skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I জলনিধির শহর আগাদির

মরক্কোর গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর। নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের খনি! ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান

আজ দুপুরে এসেছি আগাদিরে। মারাক্কেশ থেকে বাসে করে চার ঘণ্টায়। ঝকঝকে বাস আর চকচকে, মসৃণ পথঘাট। বাসস্ট্যান্ডও খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মরক্কোকে আসলে আফ্রিকার কোনো দেশ বলে মনে হয় না। অবস্থান কাছাকাছি হওয়ায় আচারবিধি, সংস্কৃতিতে ইউরোপের ছাপ প্রকট।
আগাদিরকে বলে রিসোর্ট সিটি অব মরক্কো। সমুদ্রসৈকতের শহর বলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে আসেন অবকাশ যাপনের জন্য। ট্যাক্সিতে চেপে হোটেলে যেতে যেতে আমার মনে হলো, খুব সাজানো-গোছানো ছিমছাম শহর এটি। উঁচু দালান একেবারেই নেই। আলাদা আলাদা এলাকায় একই রকমের দোতলা বা তিনতলা বাংলো ধাঁচের বাড়িগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির সামনে খোলা উঠোন, পেছনে বড় বড় পামগাছ। জনসংখ্যা এত কম, পথে কাউকে দেখলাম না।
দুপুরের খাবারের জন্য হোটেলের পাশেই অনেক রেস্তোরাঁ আছে। পৃথিবীর সব ধরনের খাবার এ রেস্তোরাঁগুলোয় পাওয়া যায়। এর মাঝে ভারতীয় রেস্তোরাঁও আছে। আমি স্থানীয় রেস্তোরাঁয় প্রিয় খাবার তাশিন অর্ডার করলাম। তাশিন আমার কাছে স্বর্গীয় খাবারের মতো। রান্নার পদ্ধতিও চমকপ্রদ। প্রথমে একটি মাটির পাত্রে পেঁয়াজ কেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়; এরপর তার ওপর বাটা আদা, রসুন, মরিচ, হলুদ, ধনেগুঁড়া ছড়িয়ে অলিভ অয়েল দিয়ে ভালোভাবে মেশানো হয়। আগে থেকেই খানিকটা জাফরান ভিজিয়ে রেখে দেওয়া হয়। জাফরান আর অলিভ মসলার সঙ্গে মিশিয়ে নেওয়া হয়। যেকোনো মাংস ভালোভাবে ধুয়ে মসলার ওপর সাজানো হয়। মাঝে মাঝে আস্ত মুরগি বসিয়ে দেওয়ার চল রয়েছে। এরপর লম্বা করে কেটে রাখা গাজর, জুকিনি, বিনস মাংসের ওপর পিরামিড আকারে সাজিয়ে উঁচু গোলাকার মাটির ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এই ঢাকনা আর খোলা হয় না। পাত্রটি অল্প আঁচে কয়লার চুলায় রান্না হতে থাকে। রান্না হয়ে গেলে ঢাকনাসহ পরিবেশন করা হয়। তাশিন যে পাত্রে রান্না করা হয়, তাকেও তাশিন বলে।
আমার টেবিলে তাশিন পরিবেশন করার পর ওয়েটার সেই সুদৃশ্য নকশা করা মাটির পাত্রের ঢাকনা খুলতেই সুবাসিত বাষ্পে চারপাশ ভরে গেল। ঘ্রাণেন্দ্রিয় জেগে উঠল নেচে! এবার খাওয়ার পালা। মুরগির টুকরো প্লেটে নিয়ে একটু একটু করে ছুরি আর কাঁটাচামচ দিয়ে কেটে মুখে দিতেই মিলিয়ে গেল টেস্টবাডের সঙ্গে। তাশিন আর স্বাদেন্দ্রিয়ের মেলবন্ধন এত ভালো, এর সঙ্গে খাবার জন্য আর কিছু লাগে না। তাশিনের সঙ্গে অবশ্য মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী রুটি পরিবেশন করা হয়েছিল। কিন্তু রুটির জায়গায় রুটি পড়ে রইল, আমি তাশিন খেতেই ব্যস্ত।
