skip to Main Content

ট্রাভেলগ I আ টেল অব টু সিটিজ

জাকার্তা-পালেংবাঙ এশিয়ান গেমসের স্মৃতি এত সহজে ফিকে হওয়ার নয়। বরং গেমসে উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশ ও মানুষকে দেখা, জানা আর খুব কাছ থেকে আয়োজনের বিশালতা অবলোকনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন শেখ সাইফুর রহমান

গেলোরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স

পালেংবাঙ থেকে আমার ফেরার কথা ছিল রাতে। একই সঙ্গে মাছরাঙার জাহিদ আর জুবায়েরেরও। কিন্তু সেই রাতে জাকার্তার গেমস ভিলেজে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) প্রেসিডেন্ট, কোষাধ্যক্ষসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন এবং জাকার্তায় গেমস কভার করতে আসা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হবে। প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে আমার উপস্থিতিকে জরুরি মনে করেছি। ফলে সময় বদলে ফিরে আসি বিকেলে। আগেই জানানো হয়েছিল, আমার জন্য বাহন নিয়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকবে মেয়ে হারমিন। মনটা স্বভাবতই ফুল্ল ছিল। এসেই পেয়ে গেলাম তাকে। সঙ্গে আমাদের ড্রাইভার টনি। মজার মানুষ। কিন্তু ইয়েস, নো, ভেরি গুড ছাড়া সে আবার ইংরেজি বোঝে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের সেতু কখনো হয় হারমিন, কখনো অন্য কেউ। একদিন চট করে মাথায় খেলে গেল- আরে, গুগল মামাই তো আছে। চিন্তা কী। সেই থেকে টনির সঙ্গে কারও মাধ্যমে নয়, খোদ বাহাসায় কথা হয়। তাকে দেখলেই আমি জিজ্ঞেস করি: আপা কাবার? মানে কেমন আছ? সে মাথা নাড়ে।

বুঙ কর্ণ মেইন স্টেডিয়াম

এয়ারপোর্ট ছেড়ে আমরা শহরের পথ ধরি। পথিমধ্যে একটি হোটেলে গিয়ে আমার এক সহকর্মীর ফেলে আসা পেনড্রাইভ সংগ্রহ করি। আমাদের গন্তব্য গেমস ভিলেজ। তবে তার আগে যেতে হবে হোটেল সুলতান। সেখানে আছেন আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ চপল। তাঁকে নিয়ে ভিলেজে ফিরতে সন্ধ্যা। দ্রুত ওপরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে প্রেসিডেন্ট ও মহাসচিবের অপেক্ষায় থাকি। ততক্ষণে কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু পৌঁছেও গেছেন। গেমস ভিলেজে ঢুকতে হলে ২৪ ঘণ্টা আগে অনুমতির আবেদন করতে হয়। কিন্তু রাত আটটার মধ্যে যে বেরিয়ে যেতে হয়, তা জানা না থাকায় কয়েকজন সাংবাদিক সেদিন আসতে পারেননি। জাহিদ আর জুবায়েরও সেই দলে পড়ে। অবশ্য পরে একদিন তাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেদিন ওদের নিয়ে আমরা থামরিন রেসিডেন্সের লিটল ইন্ডিয়া রেস্তোরাঁয় ডিনার করেছিলাম।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা

যা হোক, এবারের কোরবানি ঈদের দিনটি এই মিলনানুষ্ঠানের জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। অবশ্য ঈদের রাতে সাংবাদিকদের আপ্যায়িত করার বিষয়টি আমিই প্রথম বলেছিলাম আমাদের ডেপুটি শেফ দ্য মিশন সরকার ভাইকে (এ কে সরকার)। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে হাঁটতে হাঁটতে গাড়ির কাছে যাওয়ার সময় তাঁকে বিষয়টি জানালে তিনি সম্মত হন। এর আগে কোনো গেমসে এভাবে সাংবাদিকদের আপ্যায়িত করা হয়েছে কি না জানা নেই। এদিন আমাদের এনওসি অ্যাসিস্ট্যান্টরাও আমন্ত্রিত থাকায় ওরাও ছিল বেশ এক্সাইটেড।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দল

