skip to Main Content

স্বাদশেকড় I পাউরুটি পাঁচালি

হালকা ও শুষ্ক খাবার হওয়ায় ভ্রমণপিয়াসীরা সঙ্গে নিতে নারাজ হন না। এর আঁতুড়ঘর নিয়ে রয়েছে মতভেদ। বাংলাদেশে এনেছিলেন পর্তুগিজরা

পা দিয়ে আটা মথে তৈরি হয় বলে নাম পাউরুটি? মোটেও না। তবে এমনটাই ধারণা কিছু বাঙালির। মূলত উৎসবের আগে পা দিয়ে মথে কিছু অসাধু কারখানায় সেমাই তৈরি করতে দেখে মানুষের মন সন্দেহবাতিক হয়ে উঠেছে। ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়, বিষয়টা তেমন দাঁড়িয়েছে আরকি! সেই আতঙ্ক থেকেই হয়তো পাউরুটির সঙ্গে পায়ে মথা আটার চিন্তা জুড়ে গেছে। অনেকে আবার আরেকটু বাড়িয়ে ভাবেন। ধারণা করেন, আগে বাঙালি বাবুরা পাউন্ড মাপে কিনতেন বলে হয়তো এর নাম পাউরুটি। এই ধারণাও ঠিক নয়। সম্ভবত রুটি শব্দটি সংস্কৃত ‘রোটিকা’ থেকে এসেছে। ‘পাউ’ এসেছে পর্তুগিজ ভাষা ‘পাও’ থেকে। ‘পাও’ মানে ছোট গোল রুটি। ফলে পর্তুগিজ ও সংস্কৃত মিলেই ‘পাউরুটি’। এখানে পা কিংবা পাউন্ডের কোনো যোগসাজশ নেই!
পাউরুটি যে কত বছরের পুরোনো খাবার, তা হলফ করে বলা কঠিন। নিত্যনতুন গবেষণায় এর ইতিহাস শুধু বদলেই চলেছে। কিছুকাল আগ পর্যন্ত মানুষ জানত, খাবারটি ৯ হাজার ১০০ বছরের পুরোনো। তুরস্কের মাটি খুঁড়ে প্রাচীন যুগের পাউরুটির হদিস মিলেছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস খারিজ হয়ে গেছে। কারণ, সম্প্রতি বিশেষজ্ঞরা ১৪ হাজার ৫০০ বছর আগের পাউরুটির সন্ধান পেয়েছেন। তা দেখে বিজ্ঞানীদের চক্ষু চড়কগাছ! কেননা, কৃষির আবিষ্কারই তো ১২ হাজার বছরের পুরোনো। এতকাল আগের পাউরুটি খুঁজে পেয়েছেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পুরাতাত্ত্বিক। মিলেছে জর্ডানের উত্তরাংশের মাটির তলায়। পাউরুটিটি ছিল পোড়া; ছিল পোড়ামাটির পাথরের সঙ্গে লেপ্টে। পরখ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, সেটি তৈরি হয়েছিল গম ও ভুট্টা দিয়ে। এখন সেটিকেই বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো পাউরুটি হিসেবে ভাবা হচ্ছে।
আরেকটি ইতিহাস বলছে, পাউরুটির আঁতুড়ঘর মিসর। ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে সেখানে উদ্ভব হয়েছিল এই খাবারের। সেই অঞ্চল থেকেই সারা বিশ্বের ফুড মেনুতে যুক্ত হয়েছে এ রুটি। ভারত উপমহাদেশে তা এনেছেন পর্তুগিজরা। ১৪৯৮ সালে তারা যখন এই তল্লাটে আসেন, তখন পাউরুটি খুঁজে পাননি। ফলে নিজেরাই তৈরি করতে লাগলেন। তবে সমস্যায় পড়েছিলেন ইস্ট নিয়ে। ভারতে উপকরণটি মিলছিল না। বিকল্প হিসেবে পর্তুগিজরা ময়দায় পাম ওয়াইন (সম্ভবত তাড়ি) ব্যবহার শুরু করেন। এভাবেই এই উপমহাদেশের খাদ্যভান্ডারে যুক্ত হয় পাউরুটি। সময়ের পরিক্রমায় তা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও পাউরুটি এসেছে পর্তুগিজদের সুবাদেই। চট্টগ্রামে তারা বাণিজ্যিক ঘাঁটি গেড়েছিলেন। সঙ্গে এনেছিলেন এই বিশেষ রুটি।
