বিশেষ ফিচার I সৌদিতে সিনেমার মজমা -বিধান রিবেরু
ঘণ্টা দুয়ের ভেতরেই আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ। কিছুক্ষণের জন্য আমার ব্যক্তিগত চিত্রগ্রাহক হয়ে যান মাদাগাসকারের তরুণ চলচ্চিত্র সমালোচক আয়িন রানদ্রিয়ানাতোনদ্রো। আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন ইতালির পাওলা ক্যাসেলা, তিনি ফিপ্রেসির (চলচ্চিত্র সমালোচকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন) ভাইস প্রেসিডেন্ট। এলেনার কথা আগেই বলেছি, তিনিও ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভাইস প্রেসিডেন্ট এখন তিনজন। আহমেদ শাওকি তৃতীয়জন। জাদুঘর পরিদর্শনে শাওকি আসেননি। ইতিহাস দর্শনে শরিক হয়েছিলেন পোল্যান্ডের ওলা, ব্রাজিলের মারসেলো, বুলগেরিয়ার বোজিদার, আরমেনিয়ার ডিয়ানা, মিসরের কিন্তু জার্মানপ্রবাসী হোশেম ও মেসিডোনিয়ার ম্যারিনা।

ডিপার্টমেন্ট স্টোর বন্ধ দেখে হতাশ নয় কেউ, বরং ছবি তুলে উৎফুল্ল
আমাদের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা ছিল। কাজেই ঘোরাঘুরিতে কোনো বাধা ছিল না। শুধু গাড়ি ব্যবস্থাপককে জানালেই হতো, গাড়ি হাজির। আমরা ঘড়িতে দেখলাম বেলা দুটা। হোটেলে ফিরে দুপুরের খাওয়া সেরে ভেন্যুতে যাব। তখনো শুধু এলেনাকে ছাড়া আমি আর কাউকে চিনি না। সদ্য আয়িনের সঙ্গে পরিচয় হলো। হোটেলে ফিরতে ফিরতে জানতে পারলাম, মাদাগাসকারে সেই অর্থে কোনো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠেনি। অথচ মাদাগাসকারকে বিক্রি করে পয়সা বানিয়ে নিচ্ছে মার্কিন প্যারামাউন্ট পিকচার্স ও ইউনিভার্সেল পিকচার্সের মতো স্টুডিওগুলো। আয়িনের কাছ থেকে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওর সম্পর্কে জানতে জানতে চলে এলাম হোটেলে। দ্রুত খেয়ে রওনা দিলাম ভেন্যুর দিকে।
আমাদের হোটেল থেকে আধঘণ্টা দূরত্বে অনেকটা মরুভূমির মাঝে তৈরি করা বিশাল জায়গাজুড়ে দেখি করা হয়েছে ফিল্ম ক্রিটিসিজম কনফারেন্সের দ্বিতীয় আসরের আয়োজন। কী নেই ভেতরে! দুই শ লোক ধারণ করতে পারে, সে রকম এক হলকে করা হয়েছে মেইন স্টেজ, খোলা আকাশের নিচে প্রায় তিন শ লোকের জন্য ক্রিটিকস স্টেজ, শিশুদের জন্য আলাদা জোন, সেখানে বেশ কায়দা করে বাচ্চাদের সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রাখা, পাশে খেলনার দোকান। তার পাশেই প্রদর্শনী। এবারের মূল প্রতিপাদ্য যেহেতু চলচ্চিত্রে শব্দ, তাই সেখানে শব্দ ধারণের নানাবিধ যন্ত্রের পাশাপাশি ছিলেন এক ফলি আর্টিস্ট। দর্শক যে শব্দ তৈরি করতে বলছেন, সেই শব্দই সৃষ্টি করে দেখাচ্ছেন শব্দ-শিল্পী।
অন্যদিকে, নামের ক্যালিগ্রাফি করার স্টল, ক্যারিকেচার করে দেওয়ার স্টল, শুভেচ্ছা উপহার বিলানোর স্টল। আর মাঝে ছিল ভিআইপি লাউঞ্জ। এখানে বসামাত্রই বেয়ারারা কিছুক্ষণ পরপর এসে গরম ও ঠান্ডা পানীয় সাধছেন, আর ট্রেতে করে নিয়ে আসছেন হরেক রকমের মিষ্টি ও নোনতা খাবার। খাবার যেন শেষই হচ্ছে না! এত বৈচিত্র্য, আগত অতিথিদের অনেকে সকল স্বাদের খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। আরবদের মিষ্টির প্রশংসা করতেই হয়। হরেক রকমের পেস্ট্রি কেক ছাড়াও তিল, নারকেল ও খেজুরের সঙ্গে চিনি, চকলেট, ক্যারামেল ইত্যাদি ব্যবহার করে এরা হাজারো রকম মিষ্টি বানায়। সেই মিষ্টিগুলোই একের পর এক আসছে আর সবাই তুলে তুলে নিয়ে আস্বাদনপূর্বক চালান করছেন উদরে। নোনতা খাবারের ভেতর মিনি বার্গার, চিকেন স্যান্ডউইচ, প্রন স্যান্ডউইচ, ভেজিটেবিল স্যান্ডউইচ, শর্মা ইতি ও আদি।
