দৃশ্যভাষ্য I মায়াবী মর্মর
মাইনবোশার করসেট। সময়োত্তীর্ণ আলোকচিত্র। রক্তমাংসের মানুষের যেন মর্মর পাথরের জীবন্ত ভাস্কর্যে রূপ নেওয়া
‘ফ্যাশন হলো সময়ের অভিব্যক্তি। লালিত্য অন্য কিছু,’ হর্স্ট পি হর্স্টের বিখ্যাত উক্তি। এই আলোকচিত্রীর তোলা ছবিগুলোতে ফ্যাশন ও লালিত্য—উভয়ই তার কর্মমুখর সময়কালকে একই সঙ্গে সংজ্ঞায়িত ও অতিক্রান্ত করেছে। সাত দশকের ক্যারিয়ারে বিশ শতককে তিনি ফ্যাশন ও পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির প্রেক্ষাপটে যে উঁচু স্থানে নিয়ে গেছেন, তা খুব কম আলোকচিত্রীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।
জন্মগত নাম হর্স্ট পল আলবার্ট বরমান। জার্মানির বর্তমান সাক্সোনি-আনহাল্ট রাজ্যে ১৯০৬ সালের ১৪ আগস্ট এক বিত্তশালী বুর্জোয়া পরিবারে জন্ম। হর্স্ট পি হর্স্ট নামে খ্যাত এই জার্মান-আমেরিকান ফ্যাশন ফটোগ্রাফার পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন ১৯৯৯ সালের ১৮ নভেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। তার নাম পরিবর্তনের নেপথ্যে রয়েছে চমকপ্রদ যুক্তি। জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের ঘনিষ্ঠতম লেফটেন্যান্ট এবং নাৎসি পার্টি চ্যান্সেলারির প্রধান কর্তা মার্টিন বরমানের সঙ্গে যেন তার নামের মিল খুঁজে না নেয় কেউ, এ জন্যই প্রথম শব্দ ‘হর্স্ট’ ঠিক রেখে, তারপর ‘পল’ শব্দের আদ্যক্ষর ‘পি’ বসিয়ে, শেষ শব্দ হিসেবে আবারও ‘হর্স্ট’ জুড়ে দিয়ে, নাম থেকে বাকি শব্দগুলো ছেঁটে নিয়েছিলেন।
১৯৩০ সালে হর্স্ট প্যারিসে পাড়ি জমান সেখানকার বিখ্যাত স্থপতি লো করবুসার শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু নিয়তি যেন অন্য কিছু লিখে রেখেছিল সে সময়কার তরুণ এই শিল্পীর জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব প্যারিসে এক উৎফুল্ল জীবন উপভোগ করতে থাকেন তিনি। কিংবদন্তি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল, ফিল্ম স্টার মার্লিনা ডিট্রিশ ও নাট্যকার নোয়েল কাওয়ার্ডের মতো আইকনদের আর্টিস্টিক সার্কেলগুলোতে আড্ডায় মেতে ওঠেন। বলা বাহুল্য, এরা প্রত্যেকেই একটি সত্যিকারের আধুনিক যুগের গ্ল্যামার, স্টাইল ও এলিগেন্সের আইকনোগ্রাফিকে সংজ্ঞায়িত করতে অবদান রেখে গেছেন।
প্যারিসের সেই রঙিন দিনগুলোতেই ভোগ ম্যাগাজিনের ফটোগ্রাফার ব্যারন জর্জ হয়নিঙ্গেন-হিউইনের সঙ্গে দেখা করেন হর্স্ট; তার সহকারী, কখনো আবার মডেল হিসেবে কাজে হাত দেন। হর্স্টের তোলা প্রথম ছবি প্রকাশ পায় ১৯৩১ সালের ডিসেম্বরে, ফ্রেঞ্চ ভোগ ম্যাগাজিনে। সেটি ছিল একটি পারফিউমের বিজ্ঞাপনের ছবি। পরের বছরই তার আলোকচিত্রের প্রদর্শনী বেশ সাড়া ফেলে। ১৯৩৫ সালে ব্যারন চাকরি ছেড়ে দিলে ভোগের প্রধান আলোকচিত্রীর দায়িত্ব পান হর্স্ট। ওই ম্যাগাজিনের সঙ্গে তার তিন দশকের কর্মসম্পর্ক বস্তুত ফ্যাশন ও পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির ভাষাকেই চিরতরে পাল্টে দিয়েছে বলে অভিমত বোদ্ধাদের।
১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান হর্স্ট। এরপর আমৃত্যু সেটিকেই নিজের দেশ বলতেন। ফ্রান্স ছাড়ার অল্পক্ষণ আগে, ফ্রান্সে তোলা তার সর্বশেষ আলোকচিত্র ‘মাইনবোশার করসেট’। ছাপা হয় সে বছরের ডিসেম্বরে, ফ্রেঞ্চ ভোগে। এই সাদাকালো ছবিতে মডেলকে দেখা যায় পেছন ফেরা অবস্থায়; যেন নিজের পরিহিত করসেটের পাক খুলছেন। এটি পরিণত হয় হর্স্টের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আইকনিক সৃষ্টিকর্মের একটিতে। আলোছায়ার অদ্ভুত মায়া ছড়ানো এই আলোকচিত্র প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে হর্স্ট বলেছেন, ‘লাইটিং আসলে কারও ভাবনার চেয়েও অধিক জটিল বিষয়! (এই ছবি দেখে) মনে হতে পারে, এখানে হয়তো একটিমাত্র লাইট সোর্স ব্যবহার করেছি। অথচ সত্যি হলো, রিফ্লেক্টর এবং অন্যান্য স্পটলাইটও ব্যবহার করেছি আমি। কাজটি কীভাবে করেছি, আসলেই জানি না! এমন কাজের পুনরাবৃত্তি করা আমার পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়।’