তাশিন খেয়ে চললাম সমুদ্রসৈকতের দিকে। ম্যাপে দেখাচ্ছে, ডানে গিয়ে বাঁয়ে যেতে হবে। সামনে সারি সারি স্যুভেনির শপ। বোঝাই যাচ্ছে, সৈকত কাছেই কোথাও। মরক্কোর জনসাধারণ আরবি ভাষায় কথা বলে। তবে স্থানীয় ব্যারব্যার জনগোষ্ঠীর মানুষজন আমাজিগ ভাষায় কথা বলে আর মরক্কোর দাপ্তরিক ভাষা ফ্রেঞ্চ। আমার ফ্রেঞ্চ ভাষাজ্ঞান ঠনঠনে! আর বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কোন পথ ধরে সৈকতে গেলে সুবিধা হবে।
পথেই কয়েকটি আলিশান শপিং মল আর ব্র্যান্ডের দোকান চোখে পড়ল। এ শহরের দালানকোঠা দুই বা তিনতলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শপিং মলগুলোও একই উচ্চতার। শপিং মল বা ব্র্যান্ডের দোকানগুলো থেকে ঢুকছে আর বের হচ্ছে অত্যাধুনিক পোশাক পরিহিত মরোক্কান ছেলেমেয়েরা। মরক্কোর মেয়েদের পোশাক খুবই আধুনিক। কেউ কেউ মিডি বা স্লিভলেস জামা পরেও ঘুরছে।
ম্যাপের ধারাভাষ্য বুঝতে না পেরে পথে একসময় একটি মেয়ের কাছে খুব গর্বভরে সমুদ্রসৈকত কোথায় তা জানতে চাইলাম। ফ্রেঞ্চ ভাষায় সমুদ্রসৈকতকে ইংরেজি অক্ষরে লেখা হয় পি-এল-এ-জি-ই। ভাবলাম, এ আর এমন কি উচ্চারণ; খুব বেশি হলে হবে প্লেইগ অথবা প্লেইজ! কিন্তু এসব আজব শব্দ বলাতে মেয়েটি আরও ভাবনায় পড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি ফোনে টাইপ করে দেখালাম। দেখে মেয়েটি বললেন, ‘লা প্লাশ’! আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। প্লাশকে এতক্ষণ কী কী নামে যে ডেকেছি!
সামনের রাস্তাটা আমায় নিয়ে গেল যেন স্বর্গের দুয়ারে। ফুটপাত ভরে আছে নানা রঙের ফুলে। বাগানবিলাসের বিলাস যেন শেষ হতে চাচ্ছে না। আরও কতশত রঙের ফুল যে ফুটপাতে আলো ছড়াচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। এই রাস্তা পেরিয়ে এগোলেই হাতের বাঁ দিকে লা প্লাশ বা আগাদির সমুদ্রসৈকত। এখন দুপুরের রোদ অস্তাচলের দিকে নুয়ে পড়ছে। একটু মেঘ করেছে; তাই রোদে হাঁটতে ভালো লাগছে।
একটি মসজিদের উল্টো দিকের পথ সোজা চলে গেছে সৈকতের দিকে। বেশ খানিকটা হেঁটে তবেই সৈকতের দেখা মিলল। সমুদ্রের অথৈ পানি এখন নীলে ছলাৎ ছলাৎ করছে। যত দূর চোখ যায়, সামনে শুধুই নীল রঙের তোলপাড়। সামনের তটে খানিকটা সোনালি রং তুলি দিয়ে এঁকেছে প্রকৃতি। এই নীল সায়রে নেমে গেছে একদল ছেলেমেয়ে। কেউ ভাসছেন, কেউ সাঁতার কাটছেন, কেউবা তটে বসে রোদ পোহাচ্ছেন, কেউ করছেন পিকনিক। বেশির ভাগই স্থানীয় ট্যুরিস্ট। এই দুপুরেও উৎসবের কমতি নেই।
সামনে সোজাসুজি আকাশ আর তটের ডান দিকে একটু দূরে এক পাহাড়। মরক্কোর শহরে বন্দরে পাহাড়ের দেখা পাওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এই পাহাড়ের পা ধুইয়ে দিচ্ছে সাগরের জল। তবে একে সাধারণ কোনো পাহাড় মনে হচ্ছে না। পাহাড়ের গায়ে আরবিতে কিছু লেখা আছে। এর পাদদেশেই স্যুইমস্যুট পরে ছেলেমেয়েরা জলে নেমেছেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, একটি মুসলিম দেশে আরবি লেখা পাহাড়ের সামনে সাঁতারের পোশাক পরে জলকেলি করতে কারও একটু বাধছে না!