যারা খাবারগুলো পরিবেশ করছিলেন, তাদের ভেতর একজন দেখি আরেকজনকে বলছেন, ‘এই, এগুলা বালো কইরা পরিষ্কার কইরা দে।’ বুঝতে কি বাকি থাকে, এরা বাংলাদেশি মানুষ? দুজনই। আমি একজনকে ডেকে বললাম, ‘ভাই, দেশের বাড়ি কই?’ লোকটা আকাশ থেকে পড়লেন? ‘আপনে বাংলাদেশি? এইখানে তো সব ভিআইপি লোক। আপনার বাড়ি কই? পরিবারের সব ভালো?’ ইত্যাদি প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত। ভাইটির নাম মোহসিন। চাঁদপুর বাড়ি। জানালেন, প্রায় দুই দশক ধরে সৌদিতে আছেন। আর কনফারেন্সের দায়িত্বে থাকা ক্যাটারিং কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন দুই মাস হলো। পরিচয় পর্ব সেরে এগোলাম ক্রিটিকস স্টেজের দিকে। বিশাল জায়গাজুড়ে কী চমৎকার আয়োজন! সামনের সারিতে গিয়ে বসলাম। এই আয়োজনের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিম্পোজিয়া’। সিম্পোজিয়ায় আমারও বক্তৃতা দেওয়ার কথা রয়েছে ৯ নভেম্বর।
৭ নভেম্বরের সিম্পোজিয়ায় প্রথম আলোচনায় অংশ নিলেন ইতালির পাওলা ক্যাসেলা। তিনি কথা বললেন বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইতালীয় সংগীত পরিচালকদের ভূমিকা নিয়ে। বিশেষ করে হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবিতে তাদের ভূমিকা তো সর্বজনবিদিত। তো ইতালির দশজন সংগীত পরিচালকের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের অবদান নিয়ে পাওলার বক্তৃতা সকলেই উপভোগ করেন। ব্রাজিলের মারসেলো জ্যানোট জানালেন, পকেট ঘড়ি কেমন করে চলচ্চিত্রে সংগীতের সঙ্গে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে বললেন স্পেগেটি ওয়েস্টার্ন ছবির ভেতর, বিশেষ করে সার্জিও লিওনের কাজে পকেট ঘড়ির দৃশ্যে কীভাবে একই রকম সংগীত জুড়ে দিয়ে বিশেষ আবহ তৈরি করা হতো। মজা লাগল মারসেলোর উপস্থাপন। পরে তার সঙ্গে অনেক কথা ও বন্ধুত্ব হলো। এদিনের তৃতীয় বক্তা ছিলেন ডিয়ানা মারতিরোসিয়ান, আরমেনিয়ার কিংবদন্তি পরিচালক রবার্ট সাহাকিয়ান্তের ছবিতে শব্দের ব্যবহার বিষয়ে তিনি আমাদের জানালেন।

এফসিসি ভেন্যুর মূল স্টেজ
এদিন আমার সঙ্গে আলাপ হলো ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত মার্কিন একাডেমিশিয়ান আলিয়া ইউনিসের। তিনি ওয়াশিংটনে অবস্থিত আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার। ষাটোর্ধ্ব ভদ্রমহিলার সঙ্গে অনেক কথা হলো। ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে। আলিয়া বর্তমানে দুবাইতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। জানতে চাইলেন প্রথম দিন আসিনি কেন? বললাম, ভিসা জটিলতায় পড়েছিলাম। নয়তো প্রথম দিন, মানে ৬ নভেম্বরের সিম্পোজিয়াও দেখা যেত, শোনা যেত।
