টেকসহি I টক্সিক থ্রেড
মানহীন প্রসাধন আর দূষণ। শুধু এই দুইয়ের দায়ে কি বেহাল ত্বক? সত্যের খোঁজে সারাহ্ দীনা
নানা ধরনের ত্বক সমস্যার পেছনে বিশাল ভূমিকা রয়েছে পোশাকের। কীভাবে? পোশাকে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রাসায়নিক। কোনোটি প্রয়োজন হয় প্রক্রিয়াজাতকরণে, কোনোটি রাঙাতে, আবার কোনোটি আফটার রেডি ওয়াশের জন্য। একেক রকমভাবে তারা পোশাক-বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, একই সঙ্গে করেছে ক্ষতিও।
বিরাগ
ফ্যাব্রিকের কেমিক্যালের কারণে দেহে দুই ধরনের সমস্যা হয়। একটি সাময়িক, অন্যটি দীর্ঘস্থায়ী ও মারাত্মক। সাময়িক সমস্যার মধ্যে আছে অ্যালার্জি। এর কারণে ত্বকে তৈরি হয় চুলকানি, লালচে আর ফোলা ভাব। আরও আছে কেমিক্যাল বার্ন; যা অল্পতে না হলেও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার মধ্যে আছে হরমোনের নিঃসরণে ব্যাঘাত; যা দেহে প্রাণরসের ভারসাম্য নষ্ট করে। ক্যানসারের ঝুঁঁকি বাড়ায়। অ্যারোমেটিক এমিনো ব্লাডার ক্যানসারের কারণ। এ ছাড়া দীর্ঘ সময়ের জন্য স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে একাধিক গবেষণায় জানা যায়।
রসদে গলদ
ফরমালডিহাইড
পোশাক তৈরি করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঁজ তৈরি হয়ে যায়। কখনো যায় কুঁচকে। এই সমস্যার সমাধানে রিংকেল-রেসিস্ট্যান্ট এবং শ্রিংক রেসিস্ট্যান্ট ফ্যাব্রিক ব্যবহার করা হয়; যা থেকে তৈরি হয় ত্বকে অস্বস্তি, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা। আবার অতিরিক্ত ব্যবহারে ভয়াবহ ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে। ক্যানসার অবধি হতে পারে।
অ্যাজো ডাই
এই সিনথেটিক ডাই কাপড় রঙিন করে তুলতে ব্যবহার করা হয়। কিছু অ্যাজো ডাই ভয়ংকর রকম ক্ষতিকর; বিশেষ করে সুগন্ধি অ্যামাইন। দেহে ক্যানসার তৈরির প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এই উপাদান।
ফ্যালেটস
এটি পিভিসিতে ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য, ফ্লেক্সিবিলিটি বৃদ্ধি। এই কেমিক্যালের ব্যবহার মানবদেহের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।
পারফ্লোঅরিনেটেড কেমিক্যাল
কাপড়ের দাগ পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে পানি প্রতিরোধক প্রলেপ তৈরিতে সক্ষম। এটি দেহে হরমোনের নিঃসরণ ব্যাহত করে; যাতে মানবদেহের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়।
হেভি মেটাল
ডাই ও প্রিন্টে উপস্থিত থাকে। লেড, ক্যাডমিয়াম ও মার্কারির মতো মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদানে তৈরি। ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। এমনকি দীর্ঘ সময় শরীরে এর সংস্পর্শে এলে দেহের কোনো অঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ক্লোরিনেটেড ফেনল
কাপড় সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টি মোল্ড ট্রিটমেন্ট সম্পন্ন করতেও কাজে লাগে। এর প্রভাবে ত্বকে চুলকানি, অস্বস্তির সঙ্গে দেহে হরমোনের স্বাভাবিক নিঃসরণও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে ব্যবহারকারী নানা রকম সমস্যায় ভুগতে পারে।
ফ্লেম রিটারড্যান্ট