এদিকে শান্ত স্রোত একে একে ছড়িয়ে দিচ্ছে নিজের গড়া মুক্তোর মালা সোনালি তটে। আমি এক কোনায় চাদর বিছিয়ে বসে পড়লাম। পিকনিকের কিছু জিনিসপত্রও নিয়ে এসেছি। একটি ছেলে এসে জানতে চাইলেন, সি স্কুটারে চড়ে মাঝ সমুদ্রে যেতে চাই কি না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাঝ সমুদ্রে একা একা যেতে দেবেন?’ বললেন, ‘না।’ এমন জবাবে আগ্রহ মিলিয়ে গেল আমার। আসলে এরা কখনোই মাঝ সমুদ্র অবধি যেতে দেন না। অনুমতি নেই। কোনো দেশেই নেই। ট্যুরিস্টকে আকৃষ্ট করার জন্য এমনটা বলেন। আমি অনেক দেশে সি স্কুটারে চড়ে তটের কাছাকাছি খানিক এদিক-সেদিক ঘুরেছি। অভিজ্ঞতা যে একেবারেই নেই, তা নয়। তাই আপাতত নীল সাগর দেখায় মন দিলাম। এখন আর কেউ বিরক্ত না করলেই হয়!
সামনে একটু একটু করে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে। আমার পাশে চাদর বিছিয়ে বসেছে এক বৃদ্ধ যুগল। তারাও বেশ পিকনিক মুডেই আছেন। আমাদের দেশে কল্পনা করা যায় না ষাটোর্ধ্ব যুগল পার্কে বসে সময় কাটাচ্ছে বা সমুদ্র দেখতে ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি বাড়িতে রেখে শুধু নিজেদের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য এসেছে। অনেক দেশে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, জীবন শুধু কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়; একে যাপন করার উপায় জানা থাকতে হয়। না হলে সবকিছু বড় পানসে লাগে!
