লিভিং লিজেন্ড অভিনেতার ওপর নির্মিত বায়োপিকও উপমহাদেশের লিজেন্ডারি সিনেমার তালিকায় চলে যেতে পারে। ‘সাঞ্জু’র ব্যাপারে দর্শকদের আগ্রহ, উন্মাদনা ও গণমাধ্যমে চর্চা-আলোচনা থেকে এমনটা মনে হতেই পারে। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার বেশ কিছু আগে থেকেই ছবিটি ঘিরে আলাপ-আলোচনা চলছে নানা মহলে। ট্রেলার/টিজার রিলিজের পর এই আগ্রহ আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। একটি দৃশ্য নিয়ে তৈরি হয় বিতর্কও, এ সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে ছবি মুক্তি পেয়েছে। বিশ্বকাপের মাঝে এই ছবি রিলিজের পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের উপস্থিতি ছিল প্রবল।
বলিউডের পরিচালক রাজকুমার হিরানি এর আগে আরও কয়েকটি বায়োপিক নির্মাণ করেছেন। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, ‘সাঞ্জু’র জনপ্রিয়তা আগের সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে। সঞ্জয় দত্তের জীবনের ওপর এই বায়োপিকের জনপ্রিয়তার মূলে অবশ্য রয়েছে বাস্তব জীবনের সাঞ্জুবাবা বা সঞ্জয় দত্তের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। তবে রিয়েল টাইম-স্পেসের ব্যক্তি মানুষ সঞ্জয় দত্তের ব্যক্তিজীবন বা রিয়েল লাইফ, রুপালি পর্দার রিয়েল-লাইফ, ঝঞ্ঝাপূর্ণ সামাজিক জীবন ইত্যাদি সবকিছুকে এক সূত্রে বায়োপিকের ফিল্ম-রিলে যখন নিয়ে আসা হয়েছে, তখন রণবীর কাপুর যেভাবে সঞ্জয় হয়ে উঠেছেন, সেই হয়ে ওঠার কলাকর্মই এই ছবির সাফল্যের চাবিকাঠি।
অর্থাৎ চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, সম্পাদনা, শব্দ সংযোজনা ও সঙ্গীতের মতো সিনেমার মূলগত উপাদানগুলোর থেকেও এ ছবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে ছবিটির কস্টিউম, মেকআপ ও হেয়ারস্টাইল। আর অভিনয় তো রয়েছেই। শুধু সঞ্জয় দত্তের জীবন নয়, তার ওপর বায়োপিক করতে গিয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই এই ছবিতে ফুটে উঠেছে সঞ্জয়ের বাবা অভিনেতা সুনীল দত্ত, প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও সঞ্জয়ের মা নার্গিস, তৃতীয় স্ত্রী মান্যতা ও প্রথম প্রেম রুবির মতো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রও। এসব বাস্তব চরিত্র অত্যন্ত ডিটেইলে রিল লাইফে পুনর্নির্মিত হয়েছে।
এই ছবিতে ফুটে উঠেছে অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত। মুম্বাই বিস্ফোরণে পাকেচক্রে তাঁর নাম জড়িয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে মাদকাসক্তিসহ জীবনের নানা উত্থান-পতনের গল্প রয়েছে এই ছবিতে। রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ব্যক্তিগত রঙিন ও ধূসর নানা মুহূর্ত। বাবার (অভিনয়- পরেশ রাওয়াল সঙ্গে সাঞ্জুর গভীর সম্পর্ক), নানা সুখ ও সাফল্যের সময়, কখনো গভীর খাদে তলিয়ে যেতে ফের কোনোক্রমে জীবনের মূল স্রোতে ফেরা ইত্যাদি নানা কিছুতে সঞ্জয় দত্তের জীবনের মতোই ‘সাঞ্জু’কে বহু রঙে রাঙিয়ে তুলতে পেরেছেন রাজকুমার হীরানি।
সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সুপারস্টার সঞ্জয়ের জীবনের রঙিন অধ্যায় অথবা সময়ের কারাগারের ধূসর যাপন, সাঞ্জু বাবা কিংবা মুন্না ভাইয়ের রিয়েল ও রিলের এই পিক্টোরিয়াল বায়োগ্রাফি বা বায়োপিক। সিনেমা জগতে সঞ্জয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধুতার চোখ দিয়ে ‘সাঞ্জু’তে সঞ্জু বাবাকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন রাজকুমার হীরানি। সাঞ্জু চরিত্রে রণবীর কাপুর, বাবা (সুনীল দত্ত) চরিত্রে পরেশ রাওয়ালের অভিনয় ছাড়াও এ ছবিতে মায়ের চরিত্রের অভিনেত্রী মনীষা কৈরালার অভিনয় বহুদিন মনে থাকবে দর্শকের। সঞ্জয়ের তৃতীয় স্ত্রী মান্যতার চরিত্রে দিয়া মির্জার অভিনয়ও গুরুত্বপূর্ণ। রুবির চরিত্রে সোনম কাপুরও সুন্দর। কমলেশ চরিত্রে ভিকি কৌশালও দারুণ।
তবে এ ছবিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়কলাকে আরও মূর্ত করে তুলেছে এ ছবির মেকআপ, কস্টিউম ও হেয়ারস্টাইল। রূপসজ্জা শিল্পী বিক্রম গাইকোয়াড়ের নেতৃত্বে সঞ্জয়ের রিল ও রিয়েল জীবনকে এই ছবিতে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন মেকআপ আর্টিস্টরা। সাঞ্জু ছাড়াও অন্য চরিত্রগুলোকে চলচ্চিত্রে বাস্তব করে তুলতে রূপসজ্জাশিল্পী বিক্রম গাইকোয়াড়, গ্যাব্রিয়েল জর্জিউ, কিমভারলে লিভার ও ক্লোভার উটনের অবদান অনস্বীকার্য। সঞ্জয়ের মা একসময়ের গ্ল্যামার কুইন নার্গিস চরিত্রটিকে হুবহু ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মনীষা কৈরালার রূপসজ্জায়। এ ছবিতে দিয়া মির্জা, সোনম কাপুর ও অনুষ্কার হেয়ারস্টাইলেও তাঁদেরই মূল অবদান।
রণবীর কাপুরকে সঞ্জুবাবা বা মুন্নাভাই সাঞ্জু করে তুলতে অনেকটা অবদান যাঁর- হেয়ারস্টাইলিস্ট আলিম হাকিম। সঞ্জয়ের মতো হাবভাব, কথাবার্তা থেকে চুলে হেয়ারস্টাইল- এই সবকিছুকেই নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে কম কসরত করেননি অভিনেতা রণবীর কাপুর। সঞ্জয়ের শৈশব-কৈশোরের কথা বাদ দিলে যৌবন থেকে মধ্যবয়সের দীর্ঘকাল পর্বে রণবীরকে এ ছবিতে দেখা গেছে। দীর্ঘ এই সময়ে সঞ্জয় দত্তের ফ্যাশন, হেয়ারস্টাইল ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা সময়েই এসেছে বাঁকবদল। হেয়ারস্টাইলের পরিবর্তনে এসেছে বহ পরিবর্তন। তাঁর জীবনের নানা সময়ের নানা ছবির উদাহরণ এ ক্ষেত্রে দেওয়া যায়। তাঁর প্রথম যৌবনের ‘রকি’ ছবিতে এ রকমের ছোট চুল, তো আরও বেশ কিছুটা পরের ছবি ‘খলনায়ক’-এর সময় কাঁধ অবধি লম্বা চুলের সঞ্জয়ের মধ্যে ফারাক অনেকটাই। আবার কয়েক বছর আগের সুপারহিট ছবি ‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’-এ নতুন সময়ের মেট্রো সেক্সুয়ালিটির নতুন শরীরী ভাষার ব্যবহারে হেয়ারস্টাইলে ফের বদল এনেছেন সঞ্জয়।
