টেকসহি I শরণার্থী শ্রুতি
২০ জুন। বিশ্ব শরণার্থী দিবস। ‘শরণার্থী’ বলতে আমাদের মানসপটে যে দৃশ্য ভেসে ওঠে, এর ব্যাপকতা তার চেয়ে অনেক বেশি
পাঁচ বছর আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে শিশু শাহেদের একটি ছবি প্রকাশ পায়। এটি আরও দু বছর আগে তোলা। বাংলাদেশি আলোকচিত্রী তুর্জয় চৌধুরী যখন ছবিটি তোলেন, শাহেদের বয়স তখন মাত্র সাত দিন। দেখে সাধারণ নবজাতকের ছবি মনে হলেও এর পেছনের গল্প করুণ। শাহেদ কোনো সাধারণ শিশু নয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা এক রোহিঙ্গা নারীর সন্তান সে। বাংলাদেশে জন্মালেও তার নেই নাগরিক স্বীকৃতি।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থানরত এই জনগোষ্ঠীতে প্রতিনিয়তই জন্ম নিচ্ছে নাগরিকত্বহীন শিশু; যাদের ভবিষ্যৎ তাদের বর্তমানের মতোই অনিশ্চিত। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ওই ম্যাগাজিন থেকে জানা যায়, সে সময় প্রতিদিন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিত অন্তত ৬০ জন শিশু। এখন সেই হার বেড়েছে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। নাগরিকত্বহীন এসব শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা, শিক্ষার সুযোগ পাওয়া তো দূরের বিষয়; কোনো দেশের নাগরিক না হওয়ার অভিশাপ তাদের বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, বিশ্বে গত বছর নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হওয়া মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১০ কোটিতে। রাজনৈতিক বিরোধ, যুদ্ধবিগ্রহ ও জোরপূর্বক বিতাড়িত হওয়া কার্যত পরিচয়হীন এসব মানুষের জন্য জাতিসংঘ প্রতিবছর বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালন করে। ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছরের ২০ জুন পালিত হয় দিবসটি। আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে এটি আফ্রিকা শরণার্থী দিবস নামে পরিচিত ছিল। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি শরণার্থীর অধিকার, চাহিদা, ভবিষ্যতের দিকটি সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একত্র করার উদ্দেশ্যেই পালিত হয় এই দিবস। শরণার্থীরা যেন কোনোমতে প্রাণে বেঁচে থাকার মধ্যে আটকে না পড়ে বরং ভবিষ্যতে উন্নত একটি জীবন পান, সে লক্ষ্যেও কাজ করা হয়।
নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের কোথাও সত্যিকারের ঠাঁই হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, একবার বিতাড়িত হওয়ার পর তারা আর নিজ ভূমিতে ফিরতে পারেন না। রাজনৈতিক, পক্ষপাতদুষ্ট নানা কারণে বাকি জীবন তাদের কাটাতে হয় আশ্রয়কেন্দ্রেই। আর এ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা যে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই করুণ হয়ে থাকে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ন্যূনতম খাদ্য ও বাসস্থানের অভাব নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটে শরণার্থীদের। নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে শরণার্থীদেরকে এক দেশে থেকে আরেক দেশে পাঠানো হয়। যাযাবর এ জীবনে দুঃসময় তাদের পিছু ছাড়ে না।
শরণার্থীশিবিরগুলোতে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। গত বছর শরণার্থী দিবসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি গবেষণাপত্রের তথ্য প্রকাশ করে। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাদুজ্জামান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইডের আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলামের করা সেই গবেষণায় একাত্তরে বাংলাদেশি শরণার্থীদের করুণ পরিণতির চিত্র উঠে আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে, এ কথা কারও সম্ভবত অজানা না হলেও, সে দেশে যে অনেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তা এত দিন আলোচনায় সেভাবে উঠে আসেনি। ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের মধ্যে কলেরায় মৃত্যু হয় ৩ লাখ ১৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশির; এর মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি ছিল ৫ বছরের কম বয়সী শিশু।
শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো আইডিপিএস, অর্থাৎ ‘ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পারসন’ বা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুতদের নিয়েও কাজ করে। যারা নিজের জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, কিন্তু দেশের সীমানা পার হতে পারেননি, তাদের ফেলা হয় এই তালিকায়। এ মুহূর্তে বিশ্বের যেসব দেশ শরণার্থী সংকটে রয়েছে, তাদের মধ্যে সবার ওপরে সিরিয়া। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম জানায়, দেশটিতে চলমান সংঘাতের কারণে প্রায় ৭ মিলিয়ন সিরিয়ান অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এর বাইরে আরও ৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন সিরিয়ানের শরণার্থী হিসেবে জায়গা হয়েছে লেবানন, তুরস্ক, জর্ডান ও অন্যান্য দেশে। প্রতিবেশী এসব দেশে বসবাসকারী বেশির ভাগ সিরিয়ানের নেই আর্থিক সংস্থান। উদাহরণ হিসেবে লেবাননের কথা ধরা যাক। দেশটিতে যেসব সিরিয়ান আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের দশজনের মধ্যে নয়জনই এখন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছেন। সেই সঙ্গে জনবহুল আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে গাদাগাদি করে অনিশ্চিত জীবন কাটছে তাদের।