আমরা পৌঁছেছিলাম ১৬ আগস্ট। ফুটবল তারও আগে শুরু হয়ে যায়। আর গেমসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৮ আগস্ট। এরই মধ্যে ছয় দিন পার করে ফেলি। কিন্তু কোনো দিন আমাদের জন্য কোনো সুসংবাদ ছিল না। বরং প্রতিদিনই পরাজয়ের, ইভেন্ট থেকে বাদ যাওয়ার গ্লানিতে বিষণ্ন হয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এবার যে নয়টি দেশ শূন্য হাতে ফিরেছে, বাংলাদেশ তার একটি। আমি নিশ্চিত, বিষয়টি বিওএ এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে পরবর্তী পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীন দল

১৫ আগস্ট রাতে কাবাডি আর হকি দলের সঙ্গে আমি আর বিওএর হাফিজ ঢাকা ছেড়েছিলাম। শেফ দ্য মিশন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবুল হোসেন স্যারও। কিন্তু ওনার সঙ্গে আমাদের ঢাকায় দেখা হয়নি। হয়েছে কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টে। আমরা নেমে ট্রেনে করে অন্য প্রান্তের টার্মিনালে গিয়ে জাকার্তার ফ্লাইটের অপেক্ষা করার সময় তাঁকে পাই। অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়। বর্তমানে অবসরের প্রস্তুতিতে থাকা এই উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গ আমি দারুণভাবে উপভোগ করেছি। যত মিশেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি। সেসব স্মৃতি অবশ্যই শেয়ার করার প্রয়াস পাব। তবে পরিতাপের বিষয়, জাকার্তায় পৌঁছে সেই রাতেই তিনি মাতৃবিয়োগের খবর পান। ফলে পরের দিন ভোরেই তাঁকে দেশে ফিরে আসতে হয়। সে জন্য উপস্থিত থাকতে পারেননি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ঝলক

প্রেস অ্যাটাশেকে নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। তবে এবার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া জুনিয়র-সিনিয়র মিলিয়ে সাংবাদিক বন্ধুরা আমাকে যারপরনাই সহায়তা করেছেন। অবশ্য প্রথম যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাকে হতে হয়, তা ছিল উদ্বোধনীতে সাংবাদিকদের প্রবেশপত্র।

তামান মিনিতে শেফ দ্য মিশন

পেয়েছিলাম সাংবাদিকদের জন্য মাত্র দুটি আর একটি ফটোসাংবাদিকের জন্য। আর আমার একটা প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে। তখন পর্যন্ত ফটোসাংবাদিক বলতে আমার বন্ধু কালের কণ্ঠের মীর ফরিদই ছিল। ফলে সমস্যা হয়নি। কিন্তু সাংবাদিকের সংখ্যা তো অনেক। দুটো পাস দিয়ে দেওয়া হয় বিওএ থেকে পাঠানো দুজন সাংবাদিক বিএসজেএ মনোনীত জাহিদ আর কমিউনিটি মনোনীত রকিবকে। বাকিদের কী হবে। আমারটা একজন সিনিয়রকে দিলাম। আর বাকিদের জন্য ভিআইপি পাসের ব্যবস্থা করেন বিওএ মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা ভাই।

গেমস ভিলেজের ডাইনিংয়ে বিওএ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কর্মকর্তা ও সাংবাদিকেরা