পাউরুটির অর্থ আদতে ছোট গোল রুটি হলেও বর্তমানে এটি কেন চৌকো, তা এক রহস্য। একটা সময় স্লাইস করে কাটা পাউরুটি মিলত না। কিনে এনে নিজেকেই কাটতে হতো। ফলে এবড়োথেবড়ো তো হতোই, আঙুল কাটার ঘটনাও ঘটত হরহামেশা। এতে সময়েরও অপচয় হতো। সমস্যা সমাধানে ১৯২৮ সালের ৭ জুলাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন করা হয় ফালি পাউরুটি। তাতে এসব মুশকিল হয়ে যায় আসান। পাউরুটি ফালি করার পদ্ধতির উদ্ভাবক ওটো ফ্রেডেরিক রোহওয়েডার। যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরির মানুষ। ১৮৮০ সালে জন্মে মারা যান ১৯৬০ সালে। ফালি পাউরুটি তৈরির যন্ত্র বানাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল তাকে। কপাল এতটাই মন্দ ছিল, ১৯১৭ সালে তার বানানো প্রথম যন্ত্র আগুন লেগে নষ্ট হয়ে যায়। তবে রোহওয়েডার দমে যাননি। আবার তৈরি করেন যন্ত্রটি। তবে যন্ত্রে কাটা পাউরুটি লোকে গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানমালিকেরা সন্দিহান ছিলেন। এই দ্বিধা নিয়ে রোহওয়েডার দ্বারস্থ হন বন্ধু ফ্র্যাঙ্ক বেঞ্চের। তার রুটির কারখানা ছিল। বন্ধুর চিলিকোথি বেকিং কোম্পানিতেই বাণিজ্যিকভাবে প্রথম তৈরি হয়েছিল ফালি পাউরুটি। ধীরে ধীরে মেশিনে তার আরও উন্নতি সাধিত হয়। তা ছাড়া আরেকটি সমস্যায় পড়তে হয়েছিল রোহওয়েডারকে। ফালি পাউরুটি ছিল দ্রুত পচনশীল। ফলে তিনি কাটার পর রুটিগুলোকে বিশেষ পিন দিয়ে আটকে দিতেন। পিন সরালেই টুকরা রুটিগুলো আলাদা হতো। পরে মোড়কজাত করে তা বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন তিনি। অল্প দিনেই এ ধরনের ফালি পাউরুটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
এই ছিল পাউরুটির শিকড়ের ফিরিস্তি। এবার আসা যাক বর্তমানে। এখন তো শতাধিক প্রকার পাউরুটি মেলে সারা বিশ্বে। এর ইতিহাস ও বিস্তার বিষয়ে একটি জাদুঘরও রয়েছে অস্ট্রিয়ায়। সেখানে রয়েছে পাউরুটির ১২০০ নমুনা। বর্তমানে পাউরুটি থেকে তৈরি কিছু খাবার বেশ জনপ্রিয়। স্যান্ডউইচ সেগুলোর একটি। আমাদের দেশে রোগীকে দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ানোর চল রয়েছে। তা ছাড়া সামান্য জেলি কিংবা ডিমযোগে হালকা খাওয়ার সুবিধা থাকায় নাশতার আইটেম হিসেবে টেবিলে মেলে পাউরুটি। ছেলেমেয়েদের স্কুলে টিফিন হিসেবেও এটি সহজ একটি পদ। দীর্ঘ ভ্রমণে পাউরুটি ক্ষুধা নিবারণের অনুষঙ্গ। তুলনামূলকভাবে হালকা ও শুষ্ক খাদ্য হওয়ায় ট্রাভেলাররা এটি বহন করতে সাধারণত অনীহা প্রকাশ করেন না। ঘরেও বানানো যেতে পারে এই রুটি। তবে তাতে খাটুনি একটু বেশি বলে কিনতেই আগ্রহী বেশির ভাগ মানুষ। অবশ্য বাসায় বানানো পাউরুটির স্বাদ, সুবাস ও খাদ্যমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দোকানেরগুলো টেকে না!
 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top