প্রথম দিন মেসিডোনিয়ার সাংবাদিক ও ফিল্ম ক্রিটিক মারিনা কস্তোভার সঞ্চালনায় ‘কেন নীরব চলচ্চিত্র এখনো প্রাসঙ্গিক’ এই বিষয়ে আলাপ করেন সৌদি লেখক ও চিত্রসমালোচক মাশায়েল আব্দুল্লাহ, নাইজেরিয়ার চিত্রসমালোচক আদেরিনসোলা আজাও এবং ইতিহাসবিদ ও ফিল্ম ক্রিটিক জে ওয়েসবার্গ। সৌদি সিনেমায় শব্দের ব্যবহার নিয়ে এদিন আরও কথা বলেন দেশটির লেখক ও চিত্রসমালোচক আলি জালা, মোহাম্মদ আল-বশির ও সৌদি নির্মাতা সারা মেসফের। এই আলাপ সঞ্চালনা করেন সৌদি প্রযোজক ও পরিচালক আলি আল-শারহিদ। তিউনিসিয়ার সিনেমায় নারী কণ্ঠস্বর বিষয়ে কথা বলেন দেশটির চিত্রসমালোচক রিহাব বুখাইয়াতিয়া।
উদ্বোধনী দিনে আমি দিবাগত রাতে উড়োজাহাজ ধরি, অর্থাৎ আগের রাতে ঘুম হয়নি, তা ছাড়া রিয়াদ ঢাকার চেয়ে কাঁটায় কাঁটায় তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। সব মিলিয়ে আমার প্রথম দিন একটু ক্লান্তই লাগছিল। তাই রাত আটটা বাজতেই হোটেলে ফিরব বলে ঠিক করলাম। তার আগে লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম, ভালো করে আলাপ জমল মারসেলোর সঙ্গে। পকেট ঘড়ির সঙ্গে ফিক্সড ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার নিয়ে মারসেলোর যে আলাপ, সেটি আমার কাছে অপূর্ব লেগেছে। ভালো লাগা জানাতে গিয়ে আরও জানলাম মারসেলো চলচ্চিত্রের শিক্ষক এবং নব্বইয়ের দশকে তিনি ছিলেন ডিস্কো জকি। একহারা গড়নের পঞ্চাশ পেরোনো মানুষটি বেশ মজার। এই বেচারাও ভিসা জটিলতায় পড়ে প্রায় ১৮ ঘণ্টা শূন্যে ভেসে রিয়াদে অবতরণ করেছেন। তার মতো আমিও ক্লান্তিবোধ করছি; কাজেই আমরা হোটেলে ফিরব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। এই ফাঁকে নানাবিধ খাবার খেয়ে পেটপুজো শেষ।
হোটেলে ফিরলাম। ওরা ডাবল বেডের রুম দিয়েছে। কিন্তু মানুষ তো আমি একা। সারা দিন কর্মব্যস্ততা শেষে শূন্যকক্ষে ঢোকার পর একাকিত্ব ভর করল। যোগাযোগ করলাম ঢাকায়। সেখানে তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। মনে-জেনো ঘুমের রাজ্যে। তাদের মায়ের সঙ্গে কথা হলো। তাকে বললাম, একটা মজার বিষয় খেয়াল করলাম এখানে। সৌদি আরবের লোকজন মনে হয় নিশাচর। দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে সে রকম লোকজন না দেখলেও, রাতের রিয়াদ যেন ভিন্ন রকম, রাস্তায় যানজট লেগে যায়। দিনের উত্তাপ এড়াতে এরা সন্ধ্যার পরই বাইরে বেরোতে পছন্দ করে।
পরদিন শুক্রবার। জুমাবার। সকল কিছুই বন্ধ থাকার কথা। কিন্তু আমার পূর্ব-ইউরোপীয় বন্ধুদের ভেতর ওলা গুগলে দেখলেন, একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর খোলা থাকবে বেলা ১১টা পর্যন্ত। তার কথার ওপর ভরসা করে পুরো ‘গ্যাংস অব ফিপ্রেসি’ বের হলো। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর পৌঁছুলাম আমরা দ্বিতল শোরুমের সামনে। তার ভেতরেই ডিপার্টমেন্ট স্টোর। ভেতরে ঢোকা গেল, কিন্তু স্টোর সব বন্ধ। আমরা দোতলায় উঠে দেখলাম বাচ্চাদের একখানা খেলার জায়গা রয়েছে, সেটিও বন্ধ। কী আর করা! সবাই ওই কিডস জোনের সামনে ছবিটবি তুলে হোটেলের রাস্তা ধরলাম। নারীরা ঠিক করলেন, অদূরেই এক সুইমিংপুল রয়েছে নারীদের জন্য, তারা সেখানে যাবেন। আমি আবার হোটেলে ফিরে এসে লেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এক অজানা কারণে অস্থিরতা আর ক্লান্তি ভর করেছিল আমার ভেতর। কিছুদূর লিখে হাল ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
