skip to Main Content

ফিচার I কৃষিযন্ত্রে স্বস্তি

গায়ে খেটে ফসল ফলানোর ইতিহাস সুদীর্ঘ। আধুনিক সময়ে বেশ কিছু যন্ত্রের আবিষ্কার সে কাজ করে দিয়েছে যথেষ্ট সহজ। কৃষকের মুখে ফুটিয়েছে স্বস্তির হাসি

আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা থেকে বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান খাত কৃষি। প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশে কৃষিকাজ ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশের কর্মসংস্থানের একমাত্র ক্ষেত্র। বিগত দশকগুলোতে দেশে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যেসব কাজ আগে মানুষ দিয়ে করানো হতো, এখন হচ্ছে যন্ত্রে। বর্তমানে দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় ৯০ শতাংশ চাষ হয় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৩০ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি।
বিশ্বে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের র‌্যাংকিংয়ের প্রথম অবস্থানে চীন। দেশটির আধুনিক খামারগুলোতে প্রায় ৩০ কোটি কৃষক কাজ করেন। বাংলাদেশেও অনেক কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদিত হচ্ছে এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ড্রোন: শস্য উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত সব কটি ধাপেই রয়েছে ড্রোনের ব্যবহার। বীজ রোপণ, পরিচর্যা, রোগজীবাণু দমন এবং প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহে কাজ করতে পারে ড্রোন। মাটির উপাদানের পরিবর্তন ড্রোনের মাধ্যমেই বোঝা যায়। জমিতে আগে যে পরিমাণ শ্রম, সময় ও অর্থ খরচ করে কীটনাশক দেওয়া যেত, ড্রোন ব্যবহারের ফলে সেটা প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। ফসল বেড়ে ওঠার সময় থেকে সংগ্রহের আগ পর্যন্ত মাটির পরিবর্তনের দিকে নজর রাখতে হয়। ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে দিনের যেকোনো সময়েই মাটির ছবি যতবার ইচ্ছে সংগ্রহ করা সম্ভব। ড্রোনে ব্যবহৃত থার্মাল প্রযুক্তি ফসলি জমির সবদিক থেকে মাটির তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। এ ছাড়া এর দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড প্রযুক্তির কল্যাণে আলাদাভাবে প্রতিটি গাছ ও শস্যে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাঙ্গাস আক্রমণের উপস্থিতি জানা যায়। তখন কৃষক চাইলে নিজেই আলাদাভাবে সেই নির্দিষ্ট শস্যের দিকে নজর দিতে পারেন। এতে বৃদ্ধির সময়টাজুড়ে পুরোপুরি আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে ফসল।
কম্বাইন হারভেস্টার: দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধান-গম কাটার জন্য হেড ফিড মিনি কম্বাইন হারভেস্টার উদ্ভাবিত হয়েছে। এটি মাটির ১৫-২০ সেন্টিমিটার গভীরে শক্ত স্তর (প্লাউ-প্যান) যুক্ত কাদামাটিতে চলতে পারে। এর মাধ্যমে খুব কম সময়ে জমির অনেক ধান-গম কাটা যায়, ফলে কর্তনোত্তর অপচয় হ্রাস পায় এবং সার্বিক উৎপাদন খরচ কমে আসে। এর মাধ্যমে সঠিক সময়ে দ্রুত ফসল কেটে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে শস্যকে রক্ষা করা সম্ভব। ফলে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হন এবং কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ে। ডিজেল ইঞ্জিনচালিত কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান ও গম একই সঙ্গে কর্তন, মাড়াই, ঝাড়াই ও বস্তাবন্দী করা যায়।
রিপার মেশিন: আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সুফল পেতে শুরু করেছেন এ দেশের চলনবিল অঞ্চলের কৃষকেরা। একসময় গম ও ধান কাটার জন্য কাঁচিই ছিল প্রধান হাতিয়ার। এখন বদলে গেছে সেই দৃশ্যপট। মাঠে মাঠে পৌঁছে গেছে গম ও ধান কাটার যন্ত্র। কৃষকদের কাছেও ধান কাটিং মেশিন (রিপার) জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর সাহায্যে গম ও ধান কাটায় সময় ও খরচ—দুই-ই কমছে। রিপার দিয়ে একসঙ্গে ছয় সারির গম ও ধান কাটা যায়। ১ একর জমির ফসল কাটতে সময় লাগছে মাত্র ১ ঘণ্টা। এটি চালাতে একজন শ্রমিক ও ১ লিটার পেট্রলই যথেষ্ট।