তালিকায় এরপরই আছে ইউক্রেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ চালানোর পর থেকে ৭ মিলিয়নের বেশি ইউক্রেনিয়ান অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ মলদোভা, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও বেলারুশে আশ্রয় নিয়েছেন ৬ মিলিয়ন শরণার্থী। এ সংঘাতের কারণে শুধু যে শরণার্থীরাই সংকটে রয়েছেন, তা নয়। বিশ্বের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের একটি বড় অংশই আসে ইউক্রেন থেকে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ৪০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়েছে দেশটি। কিন্তু চলমান সংঘাতের ফলে সামনে চরম ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ৪৭ মিলিয়নে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
‘শরণার্থী’ শব্দটি শুনলে অনেকেরই প্রথমে মনে পড়ে সুদান, বিশেষ করে দক্ষিণ সুদানের কথা। দীর্ঘ ২০ বছরের সংগ্রাম শেষে ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুদানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় দেশটি। নতুন এক ভবিষ্যতের আশা নিয়ে দক্ষিণ সুদান যাত্রা শুরু করলেও মাত্র দুই বছরের মধ্যে তা ভেস্তে যায়। ক্ষমতাসীন দল এবং সুদান পিপলস লিবারেশন আর্মির (এসপিএলএ) মধ্যকার সংঘাত দেশটিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে এখনো চলছে সহিংসতা। এ সংঘাতে ইতিমধ্যে দক্ষিণ সুদানের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৪ মিলিয়নের বেশি নাগরিক হয়েছেন ঘরছাড়া। অনেকে দেশের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত অবস্থায় থাকলেও ২ মিলিয়নের বেশি মানুষ পাড়ি জমিয়েছেন প্রতিবেশী ইথিওপিয়া, সুদান ও উগান্ডায়। স্বভাবতই এদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। দুর্বল, রোগা ও অপুষ্টিতে ভোগা এই মানুষগুলো কোনোমতে প্রাণ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। অন্য দেশে গিয়েও যে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তা নয়। বেশির ভাগ সময়ই অস্থায়ী, ভঙ্গুর তাঁবুসদৃশ আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা হয় তাদের। গত বছর দক্ষিণ সুদান খাদ্যনিরাপত্তার দিক দিয়ে সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছিল। তার রেশ রয়ে গেছে এখনো। দেশটির প্রায় ৮ মিলিয়ন মানুষ চরম মাত্রার খাদ্যসংকটে ভুগবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগের কাছেই পৌঁছবে না কোনো ধরনের সাহায্য। এসব অনাহারী মানুষের জন্যই জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ২০১১ সাল থেকে (এর আগে ১৯৬৩ সাল থেকে সুদানের অংশ হিসেবে) দেশটির সব অঞ্চলের মানুষকে সহায়তা দেওয়ার প্রয়াস চালাচ্ছে।
এ তো গেল যুদ্ধবিগ্রহ বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জাঁতাকলে পড়া শরণার্থীদের চিত্র। এবার কল্পনা করুন তো, কোনো বিধ্বংসী বন্যার কারণে আপনার বাড়ি, জীবিকা—সব নিঃশেষ হয়ে গেল; কিংবা তীব্র খরার কারণে আপনাকে ভুগতে হচ্ছে অনাহারে; অথবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ন্যূনতম পানীয় পাচ্ছেন না! জলবায়ু সংকটের ফলে এ ধরনের প্রতিকূল বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন বিশ্বের লাখ লাখ ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ বা জলবায়ু শরণার্থী। নিকট ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি যেভাবে বাড়বে, একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে তাদের সংখ্যাও, এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু সংকটের ফলে সৃষ্ট বন্যা, ঝড়, দাবানল এবং চরম তাপমাত্রার কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাঙ্ক আইইপি [ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস] সতর্ক করে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন।
ক্লাইমেট রিফিউজিদের এ সংকট মোকাবিলার একটি উপায় হলো, পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে থাকা অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক সুযোগের প্রসার ঘটানো। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। এ দেশে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে চাষের জমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। তবে সম্প্রতি কৃষকেরা ডাচ গবেষণা প্রকল্প ‘সল্ট সলিউশন’ এবং স্থানীয় এনজিওর সহায়তায় নতুন এই অবস্থার সঙ্গে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন। তাদের সহায়তায় লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোর কৃষকেরা আলু, গাজর, বাঁধাকপি, ধনেসহ লবণসহিষ্ণু ফসল চাষ করতে পারছেন। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা মূলত দেশের দক্ষিণাঞ্চলেই আশ্রয় নিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে শরণার্থীশিবিরের কিছু অংশে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ রোপণের পরামর্শ দিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
জাতিসংঘ যদিও বারবার প্রতিকূলতা এড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে, কিন্তু এসবের জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। ২০২২ সালের নভেম্বরে জলবায়ু সম্মেলন কপ২৭-এ এক যুগান্তকারী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল দিতে সম্মত হয় বিশ্বের প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। নতুন এ তহবিল নিয়ে যদিও বিশদ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তবু জলবায়ু সংকট ও জলবায়ু শরণার্থীদের জন্য আশার আলো এই উদ্যোগ।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট