। মীনার সারল্য ও আটপৌরে ভাবকে একালের রঙের সঙ্গেও মেলানোটা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। এই কাজটাই করে দেখিয়েছেন তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা। মীনা থিমে তার লক্ষ্য চরিত্র ছাপিয়ে একক নারীবাদের প্রতীককে ফুটিয়ে তোলা- বিভিন্ন বর্ণে ও বিন্যাসে। এর জন্য তিনি ব্যবহার করেছেন কালোর সঙ্গে বেজ। সাদা-কালোর সঙ্গে বেজের কম্বিনেশনে অন্ধকার থেকে আলোয় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। নানা উজ্জ্বল রঙের সুষম বণ্টনের চেষ্টা করেছেন। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার অভিপ্রায় অপরিবর্তিত রেখে ফ্যাশন ডিজাইন করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। পূর্ণার ডিজাইনে ঐতিহ্যবাহী কাঁথা সেলাই, এমব্রয়ডারি ও বুনন ব্যবহার করা হয়েছে চমৎকারভাবে। আধুনিক ও রোম্যান্টিক ধারার উপজীব্য বিষয়গুলো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ফ্রিলগুলো কাপড়ের ডিজাইনে মীনা থিমকে করেছে আরও বেশি উজ্জ্বল। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, কালো ও সাদার কনট্রাস্ট ড্রেসে তুলে ধরেছেন সামাজিক বাইনারি, যেগুলো আধুনিক নারীবাদের আদর্শ ধারণ করে। আপসাইকেল তোয়ালেতে সারফেস এমবেলিশমেন্ট, এমব্রয়ডারি ডিজাইনকে দিয়েছে কোমলতা। পূর্ণার ডিজাইনের মূল উপজীব্য হলো এথিক্যাল ফ্যাশন ডিজাইনিং, যেটাতে রিসাইকেল ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয়। এথিক্যাল ফ্যাশন হলো এমন ধারা, যেখানে ডিজাইনগুলোর একটি সংস্কৃতি বা সমাজের একটি রীতি তুলে ধরা হয়। পূর্ণার ব্যবহার করা ম্যাটেরিয়ালগুলোও বেশ অর্থবহ। যেমন ধরা যাক, ডিজাইনের মূল ম্যাটেরিয়াল হলো সিল্ক। আর সিল্ক হলো প্রাকৃতিক সুতা। প্রকৃতির কাছ থেকে নিয়ে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলার মতো অসাধারণ আইডিয়া দেখা যায় তার ডিজাইনে।
সিল্কের পাশাপাশি তিনি ডিটেইল হিসেবে ব্যবহার করেছেন অব্যবহৃত তোয়ালের অংশ। ঝালর ও কুঁচিতে ব্যবহার করেছেন ঐতিহ্যবাহী সিল্ক। আপসাইকেল তোয়ালের সারফেস এমবেলিশমেন্টে তৈরি মীনা থিমের এই ড্রেস ফ্যাশনে নতুন এক মাইলফলক। রঙের ব্যবহারেও পূর্ণা এনেছেন বিশেষত্ব। ড্রেসের সাদা-কালো বাইনারি বৈপরীত্য ফুটিয়ে তোলে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, যেমন লিঙ্গবৈষম্য, শিশুশ্রম, কর্মবৈষম্য ইত্যাদি। পূর্ণা চেয়েছেন মীনা যেভাবে সমাজের অজ্ঞতা দূর করে, সেভাবে সমাজের বৈষম্য, অজ্ঞতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে সেগুলো বদলে ফেলার। বুনন-কৌশলের দিক থেকে মীনা থিম একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক। ব্যবহার করেছেন কাঁথাবুনন। এই প্রকাশরীতি স্মৃতিমগ্ন করে তোলে। প্রকৃতিপ্রেমের সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়ায় নিজের ফ্যাশন চিন্তা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী তার ডিজাইনের মাধ্যমে। রোম্যান্টিক ফ্যাশন পিরিয়ডের ধারা মীনা থিমে দারুণভাবে উপস্থাপিত। মীনা থিম শুধু ভিজ্যুয়াল শান্তি বা নতুন কিছু করার ভাবনা থেকে আসেনি। এসেছে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বুনন প্রক্রিয়া, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি ডিজাইনারের অনুরূপ প্রকাশের স্পৃহা থেকে। রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা মনে করেন, ফ্যাশন শুধু কমফোর্টকেই প্রাধান্য দেবে না, প্রাধান্য দেবে একটা সংস্কৃতিকে এবং তুলে ধরবে একটা জাতির ঐতিহ্যকে। মীনা থিমের এই ড্রেস মূলত এথিক্যাল কালেকশন। কাল্পনিক চরিত্র হলেও এ দেশের মানুষের মনে সচেতনতা ও আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করেছে সে। মীনাকে মেইনস্ট্রিম ফ্যাশন ধারায় তুলে এনে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করিয়ে দিতে চান পূর্ণা।
রিয়াজুল হাসান তূর্য
ছবি: মো. জুবায়ের হোসেন
মেকআপ: সাহিদুর রহমান
মডেল: কুহু নুসরাত, সাহিদুর রহমান, মায়িশা খন্দকার, তাফহীমা ইমু
ডিজাইনার: রোকাইয়া আহমেদ পূর্ণা