সূর্য এখন হেলে পড়েছে। সমুদ্র নীল থেকে সোনালি, সোনালি থেকে কমলা, কমলা থেকে গোলাপি হতে হতে মিলিয়ে যেতে চাইল আকাশের সঙ্গে; কিন্তু সাগর তাকে ছাড়তে নারাজ। আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে। যেন ভাবছে, যতখানি সূর্যের কিরণ ধরে রাখা যায়, তাতেই অনেকখানি প্রাপ্তি।
সূর্য ডুবে গেলেও সাগরপাড়ে বেড়াতে আসা মানুষদের কেউ চলে যাননি। এদের দেখে মনে হচ্ছে, সবে উৎসব শুরু হয়েছে, রাতভর উদ্‌যাপন করা বাকি। আমি আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে সাগরের ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শুনে ফিরে এলাম হোটেলে।
পরদিন প্রথমে ঠিক করলাম, এখানকার মেদিনায় যাব। মেদিনা মানে পুরোনো শহর। মরক্কোর প্রায় সব উল্লেখযোগ্য শহরেই মেদিনা আছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য এরা মেদিনাকে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে উপস্থাপন করে। তবে যেকোনো মেদিনার প্রধান আকর্ষণ এর রঙিন বাজার। মরক্কোর মেদিনার বাজার, এর অলিগলি বা সুকের মতো এত রঙিন বাজার আমি আর কোনো দেশে দেখিনি।
আগাদির একটি প্রাচীন শহর। ১৩২৫ সালে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবে স্থানীয় ব্যারব্যার জনগোষ্ঠীর বসবাস এখানে আরও আগে থেকে। ১৫০৫ সালে আগাদির দখল করে পর্তুগিজরা। এর কিছুদিন পর মরক্কোর মুসলমান শাসক এ শহর দখল করে নেন। ১৭৩১ সালে শহরটি ভূমিকম্পে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৮১ সালে আগাদিরের সমুদ্রবন্দর ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য চালু করা হয়। তখন থেকে শহরটি একটু একটু করে আবার নিজ রূপে ফিরে আসে। তবে ১৯৬০ সালে ভূমিকম্পে আগাদির আবারও প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়। আমি যে মেদিনায় যাব, তা সেই ধ্বংসযজ্ঞের পরে নির্মিত। বর্তমানে আগাদির মরক্কোর অন্যতম বাণিজ্যিক সমুদ্রবন্দর।
আমার হোটেল থেকে মেদিনায় ট্যাক্সিতে চেপে যেতে ১০ মিনিটের মতো লাগল। আগাদিরের ট্যাক্সিচালকদের ভদ্রতায় আমি মুগ্ধ। কেউ বেশি ভাড়া চান না। আর মরক্কোর গাড়িচালকেরাও ভীষণ ভদ্র। কেউ রাস্তা পার হতে চাইলে, গাড়ি থামিয়ে, আগে তাদের নিরাপদে পারাপারের সুযোগ দেন। এদের কাছে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক। মানুষকে এরা মূল্যবান ভাবেন, মূল্যায়ন করেন।
মেদিনা দেখতে পুরোনো দিনের অলিগলিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো মহল্লার মতো। সোনালি পাথরের বাড়িঘর আর গোলাকার দরজা দিয়ে শুরু ও শেষ হয় প্রতিটি গলি। মেদিনার সুক বা বাজারে ঢুকে এমন এক রঙের রাজ্য দেখে দিশেহারা হয়ে গেলাম। দেশের প্রতি কোনা থেকে হস্তশিল্প এনে জড়ো করা হয়েছে এই বাজারে। প্রথমেই সিরামিকে চিত্রিত জিনিসপত্রের দোকান মিলল। এক দোকানেই সূক্ষ্ম কারুকাজে চিত্রিত এত রকমের সিরামিকের রংবেরঙের প্লেট, বাটি, ফুলদানি, ল্যাম্প, শোপিস, তাশিন পাত্র, ওয়াল হ্যাংগিং ইত্যাদি দেখে আমার চোখের পলক পড়ছিল না। একেকটি পণ্য একেক রঙের; তার ওপর তুলির আঁচড়ে নানা রঙের সূক্ষ্ম নকশা।