শিশুদের রাতপোশাক এবং প্রোটেকটিভ ক্লদিংয়ে ব্যবহৃত হয়। এটি নিউরোলজিক্যাল ইস্যুর কারণ বলে ধারণা গবেষকদের। একই সঙ্গে হরমোনের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত করে।
সমাধান
ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে ভয়াবহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। প্রকৃতি থেকে পাওয়া ফ্যাব্রিক এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমাধান বলে মনে করেন বোদ্ধারা।
অর্গানিক কটন নিরাপদ ফ্যাব্রিক হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এটি উৎপাদনে কোনো ধরনের সিনথেটিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয় না। ফ্লাক্স ফাইবার থেকে প্রাপ্ত লিনেনও ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি তৈরিতে কোনো সিনথেটিক ট্রিটমেন্ট মোটেই আবশ্যক নয়। এই ফ্যাব্রিক লাইটওয়েট ও ব্রিদেবল ক্লদিং তৈরিতে কার্যকরী। হেম্পের চাষে সার ব্যবহার করা জরুরি নয়। আবার দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। শীতপোশাক তৈরিতে উল ব্যবহার নিরাপদ। এই প্রাকৃতিক আঁশ পোশাকের জন্য উপযোগী করতে কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্য দরকার হয় না। সিল্ক ন্যাচারাল প্রোটিন ফাইবার। প্রস্তুতিতেও রাসায়নিক ব্যবহারের পরিমাণ খুব কম। সম্ভব হলে এ ধরনের ফ্যাব্রিকগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষতি কমিয়ে আনা যেতে পারে। এ ছাড়া বেশ কিছু কার্যকরী বিকল্প আমাদের ধরণীতেই রয়েছে। যেমন ভিসকস ও রেয়ন। তৈরি করা হয় বাঁশ থেকে। কর্ক ফ্যাব্রিকও অনিরাপদ নয়। কারণ, এটি ওকগাছ থেকে তৈরি করা হয় এবং প্রাকৃতিকভাবেই অ্যালার্জি তৈরি করে না। তাই ব্যাগ ও জুতা তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে দুশ্চিন্তামুক্ত থেকে।
ফ্যাব্রিক, রাসায়নিক ও ত্বকের দ্বন্দ্ব
পোশাকের লেবেল পড়তে হবে মনোযোগ দিয়ে। সার্টিফিকেশন মার্ক ট্যাগে উল্লেখ আছে কি না দেখে নিতে হবে। ব্র্যান্ড সম্পর্কে পর্যাপ্ত পড়াশোনা দিতে পারে খানিকটা সমাধান। বেশ কিছু ফ্যাশন লেবেল রয়েছে, যারা ক্রেতাস্বার্থকে শতভাগ গুরুত্ব দেয়। পোশাকের ফ্যাব্রিকের বিস্তারিত বিবরণসহ যাবতীয় তথ্য লেবেলে প্রকাশ করে। অতি উজ্জ্বল রঙের পোশাকে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি মনে রেখে পোশাকের রং বাছাই করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক রং এবং আন-ডাইড ফ্যাব্রিক এ ক্ষেত্রে নিরাপদ। নতুন পোশাক পরার আগে ধুয়ে নিলে ব্যবহৃত রঙের প্রাথমিক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকার পথে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
সার্টিফিকেশন
ফ্যাব্রিক কতটা নিরাপদ, সেটা গবেষণার মাধ্যমে নির্ণয় করে বিশ্বের বেশ কয়েকটি সংস্থা। পরীক্ষা-পরবর্তী সময়ে লেবেলে সেটি উল্লেখ করে দেয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্লোবাল অরগানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ডস, ওকিও-টেক্স স্ট্যান্ডার্ড হান্ড্রেড, ব্লু সাইন, ক্র্যাডেল টু ক্র্যাডেল, ফেয়ার ট্রেড সার্টিফায়েড, পেটা। আন্তর্জাতিক কোনো ব্র্যান্ড থেকে পোশাক কিংবা অনুষঙ্গ কেনার আগে বিষয়গুলো দেখে নেওয়া যেতে পারে।
মডেল: নাজাহ নোয়ার
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ব্লুচিজ
জুয়েলারি: গ্লুড টুগেদার
ছবি: কৌশিক ইকবাল