রাজধানীর ধানমন্ডির ইএমকে সেন্টারে চলছে চিত্রশিল্পী সুবর্না মোর্শেদার তৃতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী ‘অন্বেষণ’। এই এক্সিবিশনে লিথোগ্রাফ, সায়ানোটাইপ, পেন্সিল স্কেচ, জলরং-সহ বিভিন্ন মাধ্যমের ৪২টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে।
গত ১৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্ট ফ্যাকাল্টির ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগের প্রফেসর জামাল আহমেদ, প্রিন্টমেকিং বিভাগের প্রফেসর আনিসুজ্জামান এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ‘মনের বন্ধু’র প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তাওহিদা শিরোপা এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। কিউরেট করেছেন রেজাউর রহমান।
প্রদর্শনী প্রসঙ্গে চিত্রশিল্পী সুবর্না মোর্শেদা ‘ক্যানভাস’ ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘অন্বেষণ মানে তো খোঁজ। এই খোঁজ হলো আত্ম-অন্বেষণ। নিজেকে খোঁজার যে তাগিদ, আমার মধ্যে সেটা সবসময়ই কাজ করে। এই তাগিদ থেকেই আমার কাজের শুরু বলা যেতে পারে। সবসময় মনে হয়, নিজেকে খোঁজার চেয়ে কঠিন কিছু নাই। গত দুই বছরে সেই খোঁজার তাগিদ আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। এই সময়ে অন্যদের সঙ্গে যখন কথা বলেছি, তার মাঝেও নিজেকেই খোঁজার চেষ্টা চলত।’
‘লকডাউনের বেশ আগে থেকেই নিজেকে অনেক বেশি আইসোলেশনে নিয়ে যাই আমি– একটা নিরঙ্কুশ একাকীত্বের মধ্যে চলে আত্ম-অনুসন্ধানের কাজ। তাই লকডাউন আমার জন্য খুব নতুন কিছু ছিল না। শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গে নতুন করে থাকাটা ছিল একেবারে নতুন,’ যোগ করেন তিনি।
নিজের অন্তরমহলে ডুব দিয়ে এই চিত্রশিল্পী বলেন, ‘২০১৯ সালের একটা সময় আমি খুব অন্ধকারে ডুবে যাই। স্বভাবগত দিক থেকে রঙিন মানুষ হয়েও একটা গভীর ব্যক্তিগত কারণে আমার জীবন হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ সাদা-কালো। আর এ সময়টাতেই নিভৃতে অনেকগুলো কাজ করে ফেলি। কখনো লিথোগ্রাফ, কখনো পেন্সিল স্কেচ আর কাগজে সেলাই করে করা এ কাজগুলোই আমাকে সেই গভীর অন্ধকারেও বেঁচে থাকার প্রেরণা যুগিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কাগজে সেলাই করে শিল্পকর্ম নির্মাণের একটা আলাদা আনন্দ আছে। সেটা হলো স্পর্শের আনন্দ। এই স্পর্শকে কেমন করে দেখাব! সেলাইয়ের উঁচু-নিচু অংশগুলোকে আমি বলি স্পর্শের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে স্পর্শের অনুভূতিকে অন্যের মনে সঞ্চার করা যায়।’
‘বড় হওয়ার পর, জীবনে এই প্রথম আমি মায়ের সাথে বাবার সাথে এত দীর্ঘ সময় কাটানোর অবকাশ পেয়েছি। আমার মায়ের গাছ লাগানোর শখ অনেক আগে থেকেই। সেই শখ লকডাউনে আরো তীব্র হলো। তাঁর লাগানো গাছগুলো যত বড় হচ্ছিল, তাঁর বয়স যেন ততই কমছিল। গাছে ফল ধরা, ফুল ধরা দেখে তাঁর কী যে এক আনন্দ! সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব অনুভূতি! তো, আমি তাঁকে একজন সফল চাষী হিসেবে ঘোষণা করলাম,’ বলেন সুবর্না।
আরো বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি গন্ধ, স্পর্শ নিয়ে কাজ করি। এবার মায়ের গন্ধের সঙ্গে যোগ হলো মায়ের বাগানের গন্ধ-স্পর্শ। গাছগুলোর পাতা যখন ঝরে পড়ে, সে-পাতার রং, শেইপকে আমার কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করা আর স্পর্শগুলোকে ধরার জন্যই আমার কাগজে সেলাই করার কাজ। আমার ঘুমের সমস্যা আছে। রাতে ঘুম হয় না বা হতো না সেই অন্ধকার সময়গুলোতে। ঘুম না হওয়ার কারণে যে সকালে খারাপ লাগত, তা-ও না। সকালের গন্ধ আমার খুব প্রিয়।’
সুবর্না বলেন, ‘এরমধ্যেই হলো মায়ের করোনা। দীর্ঘ ১ মাস ধরে মায়ের সিরিয়াস কন্ডিশন । আমি বুঝতে পারতাম, গাছগুলোও মাকে খুব মিস করছে। এদিকে মা তো হসপিটালে অক্সিজেন নিতে ব্যস্ত! ২৪ ঘণ্টাই মায়ের সঙ্গে থাকি। তাঁর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া– কখনও ভালো, কখনও মন্দ। অবশেষে মায়ের জয়ী হয়ে ঘরে ফেরা। তাঁর সঙ্গে আবার তাঁর গাছেদের সেই নিবিড় সম্পর্ক– গভীর বন্ধুত্ব! পুরো সময়টাই যেন কবিতার মতো, প্রেমের কবিতা! আমার সাদা-কালো ক্যানভাসে ছড়িয়ে দেওয়া রঙের মতো! অন্ধকারে অপরূপ আলোর মতো! আমার ছবিগুলো যেন জীবনের মতো! আমার জীবন যেন আমার ছবির মতো!’
সেই কবিতা, সেই আত্ম-অন্বেষণের বিবিধ প্রকাশে সাজা চিত্রকর্মগুলো নিয়ে এই প্রদর্শনী চলবে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময়কালে শুক্রবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এটি সবার জন্য উন্মুক্ত।