এরপর সারি সারি দোকানে শুধু একেক পর এক রঙের রাজ্যে বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। পরের কয়েকটি দোকানে মিলল ভেড়া, ছাগল, উটের চামড়া দিয়ে তৈরি নানা ধরনের ব্যাগ, জুতা, কুশন কভার ইত্যাদি। ব্যাগের দোকানে ঢুকে খেই হারিয়ে ফেললাম। এত রঙের, এত রকমের, এত শৈল্পিক ব্যাগ আগে কোথাও দেখিনি। স্লিং ব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ, ট্রাভেল ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, ব্যাকপ্যাক, টোট ব্যাগ…কী নেই এখানে! রঙের কথা কী আর বলব। অনেকে বলেন, চামড়াজাত পণ্যে নাকি রঙের ব্যবহার তেমন করা যায় না। আসলে চামড়াজাত পণ্য সব রঙেই রাঙানো যায়, তার জন্য চাই ক্রেতা। আর এই রং কিন্তু কেমিক্যালে তৈরি নয়, একেবারে ন্যাচারাল কালার; মানে বিভিন্ন রঙের ফুল, ফল, মাটি, গাছের বাকল ইত্যাদি দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি রঙে রাঙানো সব চামড়াজাত পণ্য। এ দেশে চামড়াশিল্পের বিশাল এক বাজার আছে। স্থানীয়রা তো কেনেনই, ট্যুরিস্টদেরও সুকে হাঁটতে হাঁটতে চামড়াজাত পণ্যে চোখ ও মন—দুই-ই আটকে যায়। সঙ্গে রাখা দিরহাম খরচ করতে তাই বাধে না।
আমার চোখ এখন আটকে আছে টিল কালারের একটি স্লিং ব্যাগে। পণ্যটি মোটেই হাতছাড়া করা যাবে না। দামাদামি করে কিছু দিরহাম খসিয়ে নিজের শপিং সেন্সের বিষয়ে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বের হলাম চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য দেখতে। পরপর কয়েকটি ব্যাগের দোকানের পর জুতার দোকান। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, দোকানের আপাদমস্তক জুড়ে কেউ নানা রং দিয়ে ক্যানভাসে এঁকেছেন এক চিত্র। কাছে গেলে বোঝা যায়, নানা রঙের জুতা পাশাপাশি লাইন করে সাজানো। বিভিন্ন আকার ও নকশার জুতা দেখতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল।
স্থানীয় ভাষায় এই জুতাকে বলা হয় বাবোশ। দেখতে পুরোপুরি বন্ধ বা পেছন দিকে খোলা পাম্প শুর মতো। স্থানীয় প্রায় সবাই বাবোশ পরে চলাফেরা করেন। আমি এখানেও আটকে গেলাম লাল বাবোশ দেখে। মেয়েদের জুতাকে বলে শেরবিল। জুতা চামড়ার ছাড়াও সিল্ক বা ভেলভেট কাপড়ের ওপর এমব্রয়ডারি করে তার ওপর জরি, চুমকি বসানো। কিছু শেরবিলে ওয়েজ হিলও থাকে। অনেক ডিজাইনের চামড়ার তৈরি মেয়েদের স্লিপারও সাজানো আছে।
জুতার রাজ্য থেকে গেলাম ল্যাম্পের দোকানে। ব্রোঞ্জ বা পিতলের তৈরি সূক্ষ্ম জালি কাটওয়ার্ক করা ছোট থেকে বড় সব আকারের, সব ধরনের ল্যাম্প সাজানো আছে পাশাপাশি বা ওপরে-নিচে। কোনো কোনো ল্যাম্প লম্বায় ৬ ফুটের বেশি, কোনোটা চওড়ায় বড় গামলা আকারের, কোনো ল্যাম্প কয়েক ইঞ্চির, কোনোটা এতই রাজকীয় যে দোকানের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। ল্যাম্পগুলো জ্বালিয়ে রাখলে নকশা করা সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে নানা নকশার আলো বিচ্ছুরিত হয়ে ঘরের চার দেয়ালে এক নকশাময় জগৎ তৈরি করে।
