ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ডিজাইনার ত্রয়
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের তিন নারী। ফ্যাশনের জগতে যারা নক্ষত্রসম উজ্জ্বল। অনুকরণীয়ও বটে। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
কোকো শ্যানেল
বিস্ময়কর এক কিংবদন্তি। কোকো শ্যানেল। শুধু একজন ডিজাইনারই নন, আইকনও বটে। তিনি ছাড়া ফ্যাশন দুনিয়া কী রকম হতো, ভাবা কঠিন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া শ্যানেল কেবল নিজের আত্মবিশ্বাস আর সৃজনশীলতার জোরে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ফ্যাশনের প্রতিটি শাখা। শূন্য থেকে উঠে এসে গড়ে তুলেছিলেন ফ্যাশনের এক বিশাল সাম্রাজ্য।
১৮৮৩ সালের ১৯ আগস্ট ফ্রান্সের সোমুর শহরে জন্মগ্রহণ করা এই নারীর আসল নাম গ্যাব্রিয়েলা বনহুর শ্যানেল। ১২ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যুর পর বাবা তাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসেন। এখানে থাকাকালীন ছুটির দিনগুলোতে বেড়াতে যেতেন খালাবাড়িতে। এই মুক্তির অবকাশেই তিনি হাতেখড়ি নেন খালার কাছে। খালা তাকে বিভিন্ন পোশাক, হ্যাট, বনেটসহ অন্যান্য অনুষঙ্গে পাড়, কুঁচি, ফিতা আর নানা ধরনের এমবেলিশমেন্ট জুড়ে দেওয়ার সেলাই শেখান। শ্যানেল সব সময় সমাজের উঁচু স্তরের নারীদের মতো সম্মানিত আত্মনির্ভরশীল হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই পালে হাওয়া লাগে যখন অনাথ আশ্রম থেকে বেরিয়ে তিনি ভর্তি হন নটর ডেম স্কুল অব ফিনিশিং ফর স্কুলে। এখানেই তিনি পান একটি ক্যারিয়ার আর নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা।
শ্যানেলের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল সংগীতশিল্পী হিসেবে। ফ্রান্সের ভিশি শহরের কেন্দ্রে জাঁকিয়ে বসা সুবিশাল ‘গ্র্যান্ড ক্যাফে’তে প্রায়ই গান গাইতেন। গাইতে গাইতে গ্যাব্রিয়েলা হয়ে ওঠেন ‘কোকো’। এখানেই সখ্য গড়ে ওঠে ধনাঢ্য অনেক তরুণের সঙ্গে। তাদের মধ্যে এতিয়েন বালসাঁ ও বয় কাপেল ছিলেন কোকোর ভালো বন্ধু। এদের হাত ধরে শ্যানেল পা রাখেন সম্ভ্রান্ত ও অভিজাতদের ঐশ্বর্যময় জগতে। এখানে তার নজরে আসে অভিজাত নারীদের পোশাকগুলো। তাদের ভারী কোরসেটযুক্ত, দম আটকানো জবড়জং পোশাক দুর্বোধ্য লাগত কোকোর কাছে। পরিধেয় বাছাইয়ের জন্য কখনো ওই পথে পা বাড়াননি তিনি। এ নিয়ে কোকো একবার বলেছিলেন, ‘বিলাসিতা যদি আরামদায়ক না হয়, তাহলে সেটি বিলাসের পর্যায়েই পড়ে না।’ তার পোশাক নিজেই ডিজাইন করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। নিজেকে সে সময় কিছুটা খোলামেলা, কিন্তু মার্জিত ও বনেদি রূপে প্রকাশ করেছেন। এভাবেই তিনি উঁচু মহলের নারীর গসিপের উৎস আর পুরুষের কাঙ্ক্ষিত নারীতে পরিণত হন।
নিজে কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকেই বন্ধু ও প্রেমিক বয় কাপেলের সহায়তায় ১৯১০ সালে প্যারিসে খুলে বসেন প্রথম বুটিক ‘শ্যানেল মোড’। শুরুতে বানাতেন সুন্দর সুন্দর হ্যাট। এরপর তিনি ফ্রান্সের ডভিল ও বিয়ারিটজে আরও দুটি দোকান খোলেন। সেখানে মেয়েদের পোশাক বানাতেন। সেসব পরিধেয়র ডিজাইনে এনেছিলেন নতুনত্ব। প্রচলিত ধারা এড়িয়ে নারীর ফ্যাশনে তিনি নিয়ে আসেন আরামদায়ক মার্জিত ডিজাইনের পোশাক। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। সে সময় ফরাসি শিল্প-সাহিত্য মহলেও বেশ জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। মাত্র দশ বছরে শ্যানেল ইন্ডাস্ট্রিজের মূল্য কয়েক মিলিয়নে পৌঁছে যায়। ফ্যাশনে তার যেসব অবদান আজও অম্লান সেগুলো হলো, পারফিউম শ্যানেল নাম্বার ৫, লিটল ব্ল্যাক ড্রেস ও শ্যানেল স্যুট।
