ফিচার I স্বর্ণ মানেই সঞ্চয় – কাজী সিরাজুল ইসলাম
আমিন জুয়েলার্সের কর্ণধার তিনি। সাবেক সাংসদও। ষাটের দশক থেকেই স্বর্ণালংকারের ব্যবসা করে আসছেন সুনামের সঙ্গে। ক্যানভাসের সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপচারিতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অতনু সিংহ
ক্যানভাস: আমরা জানি, আপনি আইন এবং বাণিজ্য-বিপণন (কমার্স অ্যান্ড মার্কেটিং) বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর চাকরি করেছেন। তো এসব ছেড়ে হঠাৎ স্বর্ণালংকারের ব্যাপারে কীভাবে আগ্রহ তৈরি হলো?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আমরা আসলে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ। আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায় আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের গড়ানিয়া গ্রামে। আমি স্বর্ণালংকারের ব্যবসা করব, ভাবিনি। ঢাকায় এই ব্যবসা এত প্রসারিত হবে- এসব ভাবতে পারা তো দূরের কথা, সেভাবে এত সোনা কখনো দেখিনি। আমার বিয়ে হয়েছিল এ শহরে। শ্বশুরের এক বন্ধুর সুবাদে ব্যাংকে চাকরি পাই। এর আগে করাচিতে কিছুদিন চাকরি করি মিনিস্ট্রি অব হেলথের অধীনে। আইন নিয়ে পড়াশোনা করলেও কখনো আইন ব্যবসায় যাইনি। ঢাকায় যখন চাকরি পাই, তখন আমার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ২৫০ টাকা। আমার এক খালাশ্বশুর তখন স্বর্ণের ব্যবসা করতেন। সেখানে গিয়েই স্বর্ণবাণিজ্য চোখের সামনে থেকে দেখি। তার আগে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। ব্যাংকে তখন আমার মাসিক বেতন ১২০০ টাকা। একদিন খালাশ্বশুর বললেন, এই বেতনের চাকরি করে কী করবে, তার চেয়ে স্বর্ণের ব্যবসা করো। মাত্র ৫ ভরি সোনা সম্বল করে গ্রামেই একটা দোকান দিয়েছিলাম। আমার শাশুড়ি আমাকে এক শ ভরি সোনা দিলেন দোকানে সাজিয়ে রাখার জন্য (বিক্রি করতে নয়), যাতে ওগুলো দেখে ক্রেতাদের পছন্দমতো নতুন গয়না বানিয়ে দেওয়া যায়। ওই স্বর্ণ দোকানে ডিসপ্লে করে ব্যবসা শুরু হলো। দুই বছর পরে ফেরত দিয়েছিলাম। ১৯৬৬ সালে আমার এই স্বর্ণব্যবসা শুরু।
ক্যানভাস: এভাবে তো শুরু করলেন। বলছিলেন, তার আগে স্বর্ণের বিষয়ে আপনার কোনো ধারণা ছিল না। তাহলে স্বর্ণের অলংকারের ডিজাইনের ক্ষেত্রে কীভাবে ধারণা তৈরি হলো? ব্যবসার শুরুতে অলংকারের নকশা করতেন কীভাবে?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: অলংকারের নকশার বিষয়ে ক্রেডিট পুরোপুরি আমার কারিগরদের। এখনো এই বিষয়টা এরাই দেখেন। যদিও তারা আমাকে বিভিন্ন ডিজাইনের ছবি দেখান, আমি পছন্দ করে দিই, সেই মতো বানানো হয়। একটা ব্যাপার ঠিক যে ইন্ডিয়ায় জুয়েলারির ডিজাইনের জন্য বিশেষ শিল্পী রয়েছেন, জুয়েলারি ডিজাইনিংয়ের আলাদা স্কুল রয়েছে, কিন্তু আমাদের এখানে সেসব কিছুই নেই। কখনো হয়তো হবে। কিন্তু এখনো ইন্ডিয়ান ডিজাইনকেই আমরা অনুসরণ করি। তবে এটাও ঠিক, আমাদের এখানে তো অনেক আগে আর্ট স্কুল ছিল না। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ বিশ্বের মধ্যে নামকরা। আমাদের এখানে ফিল্ম স্কুল ছিল না, এখন হয়েছে। তাই আশা রাখি, কখনো হয়তো জুয়েলারি ডিজাইনের স্কুলও হবে।