দুপুরের খাবারটা বেশ সুস্বাদুই হয় সকালের নাশতার মতো। সকালে থাকে নানা ধরনের চিজ। এসব চিজের ভেতর আমার ভালো লেগেছে হালৌমি। এই চিজের জন্ম আসলে সাইপ্রাসে। ভেড়া ও ছাগদুধের মিশ্রণে তৈরি। অবশ্য কোথাও কোথাও গোদুগ্ধ থেকেও হয়। একটু বেশি নোনতা, তবে আমি এই চিজ খেয়েছি ফ্রেঞ্চ ওমলেটের সঙ্গে। কাজেই মজা লেগেছে। সঙ্গে চিকেন সসেজ। গোমাংসের ব্যাকন। চিকেন সালামি দিয়ে বানানো গোলরুটির স্যান্ডউইচ। মাঝে মাঝে বেকড মাশরুম। আর এক গ্লাস কমলার রস অথবা আমদুধের স্মুদি। এই আরব মরুভূমিতে এসে আমদুধের স্মুদি বা সংস্কৃততে যাকে বলে অমৃতসুধা পাব, তা কল্পনাই করিনি। অমৃতসুধায় অবশ্য মধুও যোগ করে। এখানে তা করা হয়নি। কখনো-সখনো খেয়েছি খোয়াসো, যাকে অনেকে ক্রোয়াসেন্ট বলেও ডাকে। চার রকমের খোয়াসো রেখেছে ওরা—চিজি, চকলেটি, পেস্তাবাদাম দেওয়া ও মিষ্টি। আমার পছন্দ চিজি খোয়াসো।

শিল্পীর চোখে লেখকের ব্যঙ্গচিত্র
দুপুরের খাবারে আমি বরাবরই থেকেছি স্যালাদে। নানা পদের স্যালাদ সজ্জিত। আমি বেছে নিচ্ছি মুরগির মেশানো গ্রিন স্যালাদ। আর প্রোটিন হিসেবে নিচ্ছি বিফ স্টেক অথবা চিকেন দিয়ে করা কোনো ডিশ। কার্বোহাইড্রেট বিবেচনায় পাতে উঠছে ম্যাশড পটেটো অথবা কাবসা। কাবসা আসলে বিরিয়ানি। কখনো রান্না হয় ভেড়ার মাংস দিয়ে, কখনোবা গরুর। মসলা-টসলা দিয়ে বেশ জুত করেই রান্না করে ওরা। মোগলাই একটা খুসবু পাওয়া যায়। সাইড ডিশে থাকে সমুচা, রোল, সবজি সেদ্ধ ইত্যাদি। নুডলস, পাস্তাও দেখেছি। সেগুলো একবারও চেখে দেখেনি। সবশেষে মিষ্টান্ন তো আছেই। হোটেলের ডেজার্টে নিয়মিত চার-পাঁচ পদ থাকছে: একটি হলো ফ্রুট কাস্টার্ড, খুবই মজার। থাকছে দু রকম বাকলাভা। ঢাকায় অবশ্য এখন সকলেই বাকলাভার স্বাদ চেনে। আর থাকছে বিস্কুটের মতো একধরনের মিষ্টি। কোমল পানীয়, স্পার্কলিং ওয়াটার অথবা স্টিল ওয়াটার, যার যেটা ইচ্ছা বেছে নিচ্ছেন রেফ্রিজারেটর থেকে।
যাহোক, দুপুরের খাবার শেষে আবারও ছুট ভেন্যুর দিকে। আজ একটু আগেই পৌঁছে গেছি। গিয়ে দেখি বিভিন্ন স্টল। এক স্টলে নামের ক্যালিগ্রাফি করে দিচ্ছেন একজন শিল্পী। আমার কলিগরা দ্বিধান্বিত, পয়সাটয়সা লাগে নাকি! আমি মনে মনে বললাম, লাগলে লাগুক, দেখি বিষয়টা কী। গিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতেই শিল্পী বললেন, ‘আপনার নামটা লিখে দিন।’ সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলেন। লিখে দেওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন রং ব্যবহার করব? খয়েরি, কালো, নীল না সবুজ?’ আমি সবুজটাই ব্যবহার করতে বললাম। পরে ভেবে দেখলাম, সবুজ কেন বললাম? বাংলাদেশের পতাকা বা সৌদি পতাকা সবুজ বলে? হতেও পারে। যাহোক, শিল্পী তার কাঠের তৈরি একধরনের চ্যাপ্টা মাথাওয়ালা কলম দিয়ে যত্ন নিয়ে আমার নাম আরবি হরফে লিখে দিলেন। আমি যখন অন্যদের দেখালাম, ওরা তো ভীষণ উত্তেজিত। ‘পয়সা লেগেছে?’ বললাম, একদম ফ্রি। ওরা দে ছুট! গিয়ে সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। শুধু তা-ই নয়, আবিষ্কৃত হলো, পাশে ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন, যাকে বলে কেরিকেচার, সেটিও ফ্রি-ফ্রি-ফ্রি! অতএব আমরা সবাই নিজেদের কিম্ভুতকিমাকার ছবিও আঁকালাম, আর স্মৃতি হিসেবে সংগ্রহ করলাম।