ডিজেল টিলার: একসময় জমি চাষে লাঙলই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। জোয়ালও প্রায় বিলুপ্ত। কারণ, এখন হাল চাষ, মই দেওয়া বা জমি সমান করা, ফসল পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি অনিবার্য নয়। সবই করা যায় ডিজেল ইঞ্জিনচালিত পাওয়ার টিলার দিয়ে। পাওয়ার টিলারের প্রধান কাজ জমি চাষ করা। বিভিন্ন এক্সটেনশন লাগিয়ে এটি দিয়ে আরও অনেক কাজ করা যায়। যেমন রিপার ব্লেড লাগিয়ে ফসল কাটা, মাড়াই; ট্রান্সপ্ল্যান্টার এক্সটেনশন লাগিয়ে ধান রোপণ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই বা বারি) উদ্ভাবিত এক্সটেনশন লাগিয়ে আলু বোনা, আলু সংগ্রহ; পাম্পের সঙ্গে পুলি লাগিয়ে পানি সেচ; পেছনে ট্রলি লাগিয়ে পণ্য পরিবহন ইত্যাদি।
ইনপ্লাইমেন্ট-রাইডার: বীজ বপনের পর্যায়ে ফসল বৃদ্ধির সময় আগাছা বাছাই ও মাটি ঢিলা করতে এটি ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য হলো আগাছা দূরীকরণ, জল সংরক্ষণ, তাপ সংরক্ষণের জন্য মাটি চাষ, জৈব পদার্থের পচে যাওয়া এবং ফসলের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য ভালো পরিস্থিতি তৈরি করা।
মিনি ট্রেলার: লাঙল, রোটারি-চাষ, বপন, জল, স্প্রে, ফসল তোলা এবং পরিবহন ইত্যাদির জন্য মিনি ট্রেলার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি পরিচালনা করা সহজ।
ট্রি রিমুভ মেশিন: যন্ত্রটি বেশ ভয়ংকরও বটে! বড় বড় গাছপালা কেটে মুহূর্তেই এটি জঙ্গল সাফ করতে পারে। ট্রি রিমুভ মেশিন সাধারণত রাস্তার পাশের গাছগাছালি পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়।
অরেঞ্জ হারভেস্টার: গাছ থেকে কমলালেবু তোলার এ এক বিশেষ যন্ত্র। মাত্র এক মিনিটেই গাছ থেকে কয়েক শ কমলালেবু পেড়ে ফেলতে পারে এটি। এরপর সেগুলোকে ট্রাকে লোড করে দেয়। প্রতিটি অরেঞ্জ হারভেস্টারে ছয় থেকে আটটি লোহার চাকা লাগানো থাকে।
স্ট্রবেরি হারভেস্টার: স্ট্রবেরি হারভেস্টার একটি রোবটিক যন্ত্র। এর নিচের দিকে অনেকগুলো রোবটিক হ্যান্ড লাগানো থাকে, যেগুলো স্ট্রবেরিগুলোকে স্ক্যান করে। এটি শুধু লাল স্ট্রবেরিই তুলতে পারে।
ফ্রুট হারভেস্টার: ফল পাড়ার এই যন্ত্র দিয়ে পুরো গাছে জালি লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গাছের গোড়া চেপে ধরে নাড়াতে হয় দ্রুত। এতে পাকা ফল জালিতে পড়ে জমা হয়।
টমেটো হারভেস্টার: এই যন্ত্র এতই দ্রুতগতিতে গাছ থেকে টমেটো আলাদা করে ফেলতে পারে, দেখে চমকে উঠতে হয়! এরপর সব টমেটোকে একটি ট্রাকে লোড করতে থাকে। মাত্র কয়েক মিনিটে টমেটো সংগ্রহ করে ট্রাকে লোড করতে পারে টমেটো হারভেস্টার।
রাইস হারভেস্টার: চাষাবাদ বহু গুণ সহজ করে দিয়েছে রাইস হারভেস্টার। জমির ধান কাটার কাজে ব্যবহৃত হয় এটি। ধান কাটার পর ভুসি পেছনে ফেলে দেয়। তারপর যখন এই মেশিনে পুরোপুরিভাবে ধান লোড হয়ে যায়, তখন এটি ধানগুলো আলাদা ট্রাকে নিয়ে খালি করে আসে।
সুগার কেইন হারভেস্টার: জমিতে বেড়ে ওঠা আখ কেটে এক সারিতে জমা করতে থাকে এটি। আখগুলোকে কেটে মেশিনের মধ্যে জমা করে নেয় এবং আখের একটা করে বান্ডিল তৈরি করে বাইরে বের করে দেয় এ যন্ত্র।
ইট বিলোংগো মেশিন: এটি সাধারণত গাছের ডাল কাটার কাজ করে। যে কাজ করতে একজন মানুষের অনেক দিন লেগে যাবে, এটি তা মাত্র কয়েক মিনিটে করতে সক্ষম। জমি পরিষ্কারের এ যন্ত্র দুটি পাওয়ারফুল ট্রাকের মাঝখানে একটি মোটা লোহার চেইনে বেঁধে দেওয়া হয়। ট্রাকগুলো যখন চলে, তখন সব বড় জঙ্গলের গাছপালা মুহূর্তেই হয়ে যায় পরিষ্কার। সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এ যন্ত্রের ব্যবহার বেশি।
ট্রাক্টর: বর্তমান যুগে কৃষিকাজ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ট্রাক্টর। দ্রুত খেত কর্ষণ থেকে শুরু করে রোপণ এবং চাষবাসের যাবতীয় কাজে এই বিশেষ কৃষিযন্ত্রের জুড়ি নেই। একজন ব্যক্তি একই সময়ে দুটি ট্রাক্টর চালাতে পারেন। সেন্সরের কারণে এসব ট্রাক্টর সামনে বাধা শনাক্ত করতে এবং সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারদর্শী।
ভবিষ্যতে আমাদের কাজের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে সময়, লোকবল এবং প্রকৃতি নিজে। তাই উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রেখে মানবজাতির খাদ্যচাহিদা মেটাতে হলে আরেকবার ভাবতে হবে, পরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়।
আরও বেশ কিছু যন্ত্র এ সময়ে কৃষিকাজকে করে তুলেছে সহজ ও স্বস্তিদায়ক। এর অনেকগুলো উন্নত দেশের পাশাপাশি ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলাদেশেও। আরও কিছু যন্ত্র শিগগির যুক্ত হবে আমাদের কৃষিভুবনে, যে আশা করাই যায়।

 সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top