আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়, কিন্তু আধুনিক সভ্যতার সভ্য হয়ে ওঠার বয়স আরও কম। কেননা, আধুনিক হয়ে ওঠা সভ্যতার ইতিহাস কাটাছেঁড়া করলে দেখা যায়, তারও রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছে ঘৃণা, বিদ্বেষ, আধিপত্য আর নিপীড়নের বহু ঘটনা, যা ইতিহাসের মাঝে ক্ষতচিহ্ন হয়ে আছে! শ্রেণিবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, ভাষাগত নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ ইত্যাদি নানা ব্যাধিতে জর্জরিত হয়েছে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকেনি। ইতিহাসের অগ্রগতি জারি রয়েছে। আর এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছেন এমন এমন কিছু ব্যক্তিত্ব, যারা আধুনিক ইতিহাসের চাকাকে পেছনে যেতে দেননি, এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষের নেতা এবং সে দেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁদেরই একজন।
ইতিহাসের বিভিন্ন যুগপুরুষ বর্ণবিভাজনের অবসান ঘটিয়ে প্রিমিটিভ ডেমোক্রেসি ও সামাজিক ন্যায়ের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিলেন, তবু শোষকের আধিপত্যবাদের মনোভাব থেকে বারবার শোষণ, বন্ধনার অভিশাপ বারবার প্রকট হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। এমনকি আধুনিক সময়েও আদিম সেই বর্ণবাদী সমাজব্যবস্থার অভিশাপ বারবার মাথাচাড়া দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের ওপর শ্বেতাঙ্গের নিপীড়নের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়গুলো তারই নিদর্শন, কালো মানুষের আত্মমর্যাদা ও অধিকার অর্জনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে প্রায় আঠাশ বছর আট ফুট বাই সাত ফুট কারাগারের অন্তরালে ম্যান্ডেলার বন্দিজীবন সেই অভিশপ্ত সময়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যদিও তাঁর সংগ্রামের কাছে হার মেনেছিল বর্ণবিদ্বেষী রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা। যেভাবে শ্রেণিবৈষ্যমের অবসান ঘটিয়ে একদিন রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের সুবিশাল ভূখণ্ডে সমাজতন্ত্রের জয়ধ্বজা উড়িয়ে ছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। ম্যান্ডেলার জন্মশতবর্ষের তাঁর স্মৃতিচারণা ও তাঁকে ঘিরে নানা আলাপে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে কালো মানুষের, শূদ্রের অধিকার ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নগুলো। তাঁর ছায়া পড়ে আছে আজকের মানবাধিকার ও সমানাধিকারে আন্দোলনে।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফিকায় বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সব বহুত্ববাদী বহুবর্ণভিত্তিক গণতন্ত্র প্রচলন করেন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৪ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন কিন্তু তার আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষের ওপর শ্বেতাঙ্গদের যে ভয়াবহ অত্যাচার, সন্ত্রাস আর তার বিরোধিতায় ম্যান্ডেলাদের ওপর নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, জীবনের সুদীর্ঘ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছিল কারাগারের এক ফালি একটা সেলে। এমনকি নিজের পথদুর্ঘটনায় তাঁর পুত্রের মৃত্যু ও তার এক বছর বাদেই নিজের মায়ের মৃত্যুর পরেও একবারের জন্যও জেল থেকে প্যারোলেও ছাড়া পাননি ম্যান্ডেলা। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশের মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর থেকে রাজনৈতিক প্রেরণা পান ম্যান্ডেলা, কিন্তু হিংস্র বর্ণবাদী ব্যবস্থার অবসানে অহিংসার পথ কৌশল হিসেবে যে ততটাও কার্যকরী নয়, তা অনুভব করে সশস্ত্র রাজনৈতিক গেরিলা সংগঠনের নেতৃত্বও গ্রহণ করেছিলেন ম্যান্ডেলা।
এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই নেলসন ম্যান্ডেলার কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজপরিবারের কাউন্সিলর ছিলেন তাঁর বাবা। নিজ গোত্রের মধ্যে ম্যান্ডেলা ‘মাদিবা’ নামে পরিচিত। শৈশব কাটে নানার বাড়িতে। তাঁর পরিবারের তিনিই প্রথম স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর নামের সঙ্গে ‘নেলসন’ শব্দটি যুক্ত হয়। হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস কোর্সে ভর্তি হন ম্যান্ডেলা। সেখানে তাঁর পরিচয় হয় অলিভার টাম্বোর সঙ্গে। নেলসন ম্যান্ডেলার সারা জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন টাম্বো। তাঁর আরও একজন খুব কাছের বন্ধু ছিলেন ট্রান্সকেইয়ের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার (কে ডি) মাটানজিমা। বন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরেই বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ম্যান্ডেলা। কিছুদিন জোহানেসবার্গের একটি খনিতে প্রহরী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু কিছুদিনেরই মধ্যেই সেখান থেকে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়। পরে আরও কিছুদিন আইনি প্রতিষ্ঠানে কেরানির কাজে তিনি যুক্ত হন। ওই সময়েই ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ম্যান্ডেলা। এরপর ইউনিভার্সিটি অব ফোর্ট হেয়ার আর ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। জোহানেসবার্গে বেশ কিছুদিন আইনজীবী হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয় দক্ষিণপন্থী বর্ণবাদী দল ন্যাশনাল পার্টি। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের প্রবল উত্থান হয়। বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে বেশি দিন আস্থা রাখতে পারেননি ম্যান্ডেলা। একসময় মার্ক্সবাদের প্রতিও আকৃষ্ট হন তিনি। ১৯৫৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টিতে গোপনে যোগদান করেন। কারণ, ওই দল সেই সময় নিষিদ্ধ ছিল। এই ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলা চলে ৫ বছর ধরে। কিন্তু শেষমেশ ধৃত প্রত্যেক আসামিই নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৬১ সালে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মিলিটারি উইং ‘উই সিযওয়ে (এম কে)’র নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এই সংগঠন বর্ণবাদী সরকার ও রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার আত্মঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। কিন্তু সরকারের মনোভাবের এতেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাই গেরিলাযুদ্ধের পরিকল্পনা শুরু করেন ম্যান্ডেলা। নিজের সংগঠনের জন্য বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ আর সামরিক প্রশিক্ষণের কাজও তিনি শুরু করেন। প্রায় ১৭ মাস ফেরারি থাকেন তিনি। কুখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সহায়তায় তাঁকে গ্রেফতার করে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার। বেআইনিভাবে দেশের বাইরে যাওয়া শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৬২ সালের ২৫ অক্টোবর ৫ বছরের কারাদণ্ড হয় ম্যান্ডেলার। এএনসির গেরিলা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৬৪ সালের ১১ জুন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ঘোষণা হয়। রবেন দ্বীপে শুরু হয় কারাবাস। ২৭ বছরের মধ্যে সেখানেই তিনি কাটিয়েছেন টানা ১৮ বছর। কারাগারে থাকাকালীন বিশ্বব্যাপী তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। কারাগারের অন্তরাল থেকেই ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় পড়াশোনা শুরু করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৮১ সালে তাকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনে তিনি প্রিন্সেস অ্যানের কাছে পরাজিত হন। গোটা বিশ্বের চাপের মুখে পড়ে ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসসহ বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। মুক্তিকামী জনতার নেতা ম্যান্ডেলার কারামুক্তির কথাও ঘোষণা করা হয়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি মুক্ত হন ম্যান্ডেল্লা। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন এএনসির। এরপর বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর জন্য সরকারের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসেন। সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়। আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ক্লার্ক ও নেলসন ম্যান্ডেলাকে ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষ সমস্ত মানুষ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেলসন ম্যান্ডেলা। ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর নিজের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যান্ডেলার হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল। যার জেরে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি ছুটে এসেছিলেন ঢাকায়।
ম্যান্ডেলা আজও মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। আজও নানা জায়গায় বর্ণবিদ্বেষমূলক হিংসার ঘটনা ঘটছে। ভারতের উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো জায়গাগুলোতে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী হামলা চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও নিম্নবর্ণের মানুষ আর খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। পাকিস্তানের অনেক জায়গাতেও সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের একই চিত্র। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়ন ও গণহত্যার কথা তো আজ সারা বিশ্বই জানে। ইউরোপ, আমেরিকাতেও সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে। এই অবস্থার শান্তিপূর্ণ মোকাবিলার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে ম্যান্ডেলার জীবন, ভাবনা ও মতাদর্শ নতুন পথ দেখাতে পারে।