ওদিকে শুনছি, ক্রিটিকস মঞ্চে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এলেনার কেরিকেচার শেষের পথে। আমি বললাম, ‘তুমি থাকো, আমরা গেলাম।’ আমার সঙ্গে পাওলা, মারসেলো ও আয়িন। আমরা গিয়ে বসতে বসতেই কথা বলতে শুরু করলেন থাই ফিল্ম ক্রিটিক ও থাই আর্কাইভের কর্মকর্তা কং রিথডি। তিনি বললেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে থাই চলচ্চিত্রের শব্দহীন শরীর নিয়ে, অর্থাৎ সে সময় যারা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন, বিখ্যাত সব নায়ক-নায়িকা, তাদের সত্যিকারের আওয়াজ কেউই শোনেনি। কারণ, তখন তাদের ডায়ালগ ডাব করে দিতেন অন্য কেউ, ভালো কণ্ঠস্বরের কোনো কণ্ঠশিল্পী। বিষয়টি বেশ চিত্তাকর্ষক। ওনার পর বক্তব্য দেন পোলিশ ফিল্ম ক্রিটিক ওলা সালওয়া। ওলার কথা আগেও বলেছি। তিনি আরবি শিখছেন অনলাইনে। ওলা কথা বলেছেন পোলিশ প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে, যেখানে বয়ান নির্মাণে শব্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
দুজনের বক্তৃতা শোনার পর দেখা গেল, মোটামুটি সময় হাতে রয়েছে দুই ঘণ্টা। কারণ, রাত ৯টায় আমরা বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির ‘রেড ডেজার্ট’ ছবিটি দেখব বলে ঠিক করেছি। আমি সকালেই মোটামুটি গবেষণা করে রেখেছিলাম, আমাদের ভেন্যুর কাছাকাছি কোনো বুকস্টোর আছে কি না। খুঁজে পেয়েছিলাম জারির বুকস্টোর নামের একটি চেইন বুকস্টোর রয়েছে। শুক্রবার ছুটির দিন হলেও বইয়ের মোকামটি বিকাল চারটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা। আমি দুপুর থেকেই বলতে শুরু করেছিলাম, ‘বইয়ের দোকানে যাব, কে কে যাবে, আমার সঙ্গে যেতে পারো।’ সন্ধ্যায় যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, দেখি আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রায় সকলেই প্রস্তুত। আয়োজকদের বলতেই ওরা দুটো গাড়ি দিল। আমরা মোট সাতজন মিলে রওনা দিলাম জারির বুকস্টোরের দিকে। রাতের রিয়াদ, দিনের রিয়াদের চেয়ে আরও বেশি মনোহারী। দিনের বেলায় ধূসর মরুর বিস্তীর্ণ এলাকা যেন নির্জীবপুরী। আর নগরে মানবনির্মিত সুউচ্চ ভবন দাঁড়িয়ে আছে বোকা বোকা চেহারা নিয়ে। যেন তাদের আর কোনো কাজ নেই। তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। কিন্তু যেই না সূর্য অস্তাচলে গেল, অমনি তারা জেগে ওঠে। ঝলমল করতে থাকে বাহারি রঙের আলোতে। মানুষগুলোও যেন রাত্রির জাদুকরী পরশে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে, আর দামি দামি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শহরের রাস্তায়। যে রাস্তা দিনের বেলায় মোটামুটি খাঁ খাঁ করে, সেটিই হয়ে ওঠে অন্যতম ব্যস্ত সড়ক।