যৌন সংবেদনশীলতা ও কামবাদের রেশ ছড়ানো, অভ্যস্ত শালীনতাবোধে মারাত্মক আঘাত হানার অনূভূতি জাগানো এই আলোকচিত্র ছিল সময়ের চেয়ে অনেক আগুয়ান। তার প্রমাণ মেলে বহু বছর পর, ১৯৯০ সালে পপসম্রাজ্ঞী ম্যাডোনার হিট গান ‘ভোগ’-এর মিউজিক ভিডিওতে এটির আবেদন ও আবহের পুনঃসৃষ্টি থেকে; যেটি বস্তুত বলরুম কালচার, হাই ফ্যাশন ও হলিউড গ্ল্যামারের প্রতিচ্ছেদের প্রতি একটি পপ গীতিকাব্য। হর্স্টের কাছে আলোকচিত্রটি এমন এক যুগের সমাপনীর প্রতীক, যেটি তার জীবনে রূপান্তর ঘটিয়ে নিজেকে বিশ্বভ্রমণের যাত্রা শুরুর প্রেরণা দিয়েছে।
‘ছবিটি যখন তুলছিলাম, বারবার মনে হচ্ছিল, (নিজের জীবনের একটি বিশেষ যুগকে) আমি পেছনে ফেলতে যাচ্ছি,’ বলেছেন হর্স্ট; জানতেন, জীবন ও পৃথিবী তার কাছে আর আগের মতো থাকবে না। ‘প্যারিস ছেড়ে যাব বলেই শুধু নয়, যুদ্ধ আসন্ন—এই অনুভূতি তীব্র হয়েছিল বলেও ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল আমার। আমরা বিদায় নিয়ে কথা বলছিলাম; আর মেয়েটি (অর্থাৎ এই ছবির মডেল) সারাক্ষণ কাঁদছিল। এরপর আমি তার করসেটের একটুখানি পাক খুলে দিলাম। আর তাতে ছবিটি এমন দাঁড়াল; কেননা, এটি ছিল ফ্রান্সকে একটি বিদায়জ্ঞাপন।’
যুদ্ধপূর্ব সময়কাল এবং বিশ শতকের আলোকচিত্রের একটি আইকনে পরিণত হওয়া ‘মাইনবোশার করসেট’-এ হর্স্টের সিগনেচার লাইটিং টেকনিক, গভীর ছায়া ও উজ্জ্বল হাইলাইটের প্রয়োগ মডেলটির সুনিপুণ পেশিবিন্যাসকে জোরালো করে তুলে এই নারীকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আধুনিক নারীর ভূমিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে পরিণত করেছে এক জীবন্ত ‘ধ্রুপদি’ ভাস্কর্যে। এই আলোকচিত্রের পরিবেশ সুচারুভাবে সরল; মর্মর প্রস্তরখণ্ডে গড়া একটি সমতল স্তম্ভশ্রেণি এই ইমেজকে দ্বিখণ্ডিত করে দিয়েছে, যা শীতল পাথর ও উষ্ণ মাংসের মধ্যে ঘটিয়েছে এক কার্যকর সন্নিবেশ। এই আবেদন ছড়ানো ছবিতে মডেলটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তার চাহনি দর্শকের কাছ থেকে আড়ালকৃত; আর স্তম্ভশ্রেণিটির কোনাজুড়ে তার করসেটের আংশিকভাবে জরিযুক্ত ফিতাগুলোর প্রবাহ রেখেছে জট পাকিয়ে। হর্স্ট একবার বলেছিলেন, ‘আমার তোলা সেরা ছবিগুলো সব সময়ই খানিকটা আলুথালু।’ এই আলোকচিত্রে তার শিল্পপূর্ণ ‘আলুথালু’ রূপটি মডেল ও পোশাক—উভয়ের দৃশ্যত নিখুঁত হওয়ার বিপরীতে একটি যথার্থ কাউন্টারপয়েন্ট।
যেমন ইঙ্গিত আগেই রয়েছে, এই ফটোশুট শেষ করার পরপরই ফ্রান্স ছেড়েছিলেন হর্স্ট। স্মৃতিচারণায় তিনি বলে গেছেন, ‘আমি স্টুডিও ছেড়েছি ভোর ৪টায়। তারপর বাড়ি ফিরে, ব্যাগ গুছিয়ে, সকাল ৭টার ট্রেন ধরেছি জাহাজঘাটে পৌঁছানোর জন্য।’ তারপর জাহাজে চেপে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান তিনি। নতুন দেশে এসে ফ্যাশন ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন; অবশ্য বাধা হয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যেটির সূচনা ঘটেছিল ‘মাইনবোশার করসেট’ তোলার সপ্তাহ দুয়েক পরেই। যুদ্ধের দিন ফুরোলে, ফ্যাশন ফটোগ্রাফির হাই এন্ডে আবারও কাজে ফেরেন এই আলোকচিত্রী; ইউএস ভোগ ম্যাগাজিনে রাখতে থাকেন নেতৃস্থানীয় অবদান।
সূত্র: ব্লাইন্ড ম্যাগাজিন; ন্যাশনাল গ্যালারি অব ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া; হোল্ডেন লুনৎস গ্যালারি, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
লাইফস্টাইল ডেস্ক