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে আপনার প্রতিষ্ঠান কি এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেবে?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: এটা নিয়ে ভাবছি না যে তা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সামর্থ্য এ মুহূর্তে আমাদের নেই। অলংকারের নকশা প্রস্তুত থেকে শুরু করে স্বর্ণবাণিজ্যে দেশটি অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
ক্যানভাস: বিদেশে বাংলাদেশের স্বর্ণালংকারের বাজার কেমন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: বিদেশে আমাদের স্বর্ণের বাজার ধরার চেষ্টা যে একেবারে হয়নি, তা নয়। দুবাইতে হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ইন্ডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমাদের পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে, সেই ডিটেইলে যাচ্ছি না। তবে একটা ব্যাপার বলি, মনে রাখতে হবে ভারত অনেক বড় একটা দেশ। এর অনেক রাজ্য রয়েছে; যেগুলোকে আমরা প্রদেশ বলি। তাই স্বর্ণবাণিজ্যে ইন্ডিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামাটা খুব একটা সহজ কথা নয়। দেশটি গোটা পৃথিবীতে স্বর্ণ সাপ্লাই করে; বিশেষত দুবাইয়ে। কারণ, দুবাই ফ্রি মার্কেট। সেখানে অবাধে যেমন জিনিস কেনা যায়, তেমন বেচাও যায়। এই কারণে ইন্ডিয়ার সব গয়না দুবাইতে চলে যায়। মোটকথা, দেশটির বাজার বিরাট। স্বর্ণবাণিজ্যের নানা কিছুতে ভারতের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমরা ব্যবসা করি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের বহু স্বর্ণ কারিগরকে ভারত নিয়ে গেছে। তাই না? এই প্রবণতা কি কমেছে?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: এখনো যাচ্ছে। তবে আমাদের এখানে স্বর্ণকারিগরদের সবাই তো হিন্দু। ইন্ডিয়ায় অনেক স্বর্ণকারিগর চলে যাওয়ার পরেও বাংলাদেশে স্বর্ণকারিগরদের ৯০ শতাংশের বেশি সনাতন ধর্মাবলম্বী।
ক্যানভাস: আচ্ছা, বাংলাদেশে স্বর্ণালংকার তৈরি করা ও স্বর্ণবাণিজ্য বলতেই মূলত হিন্দুদের কথাই ওঠে। এমন একটি ব্যবসা, যার মধ্যে হিন্দুয়ানির ছাপ রয়েছে- এই বাণিজ্যকে নিজের পেশা করার বিষয়টি পরিবারের সবাই মেনে নিয়েছিল?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: হ্যাঁ। না মানার কিছু নাই তো। হিন্দুরা এই ব্যবসা করে বলে মুসলমানরা করতে পারবে না, এমন তো কথা নেই। বরং স্বর্ণকারিগরিতে মুসলমান কম থাকার কারণ, হিন্দু কারিগরেরা তাদের সঙ্গে মুসলিম কারিগরকে ঠিক মেনে নিতে পারে না বলে আমার মনে হয়েছে। আমি মুসলিম কারিগর নিয়ে দেখেছি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে জুয়েলারি ফ্যাশনের ট্রেন্ড সেট করার কোনো বিষয় আছে? নাকি এ ক্ষেত্রেও আপনারা ইন্ডিয়াকে অনুসরণ করেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: ইন্ডিয়ান ডিজাইনকে ফলো করতে আমরা বাধ্য। কারণ, হালফ্যাশনের ডিজাইন নিয়ে সেখানে প্রতিমুহূর্তে কাজ হচ্ছে। আর আগেই বলেছি যে আমাদের এখানে জুয়েলারি ডিজাইনিংয়ের কোনো স্কুল তৈরি হয়নি। তাই আমাদের ক্ষেত্রে ফ্যাশন ট্রেন্ড সেট করার সুযোগও কম।
ক্যানভাস: জুয়েলারির ডিজাইনে নানা রকম পরিবর্তন আসছে। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও সমকালীনতা- এই দুটি বিষয় একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা কীভাবে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় করেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আমরা সব সময় ক্রেতার চাহিদাকেই গুরুত্ব দিই। ধরেন, আমরা কোনো একটি অলংকারের পাঁচ রকম ডিজাইন বানালাম প্রথমে। তার মধ্যে দেখা গেল একটি ডিজাইন ক্রেতার বেশি পছন্দ। তখন ওই ডিজাইনের আরও কিছু বানানো হলো। দেখা গেল, সেটিই ক্রেতাদের বেশি আকর্ষণ করছে। আমরা নতুন নতুন বিভিন্ন নকশার সেট বানিয়ে রাখি, দেখি সেটা চলছে কি না।
ক্যানভাস: ঐতিহ্যবাহী, না আধুনিক- কোন ধরনের ডিজাইনকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্ব দেবেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আধুনিক ডিজাইনের চাহিদাই তো বেশি। আমরাও চেষ্টা করি সে ধরনের অলংকার বানাতে। নতুন প্রজন্ম পুরোনো ডিজাইন খুব বেশি পছন্দ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। তারপরেও অনেক সময় অ্যান্টিক ডিজাইনের চাহিদা থাকে। তখন আমরা পুরোনো নকশার গয়না খুঁজে বের করি। এর ভ্যালু আজও আছে। বিদেশেও এর যথেষ্ট কদর আছে। শুধু গয়নায় নয়, সব ক্ষেত্রেই সাবেকিয়ানার গুরুত্ব অনেক।
ক্যানভাস: আগে ক্রেতারা বিয়ে বা কোনো উৎসব উপলক্ষে গয়না কিনতেন। এখন কি এটায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আমি তো এমন একজনকে চিনি, যিনি কোনো কারণ ছাড়াই গয়না কেনেন। তার শখই হলো গয়না কেনা। শুধু ওই ব্যক্তি নন, অনেকেই সারা বছর গয়না কেনেন। এর কারণ, সোনা সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি। সোনা কিনে ফেলে রাখলে পরে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করা যায়। আমি যে সোনাটা ৪ হাজার টাকায় কিনেছিলাম, এখন সেটার দাম ৫০ হাজার টাকা। সোনার মতো মূল্যবান সম্পদ আর কিছুই নয়। তাই স্বর্ণালংকার কিনে রাখা মানে আসলে সঞ্চয় করা।
ক্যানভাস: বিয়ের অলংকার এবং অন্যান্য উৎসবের গয়না- এ দুয়ের ডিজাইনে পার্থক্য কোথায়?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: বিয়ের গয়না ভারী হবেই। কারণ, এতে ১০ থেকে ২০০ ভরির অর্ডার দেওয়া হয়। আবার বিয়েতে উপহারের ক্ষেত্রে হালকা গয়নারই প্রচলন। ঈদ, দুর্গাপূজা কিংবা বড়দিনেও লোকে এখন প্রচুর কিনছে, কিন্তু সে গয়নাগুলো হালকা। কেবল মেয়ের বিয়েতেই ভারী গয়নার চল।