চুলের ক্ষেত্রে এই বদলকে রণবীর তাঁর চেহারায় ফুটিয়ে তুলেছেন। আর এই ফুটিয়ে তোলার পেছনের কারিগর মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত হেয়ারস্টাইলিস্ট আলিম হাকিম। এই হেয়ারস্টাইলিস্ট মুম্বাইয়ের নানান বিখ্যাত অভিনেতার কেশসজ্জার সঙ্গে যুক্ত। হালিম হাকিমের বাবা হাকিম কৈরানাভির হাতে সঞ্জয়ের শুরু দিকের হেয়ারস্টাইল শুরু। সুনীল দত্তের কেশসজ্জাও তাঁর হাতে। ‘রকি’ ছবিতে যে সঞ্জয় দত্তকে আমরা দেখতে পাই, তাঁর হেয়ারস্টাইলও হাকিম কৈরানাভির হাতে। পরে তাঁর ছেলে আলিম হাকিম সঞ্জয়কে কেশসজ্জায় সাজিয়ে আসছেন। তো এই আলিম হাকিমের কাছে সঞ্জয়ের নানা পর্বের কেশসজ্জায় এ ছবিতে নিজেকে পারফেক্ট ‘সাঞ্জু করে তুলেছেন রণবীর কাপুর। আলিম হাকিম জানাচ্ছেন, এই ছবিতে কেশসজ্জার নিরিখে প্রায় ১২ রকম লুকে দেখা গেছে রণবীরকে। সল্ট অ্যান্ড পেপারস্টাইল, বন্ড মোহক, পাঙ্ক হেয়ার কাট, মিডিয়াম থেকে শর্ট মেসি বব, সামনে এবং সাইডে শর্ট, পেছনে লং হেয়ারস্টাইলে এ ছবিতে সাঞ্জু চরিত্রে রণবীর কাপুর আসলেই সঞ্জয় দত্ত।
নার্গিসের চরিত্রে মনীষা কৈরালার হেয়ারস্টাইলের পেছনে মূল অবদান এ ছবির মেকআপ অ্যান্ড কস্টিউম বিভাগের। উপযুক্ত মেকআপের পাশাপাশি লম্বা বিনুনি থেকে শ্যাগ, শর্ট শ্যাগে কখনো গ্ল্যামার কুইন নার্গিসের চরিত্রটি মনীষার মাধ্যমে হয়ে উঠেছে মায়াময়, কখনোবা মোহময়ী। শর্ট শ্যাগ হেয়ারস্টাইলে রুবি চরিত্রে সোনম কাপুরও অনবদ্য। মান্যতা চরিত্রে পেছনে হালকা করে খোঁপা, সামনে দুপাশে অল্প ছড়িয়ে পড়া কোঁকড়া চুল বা হেয়ার বান উইথ লুজ কার্লিতে দিয়ার লাস্যময়ী রূপ দেখার মতো।
এবার আসা যাক কস্টিউম প্রসঙ্গে। এ ছবির বিনয়ী কস্টিউম ডিজাইনারের এক্যা লাখানির বক্তব্য, এই ছবিতে রণবীরের সাঞ্জু হয়ে ওঠার সাফল্যের পেছনে স্বয়ং রণবীরের অবদান ৪০ শতাংশ, রাজু স্যার অর্থাৎ রাজকুমার হীরানির অবদান ৪০ শতাংশ, আর বাকি ২০ শতাংশ অবদান কস্টিউম, মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলের। কাবলি/শেরওয়ানি, ফরমাল শার্ট অ্যান্ড প্যান্ট, ব্লেজার-টাই, ক্যাজুয়াল শার্ট, টি-শার্ট, মাল্টিকালারড টি-শার্ট, জিনস, নেতা পাঞ্জাবি, জ্যাকেটসহ নানা পোশাকে দেখা গেছে রণবীরকে। মুড ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সাঞ্জু চরিত্রে রণবীরের জন্য লাখানি যেসব কস্টিউম নির্বাচন করেছেন, তা রিয়াল অথবা রিল লাইফের বহুবিচিত্র অধ্যায়ের সঞ্জয়ের যাপনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অফ হোয়াইট, হোয়াইট ও হালকা রঙের শাড়ি, সালোয়ার, গাউনের মতো পোশাকে নার্গিস চরিত্রে মনীষা অনন্যা। রুবির উচ্ছ্বাস, প্রাণচাঞ্চল্য ধরতে ডেনিম ওভ্যারলসে সোনম কাপুর দারুণ। সঞ্জয়ের জীবনের একান্ত সঙ্গী ব্যক্তিত্বময়ী মান্যতার চরিত্রে দিয়া মির্জাকে দারুণভাবে মানিয়েছে টম অ্যান্ড গাউনে। মনীষা ও দিয়ার জন্য অলঙ্কার নির্বাচনও দারুণভাবে সফল। কস্টিউমের দিক থেকে সব কটি চরিত্রই সফল।
এ ছবিতে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট ফুটে উঠছে। ‘সাঞ্জু’কে ঘিরেই বলিউডি ফিল্মের ইতিহাসে কস্টিউম, মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলের বিবর্তন সম্পর্কে ভালোমতো ধারণা পাওয়া যাবে। কেননা সাদাকালো সিনেমা থেকে রঙিন ও ক্রমে ডিজিটাল হয়ে ওঠা সিনেমার রূপকল্পের অতীত, অগ্রগতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে সময়ের চালচিত্র বানিয়ে রেখেছে ‘সাঞ্জু’।
– অতনু সিংহ