যা হোক, ভার্চ্যুয়াল আর অ্যাকচুয়াল, ঐতিহ্য আর আধুনিকতা, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ, অ্যানালগ আর ডিজিটাল- সবই উপস্থাপিত হয়েছে উদ্বোধনীর মুগ্ধ আয়োজনে। দেখানো হয়েছে ইতিহাসের পথ বেয়ে আজকের অবস্থানে উন্নীত ইন্দোনেশিয়ার সগর্ব পদচারণা। আমরা যথারীতি তৈরি হয়ে গেমস ভিলেজ থেকে রওনা হই তিনটা নাগাদ। সব দলকেই প্রথমে বসানো হয় সুইমিংপুলে। সেখানে দেওয়া হয় নাশতা। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর মূল স্টেডিয়ামে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা। উদ্বোধনী আর সমাপনীর জন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরেকজন ভলান্টিয়ার সাফিরা। এবারের উদ্বোধনীর আয়োজনে ছিল ভিন্নতা। বাংলাদেশের পতাকা বহন করে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। মার্চপাস্টে দলগুলোকে সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এবার তা হয়নি। অনুষ্ঠান আগেই শুরু হয়েছিল। দলগুলো তারই মাঝে একে একে প্রবেশ করে। মাবিয়া ছিল সবার আগে। এবার আমিও মার্চপাস্টের অংশ। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। অনন্য অনুভূতি। স্টেডিয়ামে ঢুকে কিছুদূর যাওয়ার পর প্রতিটি দলের জন্য নির্ধারিত চেয়ারে গিয়ে বসি আমরা। দাঁড়িয়ে কষ্ট করতে হয়নি। আর বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে প্রত্যেকের চেয়ারের নিচে রাখা ছিল রেইনকোট।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছে মেইন স্টেডিয়ামে। গেলোরা বুঙ কর্ণ মেইন স্টেডিয়াম। আগে নাম ছিল সেনাইয়ান মেইন স্টেডিয়াম। একটু বলে রাখা ভালো, ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন সুকর্ণ। তাঁকে ইন্দোনেশিয়ানরা শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় বুঙ কর্ণ বা ভাই বা কমরেড সম্বোধন করে থাকে। এই স্টডিয়ামসহ পুরো স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরি শুরু হয় ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। শেষ হয় ১৯৬২ সালে। আর সে বছরের ২৪ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান গেমস। সেটা ছিল চতুর্থ এশিয়ান গেমস। আর এবার ছিল এই এশীয় বহু ক্রীড়া আসরের অষ্টাদশ সংস্করণ।