ক্যানভাস: স্বর্ণবাণিজ্যে কোন বিষয়গুলোয় প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছাশক্তি, বিশ্বাস এবং স্বপ্ন- এ তিনটিতেই জোর দিতে হবে। আপনার কী ইচ্ছা, প্রথমে সেটা নিজের কাছ থেকেই জেনে নিতে হবে। আপনি যে সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারবেন, সেই ব্যাপারে বিশ্বাস রাখতে হবে এবং আগামী দিনে নিজেকে ও নিজের প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে স্বপ্ন দেখতে জানতে হবে। সব ব্যবসার সাফল্যের ক্ষেত্রেই এই তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যানভাস: আপনার সাফল্যের পেছনে কী রয়েছে?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: যেকোনো ব্যবসা করার সময়েই আপনাকে স্থির করতে হবে, আপনি সেটা সৎ পথে চালাবেন, নাকি অসৎ পথে চালাবেন। তারপর আপনাকে কমিটমেন্ট রাখতে হবে। আমি আমার স্বর্ণের কোয়ালিটির ব্যাপারে সততা বজায় রেখেছি। বেশি লাভ করার আশায় এমন কিছু করিনি, যাতে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর ক্রেতার প্রতি কমিটমেন্ট যথাযথভাবে পালন করেছি। যখন যে গয়না ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার কথা, দিয়েছি। যাকে যখন তার প্রাপ্য অর্থ মিটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কমিট করেছি, যথাযথ সময়ে তা মিটিয়ে দিয়েছি। এরপর রয়েছে মানুষের সঙ্গে ব্যবহার। কাস্টমারের সঙ্গে ব্যবহার ভালো না করলে ব্যবসায় সাফল্য পাওয়া যায় না- বিষয়টি সব সময় মাথায় রেখেছি। সুতরাং এই তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রডাক্টের গুণমানের ক্ষেত্রে সততা বজায় রাখা, কমিটমেন্ট আর সুন্দর ব্যবহার- এই তিনটির কারণেই আমি স্বর্ণব্যবসায় সফল হতে পেরেছি। আর আমি যেহেতু মুসলমান, তাই দুশ্চিন্তা না করে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখেছি।
ক্যানভাস: দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আপনি একজন সাবেক সাংসদ। তা রাজনীতি যখন করেছেন, তখন রাজনীতি আর ব্যবসার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় বেগ পেতে হয়নি?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: রাজনীতি মানুষের কাজ করার জন্য। তা করতে গিয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ তৈরি করেছি। অনেক স্কুল-কলেজে টাকা দিয়েছি। এগুলো ভালোবেসে করেছি। আর ব্যবসাটা হচ্ছে আমার পেটের বিষয়। না করলে তো খেতে পাব না। তাই ব্যবসাকে অবজ্ঞা করিনি। রাজনীতির ফাঁকে ব্যবসার ব্যাপারে খোঁজখবর রেখেছি। যত দিন সাংসদ ছিলাম, আমার ম্যানেজার ব্যবসার সবকিছু দেখতেন।
ক্যানভাস: রাজনীতি, না ব্যবসা- কোনটায় বেশি গুরুত্ব দেবেন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: দেখেন, ওই যে বললাম, ব্যবসা না করলে খাব কী আর চলব কীভাবে, এটার জন্য ব্যবসা আপাতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিই। কারণ, রাজনীতির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সেবা।
ক্যানভাস: স্বর্ণব্যবসায় আপনার পরবর্তী প্রজন্মের আগ্রহ কেমন?
কাজী সিরাজুল ইসলাম: আমার ছেলে আমিনুল ইসলামই তো এখন ব্যবসাটা চালাচ্ছে। আমিন নামটা ওরই। বিদেশে পড়াশোনা শেষে মাসিক পাঁচ-ছয় হাজার ডলার বেতন পেত। তারপর আমি ওকে নিয়ে এলাম। নইলে দোকান চালাবে কে? আমার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই আগ্রহের সঙ্গে স্বর্ণবাণিজ্য চালাচ্ছে। তাদের মধ্যে লন্ডন, সিঙ্গাপুর থেকে পড়াশোনা করে আসা তরুণেরাও রয়েছে।
ছবি: অংকুর রায়