কোকো শ্যানেলই প্রথম ফ্যাশন ডিজাইনার, যিনি পারফিউম বাজারে আনেন। সুগন্ধির প্রতি তার মোহ আজীবনের। শ্যানেলের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘সুগন্ধি ফ্যাশনের সেই অদৃশ্য চিরস্মরণীয় ও অনন্য অনুষঙ্গ, যা তোমার আগমনের ইঙ্গিত আর প্রস্থানের পরেও তোমার উপস্থিতিকে বিদ্যমান রাখে।’ আরনেস্ত বো নামের এক সৌগন্ধিকের উদ্ভাবিত কিছু নমুনা থেকে পাঁচ নাম্বারটি খুব মনে ধরে শ্যানেলের। শুধু কোকো নয়, ওই সৌরভে মাতে সারা বিশ্ব। সেই থেকে আজ এক শ বছর পরেও শ্যানেল নাম্বার ৫ বিশ্বের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় পারফিউম। তার দেখাদেখি অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ডই নিজস্ব সুগন্ধি তৈরি করেছে।
কোকো শ্যানেলই মেয়েদের ফ্যাশনে প্যান্ট আর স্যুট-স্কার্টের প্রবর্তন করেন। পুরুষের পোশাকের অনুপ্রেরণা নিয়ে সৃষ্ট এসব ড্রেস তৎকালীন সমাজে অনেক প্রশংসা পায়।
সেই সময় তিনি বিশেষ অবদান রাখেন লিটল ব্ল্যাক ড্রেস বা এলবিডিকে প্রতিষ্ঠা করতে। এর আগে কালো পোশাক শোকের অনুষ্ঠান ছাড়া কোথাও কল্পনা করা যেত না। ওই প্রথাকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে শ্যানেল দেখান কালো পোশাক ইভনিং ওয়্যার হিসেবে কতটা আকর্ষক হতে পারে। ১৯২৬ সালে ভোগ আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এলবিডি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘এই পোশাক একদিন রুচিশীল সব মেয়ের জন্য একধরনের ইউনিফর্ম হবে।’ হয়েছেও ঠিক তাই। ফ্যাশনসচেতন সব মেয়ের ওয়্যারড্রোব ঘাঁটলে একটা এলবিডি পাওয়া যাবেই। এসব পোশাক আর সুগন্ধি ছাড়াও লাল লিপস্টিক, নেইলপলিশ ও সানট্যান তেলের মাধ্যমে তিনি প্রসাধনশিল্পে বেশ পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
ডিজাইনার আর ব্যবসায়ীর বিপুল খ্যাতি এবং নতুনকে গ্রহণের অভীপ্সা শ্যানেলকে করেছে অনন্য। এখন পর্যন্ত বিশ্বে তার সমকক্ষ কোনো ডিজাইনার আসেননি। বিলাসী কিন্তু সরল, মার্জিত কিন্তু আরামদায়ক যে কনসেপ্টের উদ্ভাবন করেছেন তিনি, গোটা ফ্যাশন বিশ্ব আজও তা অনুসরণ করছে। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি শ্যানেলের বর্ণাঢ্য আর দুঃসাহসিক জীবনের অবসান ঘটে। মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরও হাউস অব শ্যানেল বিশ্বে বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ড।
রিতু কুমার
ভারতীয় ফ্যাশন জগতের মুকুটহীন রানি বললে খুব একটা ভুল হবে না তার সম্পর্কে। রিতু কুমারই ভারতে ‘বুটিক সংস্কৃতি’র প্রবর্তক। লোকজ হস্তশিল্পকে স্বকীয় সৃজনশীলতায় নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়। সেসব ছাড়াও তার সৃষ্টিতে অন্যান্য দেশের সংস্কৃতির স্পর্শ দেখা গেছে। আত্মপ্রত্যয় আর পরিশ্রমে আজ তার নিজস্ব লেবেল ‘রিতু কুমার’ ভারতের বৃহত্তম ও সর্বাধিক সম্মানিত ডিজাইনার ফ্যাশন ব্র্যান্ড।
১৯৪৪ সালের ১১ নভেম্বর ভারতের অমৃতসরে জন্মানো রিতু কুমার পড়াশোনা করেন সিমলার লরেটো কনভেন্ট এবং দিল্লির লেডি আরউইন কলেজে। সেখান থেকে স্নাতক করে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ব্রায়ারক্লিফ কলেজ থেকে শিল্পের ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আবার মিউজিওলজি নিয়ে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন আশুতোষ মিউজিয়াম অব ইন্ডিয়ান আর্ট থেকে। এরপর খুব অনাড়ম্বরভাবে শুরু করেন নিজের ফ্যাশন ক্যারিয়ার।
শুরু করতে হয়েছিল একদম শূন্য থেকে। ১৯৬৯ সালে কলকাতার একটি ছোট্ট গ্রামে চারজন হ্যান্ডব্লক প্রিন্টের কারিগর আর দুটি টেবিল নিয়ে রিতুর ব্যবসা শুরু হয়। আজ অর্ধশতকের বেশি সময় পর ভারত ও ভারতের বাইরে রিতু কুমার ব্র্যান্ডের ৯০টির বেশি শোরুম আছে। এই ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বড় অবদান ভারতের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা। সাঁতারের পোশাক থেকে সন্ধ্যাকালীন পার্টির গাউন- সবেতেই রেশ আনেন ভারতীয় ঐতিহ্যের। শুধু পোশাকেই নয়, তার ব্র্যান্ডের গৃহস্থালি সাজসজ্জার পণ্যে হস্তশিল্প নকশার ব্যবহার দেখা যায়, যা অতুলনীয়। ভারতের প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব কারুশিল্প, যেগুলো কালের পরিক্রমায় প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল, তা বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করছেন এই নারী। তার পোশাক ও অন্যান্য অনুষঙ্গে নতুন করে প্রাণ পায় লক্ষেèৗর সূক্ষ্ম জালি কারুকাজের ‘আওয়াধ’, অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানার হ্যান্ডপেইন্ট ও ব্লকপ্রিন্টের ‘কলমকারি’, রাজস্থানি বগ্রু ও সঙ্গানের প্রিন্টের ‘বঙ্কু’, কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ ‘জামেভার’। বিশেষ করে বলতে হবে মোগল আমলের প্রসিদ্ধ জারদৌসিশিল্পের কথা। তার ব্র্যান্ডের মূল পণ্য কনের পোশাক ও রাতের অনুষ্ঠানের জমকালো ড্রেসে ফ্যাব্রিকের ওপর স্বর্ণের তৈরি সুতার স্বকীয় প্যাটার্নের জারদৌসি কাজের ব্যবহার। এখন কেউ যদি মজা করে রিতু কুমারকে ‘জারদৌসি’র অ্যাম্বাস্যাডার বলে, মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না। ঐতিহ্যবাহী শিল্পকেই শুধু নয়, তিনি বাঁচিয়েছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। তার ব্র্যান্ডের জন্য কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো হস্তশিল্প কারিগরের।
ভারতীয় হস্তশিল্পের প্রতি সবার আগ্রহ বাড়াতে এবং এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৯ সালে বুনন ও নকশাশিল্পের ইতিহাস নিয়ে রিতু কুমার ‘কস্টিউমস অ্যান্ড টেক্সটাইলস অব রয়্যাল ইন্ডিয়া’ নামে একটি বই লেখেন। তার ত্রিশ বছরের কালেকশন নিয়ে হয়েছে ‘ট্রি অব লাইফ’ নামের তথ্যচিত্র, যা ২০০০ সালে প্রদর্শিত হয় সুইজারল্যান্ডের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে। ভারতের ফ্যাশন জগৎ ও হস্তশিল্প সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য রিতু কুমার পেয়েছেন অনেক স্বীকৃতি ও সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদ্মশ্রী পুরস্কার এবং ফরাসি সরকারের শেভালিয়ে দে আর্ট এহ দে লেতার্স (নাইট অব দ্য অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স) সম্মাননা। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এ নিয়েই ৭৬ বছর বয়সে এগিয়ে চলছেন দীপ্ত পদক্ষেপে।
বিবি রাসেল
ঠিক কী বলা যেতে পারে তাকে? ফ্যাশনের ফেরিওয়ালা? নাকি এক বিস্ময়কর শিল্পদূত? যে বিশেষণেই চিহ্নিত হোক না কেন, বিবি রাসেলের জন্য তা অপ্রতুলই বলতে হয়। এক অনন্য প্রতিভার নাম, যিনি বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশকে একাই পৃথিবীর ফ্যাশন মানচিত্রে অধিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিবি রাসেল। ছোটবেলা থেকে সেলাইয়ের প্রতি ছিল তার অসম্ভব ঝোঁক। মায়ের বানিয়ে দেওয়া পোশাক ভালো লাগত না দেখে বাবা মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেন। আরও এনে দিতেন দেশি-বিদেশি নামী ফ্যাশন ম্যাগাজিন। সেগুলোতে পড়তেন কোকো শ্যানেল, এলসা শিয়াপারেলি, ডিওর, সেইন্ট লরেন্টের মতো ডিজাইনারদের কথা। সেখানেই জানতে পারেন লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইনিংয়ের বিষয়ে। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার। এ ইচ্ছার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাবার উৎসাহ। ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে পাস করে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পাড়ি জমালেন বিলেতে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে পড়ার উদ্দেশে। তিনি যে সময় লন্ডনে যান, তখন একা কোনো মেয়ের বাইরে পড়তে যাওয়া ছিল আলোচনার ব্যাপার। সেখানে অনেক অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। নিজের চলার জন্য চিঠি পর্যন্ত বিলি করেছেন। তার পোশাকের ডিজাইন শো করতে নিজেই হয়েছেন মডেল। এ ক্ষেত্রে অবশ্য উৎসাহ পেয়েছেন কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে। কলেজ থেকে বেরিয়ে বিবির ক্যারিয়ার শুরু হলো মডেল হিসেবে। প্রথম কাজ লন্ডনের হারপার’স বাজার ম্যাগাজিনে। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ বছর ধরে শুধু মডেলিং করেছেন। সে সময় বাংলাদেশ মানেই ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত একটি দরিদ্র দেশ। অন্যদিকে, তখন বিশ্ব মিডিয়া বিস্মিত হয়ে দেখত কীভাবে বাংলাদেশি এক মেয়ে নামীদামি মডেলদের সঙ্গে রানওয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিশ্ববিখ্যাত এমন কোনো ম্যাগাজিন নেই যেখানে বিবি রাসেলের ছবি বের হয়নি, এমন কোনো বিখ্যাত ব্র্যান্ড নেই, যার মডেল হননি তিনি। শিখেছেনও অনেক কিছু।
১৯৯৪ সালে যখন তার ক্যারিয়ার তুঙ্গে, তখন সবাইকে অবাক করে ফিরে এলেন দেশে। নিজের স্বপ্ন পূরণের বাসনায়। কাজ করতে লাগলেন বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ও ফ্যাশন নিয়ে। এ জন্য তিনি চলে গেলেন একদম শিকড়ে। প্রথম দুই বছর গ্রামে গ্রামে ঘুরে রপ্ত করলেন আঞ্চলিক ভাষা, পোশাকরীতি আর অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প। কাছ থেকে দেখেছেন তাঁতিদের জীবন। এসব জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্র্যান্ড ‘বিবি প্রোডাকশন’। এর মাধ্যমে বিবি রাসেলের হাতে পুনর্জন্ম পায় হারিয়ে যাওয়া অনেক কারুশিল্প। কর্মসংস্থানও হয় লাখো গ্রামীণ তাঁতির। এই ফ্যাশন হাউসের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের একদম নিজস্ব সংস্কৃতিকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরা। কাজটি তিনি যথার্থভাবেই করতে পেরেছেন। শুধু নিজের দেশেই নয়, ডিজাইনিংয়ের কাজ করেছেন বাইরেও। রাজস্থানে সরকারি আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন সেখানকার কোটা দরিয়া আর খাদি কাপড় রিভাইভ করতে।
বিদেশি পোশাক আর কাপড়ের ভিড়ে যে দেশীয় মসলিন, তাঁত, জামদানি হারিয়ে যায়নি, সারা বিশ্বে অগুনতি মানুষ যে এগুলো সম্পর্কে জানেন, তা কেবল সম্ভব হয়েছে বিবি রাসেলের সক্রিয়তায়। এ জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য স্বীকৃতি ও সম্মাননা। বিখ্যাত এল ম্যাগাজিনের ‘বর্ষসেরা নারী’, বাংলা একাডেমির ‘সম্মানিত ফেলো’, ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে পোশাক পরিকল্পনাকারী হিসেবে অর্জন করেছেন জাতীয় পুরস্কার, পেয়েছেন বেগম রোকেয়া পদক। এখন পর্যন্ত নিজের অনন্য সৃজনীশক্তি আর শিল্পনৈপুণ্যে এগিয়ে চলেছেন। বিবি রাসেল একবার বলেছিলেন, ‘আজকে ওয়ার্ল্ডে টপ ডিজাইনারের সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছি। ব্যাপারটা আমি একা করছি না। আমি চোখ বন্ধ করেই দেখি বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষ আমার পেছনে, যাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে। তাদের হাতে যে জাদু আছে, এটা আমি পুরো পৃথিবীকে দেখাতে পেরেছি।’
ছবি: ইন্টারনেট