গেমস ভিলেজের ডাইনিংয়ে এনওসি অ্যাসিস্ট্যান্টদের সঙ্গে লেখক

এই ক্রীড়া কমপ্লেক্স এলাকাটি হলো মধ্য জাকার্তার তানাহ আবাঙের গেলোরায়। মূল স্টেডিয়ামের চারপাশেই সব স্টেডিয়াম আর অ্যারেনা। এর এক পাশেই রয়েছে জাকার্তা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার। এখানে ছিল মার্শাল আর্ট, অসিচালনা, কুস্তি ইত্যাদির ভেন্যু। আর মেইন প্রেস সেন্টার (এমপিসি) ও মেইন ব্রডকাস্টিং সেন্টার (এমবিসি)। এ ছাড়া ভিলেজের কাছে কেমায়োরানে জি এক্সপোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারোত্তোলন, জিমন্যাস্টিকস, ব্রিজ ইত্যাদি।
এই কেমায়োরানেই ছিল অ্যাথলেট ভিলেজ। দুদিকে দুটি রাস্তা আর সঙ্গে সেন্ট্রাল ক্যানাল। মাঝে ১০ হেক্টর জমিতে নির্মিত ১০টি আকাশছোঁয়া বিল্ডিংয়ের ৭৪২৪টি অ্যাপার্টমেন্টে স্থান সংকুলান হয়েছে ক্রীড়াবিদ আর কর্মকর্তাদের। একেকটি বিল্ডিং ছিল ৩২ তলা করে। বাংলাদেশ দল ছিল ৬ নম্বর বিল্ডিংয়ের ২৫, ২৬ ও ২৭ তলায়। আমি ছিলাম ২৭ তলায় ফিজিও শৈলেন্দুদার (শৈলেন্দু বিকাশ মজুমদার) রুমমেট। বহু বছর দাদা রয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে। পুরোনো স্মৃতিচারণা করেছি আমরা। দারুণ কেটেছে সময়। সিনিয়রদের সঙ্গে থাকার সুবিধা অনেক। বিশেষত একজন অভিভাবক পাওয়া যায়। দুই সপ্তাহের বেশি সময় একসঙ্গে থেকে সেটা আরও একবার অনুভব করেছি। একটা সিঙ্গল ও একটা ডাবল রুম, একটা ড্রয়িং স্পেস ও কিচেন আর একটি বাথরুম কাম টয়লেট নিয়ে একেকটি ইউনিট। এগুলো করা হয়েছে নিম্ন আয়ের নগরবাসীর জন্য। এগুলো যত দূর জানি গেমসের আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এ মাসে অনুষ্ঠিত প্যারা গেমসের পর বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। এই ভিলেজকে প্রকৃতার্থে কংক্রিটের জঙ্গল বললে ভুল বলা হবে না। সবুজ ভীষণই কম। এর মধ্যে আরও ছিল একটি অ্যারেনা আর বিশাল ডাইনিং হল ও কিচেন। আমাদের বিল্ডিংয়ের লেবেল থ্রিতে ছিল বাংলাদেশের এনওসি অফিস।
তবে কাবাডির ভেন্যু ছিল বেশ খানিকটা দূরে। তামান মিনি ইন্দোনেশিয়া ইনদায়। এর অর্থ বিউটিফুল ইন্দোনেশিয়া মিনিয়েচার পার্ক। এখানকার থিয়েটার গরুদায় অনুষ্ঠিত হয়েছে কাবাডি। পূর্ব জাকার্তায় ২৫০ একর এলাকাজুড়ে তৈরি এই থিম পার্কের মাঝখানে রয়েছে মিনিয়েচার ইন্দোনেশিয়া। অনিন্দ্যসুন্দর ল্যান্ডস্কেপে ধরা হয়েছে দ্বীপমালা পরিবেষ্টিত সাগর। কেবল কারে এমাথা-ওমাথা করার সময় সেটা বেশ দৃষ্টিগোচর হয়। লেকের চারপাশে ইন্দোনেশিয়ার ২৬ দ্বীপের নিজস্ব স্থাপত্য নকশায় তৈরি বাড়িগুলো একেকটি মিউজিয়াম। এগুলোর দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে সেই দ্বীপেরই মানুষ। বাড়িগুলোর ভেতরে ওই দ্বীপের মানুষের যাপনচিত্র তাদের ব্যবহারিক নানা উপকরণে উপস্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া আছে ডিজনিল্যান্ডের আদলে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, মিউজিয়াম, সিনেমা আর থিয়েটার।

