ফিচার I র্যাপ ইট আপ
সেকেলে বলে একে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই আজ। বরং ড্রেসটির ডিজাইনে যে বিচিত্র নিরীক্ষা চলছে, তাতে ফ্যাশনপ্রেমীদের মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে এর জগৎ
উদ্ভব এলসা শিয়াপারেলির হাত ধরে। বিকশিত হয় ডিয়ান ফন ফুরস্তেনবার্গের লালিত্যে। এরপর সময়ের সঙ্গে নানান ডিজাইনার এতে ঘটিয়েছেন বিচিত্র রূপায়ণ। সত্তরের দশকের আইকনিক ফ্যাশন আইটেম র্যাপ ড্রেসের বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন ফ্যাশনপ্রেমীদের আকর্ষণ করেছে বারবার। ভাবছেন, এটি একটি সেকেলে ফ্যাশন? তবে আপনার জন্য রয়েছে দারুণ চমক। তার আগে জেনে নেওয়া যাক এই পোশাকের আদ্যোপান্ত।
র্যাপ ড্রেস হলো সামনের দিকের কাপড় এক পাশ থেকে অন্য পাশে র্যাপ করে বা জড়িয়ে কিংবা কোমরের পেছনের দিকে বেঁধে নেওয়া, নয়তো বোতাম দিয়ে আটকানো। এই ফর্ম নেকলাইনে ভি শেপ তৈরি করে আর ভাঁজগুলো শরীর জড়িয়ে রাখে। এর সঙ্গে আরও জড়িয়ে আছে নারীমুক্তির দ্যোতনা, পরে যা পরিণত হয় আইকনিক ফ্যাশন আইটেমে। ফ্যাশনচেতা নারীর ওয়্যারড্রোবে ফ্যাশনের এই ক্লদিং আইটেম এক পিসও থাকবে না, এমনটি হবার নয়।
যদিও দাবি করা হয় মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের কস্টিউম ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যক্ষ ফুরস্তেনবার্গ এই র্যাপ ড্রেসের উদ্ভাবক। দাবিটি সঙ্গত নয়। কেননা প্রকৃত তথ্য এই যে, এটি ১৯৩০ সালে ডাকসাইটে ডিজাইনার এলসা শিয়াপারেলি উদ্ভাবন করেছিলেন।
ফুরস্তেনবার্গ ড্রেসটির উদ্ভাবক না হলেও এটিকে তিনি আরও নিখুঁত, স্টাইলিশ করে তুলেছেন। সমসাময়িক ফ্যাশনে এর সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি আসলে এই ডিজাইনটিতে স্বাতন্ত্র্য সঞ্চার করেছেন। তাই র্যাপ ড্রেস মানেই ফুরস্তেনবার্গ। ব্যক্তিজীবনে তিনি রাজকুমারী; আর শাব্দিক অর্থেই র্যাপ ড্রেসের রানি হয়েছেন প্রশংসনীয় স্টাইলে, নিজের ফ্যাশন রাজ্য তৈরি করে।
ফুরস্তেনবার্গের তৈরি র্যাপ ড্রেস ধারাবাহিকভাবে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা, আঁটসাঁট আর লন্বা হাতার। এটি এত জনপ্রিয় এবং অনন্য ছিল যে স্টাইলটির আরেক নাম ছিল ফুরস্তেনবার্গ। মূলত ফুরস্তেনবার্গের বিবাহবিচ্ছেদ তাঁকে এই ডিজাইনটিতে প্রবলভাবে আগ্রহী ও প্রাণিত করেছে। তিনি মনে করেন, ড্রেসটি নারীর মধ্যে যৌন স্বাধীনতা উপভোগ করার অনুভূতি জাগায়। তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সময়ও হুবারভিলেজ হাউজের সেই সব পোশাক জনপ্রিয় হয়েছিল, যেগুলোয় র্যাপ ডিজাইন ব্যবহৃত হয়েছিল।