ল্যাম্পের দোকানগুলোর পাশেই আছে মরক্কোর বিখ্যাত কার্পেট বা রাগ। এগুলোর রং বাহারের সীমা নেই। সীমা নেই নকশার। দোকানের সামনে আর দেয়ালে নানা আকারের, নানা রঙের রাগ ঝোলানো। এসব রাগ ভেড়া বা উটের পশম দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া আরও অনেক দোকানে কাচের ল্যাম্প, টি সেট, নানা শো পিস, কাঠের তৈরি জিনিসপত্র, নানা হস্তশিল্প, জেলাবা (পুরুষদের স্থানীয় পোশাক), কাফতান (নারীদের স্থানীয় পোশাক) ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে।
শৌখিন বাজারের এক পাশে মূল ভবনের বাইরে পথের দিকে সারি সারি দোকানে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের অলিভ। মরক্কো একসময় পৃথিবীতে অলিভ উৎপাদনে শীর্ষে ছিল। অলিভের দোকানের পাশে বড় বড় কাচের বয়ামে বিভিন্ন ফল ও সবজি ভিনিগারে ডুবিয়ে আচার বানিয়ে রাখা। এসব দোকানের পাশে বিভিন্ন মিষ্টির দোকান। এক দোকানে শ-খানেক পদের মিষ্টি থরে থরে সাজানো। মিষ্টির দোকানের পাশে বিভিন্ন ধরনের বাদামের দোকান। তার পাশে ফল আর রুটির দোকান।
বাজার ঘুরে আমি আবার মেদিনার মূল ভবনে হাজির হলাম। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; কিছু খেতে হবে। আমার আরেকটি প্রিয় মরোক্কান খাবার কুসকুস। সুজির পোলাও বলা চলে। এর মাঝে বিভিন্ন ধরনের সবজি, মুরগি বা ভেড়ার মাংস, ড্রাই ফ্রুটস, কিশমিশ দিয়ে প্রায় একধরনের রাজকীয় খাবার বানিয়ে ফেলা হয়। কুসকুস খেয়ে আর সেখান থেকে উঠতে মন চায় না! মনে হয় সেখানে বসেই কুসকুসের গুনগান করি। সঙ্গে অবশ্যই ছিল মরক্কোর বিখ্যাত পুদিনাপাতার চা।
মেদিনা থেকে যাব পাহাড়ের ওপরে। সেখানে যেতে হলে পাহাড় চড়তে হবে। আরেকটি সহজ উপায় আছে, কেবল কার। সহজ উপায়ই বেছে নিলাম। টিকিট কেটে ক্যাবল কারে বসতেই পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাকে পাহাড়ের ওপরের জগতে নামিয়ে দিল। ষোলো শতকে এই পাহাড়ের ওপর মরক্কোর সুলতান একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তবে আসল দুর্গটি এখন আর অক্ষত নেই। ভূমিকম্পে বিলীন হয়ে গেছে। এখন নতুন করে একই আদলের একটি দুর্গের মতো অবয়ব তৈরি করে রাখা হয়েছে।
পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো আগাদির শহর দেখা যায়। কাল বাসস্টেশন থেকে আসার সময় ভেবেছিলাম, এ শহরে বহুতল ভবন নেই। এদিকটায় বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনের দেখা পেলাম। সবই সারি সারিভাবে পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত। আর অনুচ্চ ভবনগুলো ভেলার মতো ভাসছে সাগরের নীল জলে। জলে আরও ভাসছে সাদা রঙের পালতোলা তরী। মনে হচ্ছে এখনই পাল তুলে রাজহাঁসের মতো ভেসে যাবে অজানা কোনো বন্দরের দিকে। আর সাগরের তট গোল হয়ে একটি হীরের নেকলেস পরিয়ে দিয়েছে নীল সাগরের গলায়। সমুদ্রের বোধ হয় এর চেয়ে মূল্যবান উপহার আর মেলেনি; এত মূল্য আর কেউ দেয়নি তাকে। দুপুরের রোদে নীল সাগর, সোনালি তট, আশপাশের শীতল বাতাস, এই যাযাবরের জীবন—সব যেন সমুদ্রকে মনে রাখার, তাকে মূল্য দেওয়ার ইচ্ছায় রত রয়েছে।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top