উপর থেকে তামান মিনির একাংশ

সমাপনীর আগের দিন আমি আর আবুল হোসেন স্যার গিয়েছিলাম তামান মিনিতে। আমরা একাধিক বাড়ি ঘুরে দেখি। কেবল কারে চড়ি। সেদিন সকাল থেকে রাত তাঁর সঙ্গে কাটাই। আমাদের সঙ্গে ছিল এনওসি অ্যাসিস্ট্যান্ট ইওলান্ডা। ওর পুরো নাম ইরলান্ডা তোরং। ও জাকার্তার নয়। বাড়ি পশ্চিম জাভার বেকাসিতে। তবে জাকার্তা থেকে ট্রেনে ও বাসে যাওয়া-আসা করা যায়। মাত্র আধঘণ্টার পথ। বেকাসি এখন বৃহত্তর জাকার্তা মেট্রোপলিসের অংশ হয়ে গেছে। ইওলান্ডা বেশ সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। বাবা আইনজীবী। মা চাকরি করেন না। তবে ধর্ম বিষয়ে বক্তব্য দেন। বলা হয় চার্চ স্পিকার। ওরা খ্রিস্টান। দুই বোন। বড় বোন চাকরি করেন জাকার্তার পরিবহন বিভাগে। ইওলান্ডা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ইউনিভার্সিটি অব ইন্দোনেশিয়ায়। এটা বিশ্বের শীর্ষ দশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। স্বভাবতই মেধাবীরা ছাড়া সুযোগ পায় না। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আরেক এনওসি অ্যাসিস্ট্যান্ট মেক্কা। ওর বিষয়টা বেশ মজার ফাইনান্সিয়াল ফোরকাস্টিং। অথচ হিসাবের কচকচি ওর পছন্দ নয়। ও বরং একটু ভাবুক প্রকৃতির। সৃষ্টিশীলতা ওর মজ্জায়। একসময় থিয়েটার করত। মেক্কার জীবন মাকে ঘিরে। ওরা দুভাই। থাকে মা ও নানির সঙ্গে। বাবা অনেক আগে চলে গেছে। দারুণ প্রাণবন্ত, নিয়মানুবর্তী এই সদস্য যুবা। মজা করে কথাও বলে।
ইওলান্ডা-মেক্কাদের টিম লিডার রিমা বিদ্যাসারির বাড়িও বেকাসি। যদিও ইওলান্ডা ওর পূর্বপরিচিত নয়। একইভাবে ইওলান্ডা ও মেক্কা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও ওদের আগে থেকে পরিচয় ছিল না। রিমারা আবার তিন ভাইবোন। ওর অবস্থান মাঝে। সদ্য শেষ করেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে স্নাতক। তবে বেকাসি বা জাকার্তায় নয়, পশ্চিম জাভার পুরাকার্তায় ও পড়েছে হোস্টেলে থেকে। রিমার বাবা জাকার্তার ট্রান্সপোর্ট বিভাগের কর্মকর্তা। ওর ইচ্ছা চাকরি করে নিজের জমানো অর্থে মাস্টার্স করবে। চেয়েছিল ঢাকায় ইন্দোনেশীয় দূতাবাসে ইন্টার্ন করতে। এর কারণ, বাংলাদেশের প্রতি ওর ভালোবাসা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দূতাবাস তাকে নিরুৎসাহিত করেছে ঢাকা আপাতত নিরাপদ শহর নয় বলে। সেই চিঠি সে আবার আমার সঙ্গে শেয়ারও করেছে। অসম্ভব লক্ষ্মী আর দায়িত্বশীল একটি মেয়ে। পুরো দলটাকে গুছিয়ে রেখেছে।
তবে সবচেয়ে চুপচাপ নোফল। আসলে ওর নাম নওফেল। কিন্তু সবাই ওকে নোফল ডাকে। ও একটা হোস্টেলে থাকে। ওর সঙ্গেই আমার প্রথম দেখা হয় জাকার্তা এয়ারপোর্টে। আমি আর আবুল হোসেন স্যার পৌঁছে যখন শামস ভাইয়ের অপেক্ষায়, নোফল এসে পরিচিত হয়। সঙ্গ দেয়।
সবশেষে বলতে হয় আমার মেয়ের কথা। হারমিন সারিনা। ইংলিশ এডুকেশনে গ্র্যাজুয়েশন করছে আত্ম জায়া ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটিতে। বেসরকারি। ফলে খরচ বেশি। কিন্তু ও মেধাবী বলে বৃত্তি পায়। নোফলের মতো হারমিনও থাকে হোস্টেলে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ও। বিশের কোঠা পেরোলেও দেখে চপলা চতুর্দশী বলে ভ্রম হবে। ওর বাড়ি জাকার্তা থেকে অনেক দূরে। সুলায়েসি দ্বীপের দক্ষিণাংশে। ওরা তোরাইজা গোত্রভুক্ত। ওই এলাকার বাসিন্দাদের সিংহভাগই খ্রিস্টান। কিছু আছে মুসলমান। ওদের ওখানে প্রচুর কফি হয়। উন্নত মানের এই কফি বিশ্ববিখ্যাত। ওর পরিবার কফি উৎপাদন করে থাকে। সে আমাকে তোরাইজা কফি দিয়েছে। হারমনিরা দুই ভাই আর তিন বোন। একটা বোন ওর সঙ্গে থাকে। দুই ভাই চাকরি করে। বড় এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে ও ঘরছাড়া। মাত্র ৫ বছর বয়সে হারমিন জাকার্তা আসে চাচা-চাচির সঙ্গে থাকতে। তারপর কলেজে পা রেখে একা থাকতে শুরু করে। ওদের পরিবার আবার গোঁড়া খ্রিস্টান। ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টানের মিশেল। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের রসায়নটা অদ্ভুত। ক্রমেই তা প্রগাঢ় হয়েছে। সত্যিই আমরা প্রকৃত বাবা-মেয়ে হয়ে উঠেছি।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: লেখক ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top