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি র্যাপ ড্রেস বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফর্মটি ফ্যাশনে এনে দেয় নতুন মাত্রা এবং এই সময়ের নারীমুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। নব্বইয়ের শেষ দিকে এটি ফের জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত ফুরস্তেনবার্গ সাতানব্বই সালে ডিজাইনটি নতুন করে আবার চালু করেন। অন্যদের পাশাপাশি তখন থেকে তিনি নতুন আঙ্গিকে ব্যাপকভাবে র্যাপ ড্রেসের ডিজাইন শুরু করেন। এর জনপ্রিয়তা এবং সঙ্গে পাওয়া নারীবাদী দ্যোতনার রেশ রয়ে গেছে এখনো।
স্টাইলটির জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি ফুরস্তেনবার্গের হাত ধরেই। তবে বিভিন্ন লেবেলের মাধ্যমে এতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা ও পরিবর্তন। ড্রেসের দৈর্ঘ্যর স্লিভের প্যাটার্নে নানাভাবে এতে নতুনত্ব এসেছে। আর ক্ল্যাসিক এই ডিজাইন বহু বছর ধরে নানান আঙ্গিকে ফ্যাশনপ্রেমীদের আকাক্সক্ষা ও চাহিদা পূরণ করে আসছে। কেননা এতে নারীর দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটে। তাদের মধ্যে লৈঙ্গিক মুক্তির আস্বাদ এনে দেয়।
ফুরস্তেনবার্গ শীত ও গ্রীষ্মের মধ্যে একটি ক্ল্যাসিক ব্রিজ তৈরি করেছেন ড্রেসের গড়নকে সময়ানুগ করার জন্য। ১৯৭৪ সালের দিকে তিনি ডিজাইন নিয়ে কাজ শুরু করার পর থেকেই খুব দ্রুত এটি নারীদের একটি মজার অফিস ইউনিফর্মে পরিণত হয়; ফলে বছরের ঠিক এই সময়ে ফ্যাশনে কী করা উচিত, তার জুতসই উপায় হয়ে ওঠে। আর জীবনের নিস্তেজ সময়কে প্রাণবন্ত করে তোলে।
শীত এসেছে। মানে এই নয় যে, পছন্দের পোশাকগুলো ওয়্যারড্রোবের কোণে পড়ে থাকবে। বরং খুঁজে নিন আকর্ষণীয় র্যাপ ড্রেস পরে নেওয়ার জুতসই কোনো উপায়। কেননা নিজেকে নতুন লুকে দেখানোর একটি যথাযথ চেষ্টা হতে পারে ডিজাইনটি। এবারকার এডিশনে যুক্ত হয়েছে কিছু মিষ্টি পোশাক; এগুলো সহজে পরা যায়; আর স্টাইলিশ কোমরবন্ধনী এই পোশাককে দিয়েছে অনন্যতা। ইউনিক ডিটেইল আর ফিগার ফ্ল্যাটারিং বৈশিষ্ট্যের জন্য যেকোনো স্টাইল ও বডিশেপে এটি মানিয়ে যায়। আইকনিক ব্র্যান্ড ফুরস্তেনবার্গ ও এলিস অ্যান্ড অলিভিয়ার এবার প্রিটি ফ্লোরাল প্রিন্ট, মেসি হেম ও স্যুসি স্লিভের (লং ন্যারো শেপ) র্যাপ ড্রেস নিয়ে এসেছে।
উদ্ভবের পর থেকেই ডিজাইনটির প্রতি আকর্ষণে কোনোকালেই ভাটা পড়েনি; বরং এটি অবস্থান করেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ আর ডিজাইনারদের নিরীক্ষা এর প্রতি আগ্রহ আরও উসকে দিচ্ছে। এই শীতেও তাই। ফুরস্তেনবার্গ ডিজাইনটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একে দিয়েছেন মডার্ন কাট ও কালার প্রিন্ট। তবে এখনকার র্যাপ ড্রেস মূল ডিজাইনের চেয়ে বেশি সুবিন্যস্ত। কয়েক বছর ধরে ড্রেসটি আবার বেশ কিছু ব্র্যান্ডের কালেকশনে যুক্ত হয়েছে। গেল বছর উইন্টার শোগুলোর দিকে তাকালেই তা প্রতীয়মান হয়। আবার গত বছরের স্প্রিং-সামার শোতেও এর লক্ষ্যযোগ্য প্রভাব ছিল। শীতের সময়ও দ্বিধাহীনভাবে পরে ফেলা যায় রেট্রো ও অত্যাধুনিক এই ডিজাইন, যে কারোর জন্য যা মানানসই। সঠিক ফ্যাব্রিক বেছে নিলেই হলো।
যদিও র্যাপ ড্রেস একটি ইউনিফর্ম স্টাইল- ভি নেক, র্যাপ ওভার বডিস এবং আঁটো কোমরের ড্রেস, আসলে এটি বিচিত্রতায় পূর্ণ একটি পোশাক। আরেকটি বিষয় হলো, র্যাপ বা মোড়ানো বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি বেশ আরামদায়ক, শীতের জন্য জুতসই ও বটে। অ্যাক্সেনচুয়েট ওয়েস্ট আর ডিপ নেকলাইন এতে যোগ করে নারীত্বের বাড়তি অনুভূতি। একে পূর্ণতা দেয় এক জোড়া সিম্পল বাটন। ক্ল্যাসিক স্টাইলের সুপরিমিত হওয়ায় যেকোনো উপায়ে এটি পরে নিজেকে র্যাপড করে নেওয়া যায়। এই সিজনে ড্রেসটি পরার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো উষ্ণ কাপড় আর লং স্লিভ স্টাইল বেছে নেওয়া। তাতে হয়ে ওঠা যায় এই সময়ের ফ্যাশনেবল।
এবারকার ফল উইন্টার শোগুলোতেও ছিল র্যাপ ড্রেসের অনবদ্য উপস্থাপনা। প্রিন্ট, প্যাটার্ন, ফ্যাব্রিক আর লেন্থে এক্সপেরিমেন্ট ছিল বেশি। যেমন এলিজা জের ক্ল্যাসিক ফ্লোরাল প্যাটার্নে মডার্ন হেমের র্যাপ ড্রেসটি বেশ বিলাসব্যঞ্জক ও ব্যয়বহুল দেখায়। বেল্টওয়ালা কোমর ও ডিপ ভি নেকের স্টাইলিশ ড্রেসটি টাইমলেস র্যাপ ড্রেসের একটি অনন্য উদাহরণ। বেলমাইন নিয়ে এসেছে সমকালীন প্রফেশনাল লুকের জন্য জুতসই পোশাক। তির্যক কাঁধ ও ক্ল্যাসিক ভি নেকবিশিষ্ট ড্রেসটির কোমরের কাছে তিনটি সোনার বোতাম একে দিয়েছে আভিজাত্যের স্পর্শ।
এ ছাড়া লং স্লিভের সঙ্গে শর্ট লেন্থ, মিড লেন্থ, প্যারালাল লাইনের প্রগাঢ় টোন, রিফাইন্ড ব্ল্যাক, ভেলভেটের লম্বা লেন্থের ড্রেস, ভেতরের দিকে ফোল্ড করা সফট প্লেটিং ডিটেইলে ডিজাইন, প্লিট-লাইক লুক তৈরির জন্য সফট ভার্টিক্যাল স্ট্রাইপড- বিচিত্র নিরীক্ষার র্যাপ ড্রেস নিয়ে র্যাম্পে হাজির হয়েছিলেন নামকরা সব ডিজাইনার। সুতরাং সেকেলে ডিজাইন বলে এই ক্ল্যাসিক ড্রেসকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনো সুযোগই নেই।
তাসমিন আহমেদ
মডেল: তৃণ ও সূর্য
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সিকোসো
ছবি: সৈয়দ অয়ন