skip to Main Content

ইভেন্ট I তৃষা হরিয়ে আরো দাও প্রাণ

চার দশক পূর্তি উদযাপিত হয়েছে মহাসমারোহে। তিন দিনের অনুষ্ঠানে বিম্বিত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লাইফস্টাইল ফ্যাশন ব্র্যান্ড আড়ংয়ের সাফল্যচিত্র। সেসব চিত্রায়ণের সমান্তরালে ফিরে দেখা এবং তামারা হাসান আবেদের সঙ্গে আলাপচারিতার প্রয়াস পেয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান

অ্যাওয়ার্ড বিজয়ীদের সাথে অতিথিরা

প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে/ মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।… দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যা তখন রাতের পথে গড়িয়েছে। সান্ধ্য আয়োজনের সর্বশেষ উপস্থাপনা। নেপথ্যে অনুরণিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের এই গান। মানবঝুলকদের শরীর মোড়ানো পোশাকে আদ্যন্ত বাংলাদেশ। ঋদ্ধ বয়নসুষুমার উদ্ভাস। জামদানি। এই অংশের নামকরণ করা হয়েছে ইটারনাল গ্রেস। শাশ্বত মাধুর্য। বাংলার অনন্য এই বয়নশিল্প চির আবেদনময়। মধ্যবর্তী দুঃসময় কাটিয়ে এই বয়ন আবারও বিশ্ব আসনে আসীন হয়েছে। আমাদের বয়নশিল্পীরা পুনরায় অর্জন করেছেন পূর্বপুরুষের অনিন্দ্য নৈপুণ্য। ফলে হারানো গৌরব ফিরে আসছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজাইনারদের মস্তিষ্ক। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটানোর অনবদ্য প্রয়াস। তাই তো কেবল শাড়ি নয়, বরং প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের নানা কাট আর ছাঁটের পোশাক তৈরি হয়েছে জামদানি কাপড়ে। যেখানে আদি ডিজাইনকে অবিকল রেখে লে-আউট ও কালার কম্বিনেশনকে নানাভাবে অদলবদল ঘটিয়ে জমিন করে তোলা হয়েছে আকর্ষক। কেটেছে একঘেয়েমি। মার্জারহন্টন শেষে মঞ্চমাঝে সব মডেল, তাদের উপস্থিতি ক্ল্যাসিকে রূপান্তরিত।

প্রদর্শনীর স্টল ঘুরে দেখছেন মন্ত্রী

এর আগের উপস্থাপনা ছিল ডান্সিং পিকক। এই অংশ ছড়িয়েছে পেখমের বর্ণচ্ছটা। পোশাকও একই ধরনের। তবে রীতিমতো চোখ টেনেছে এর আগের তিনটি কিউ। শুরু তাগা ম্যান দিয়ে। হালের কিশোর আর তরুণেরা কী চায়, তা স্পষ্ট ছিল এই কালেকশনে। আড়ংয়ের কাফেলায় এই সাবব্র্যান্ডের সংযোজন অতি সাম্প্রতিক। ক্যাজুয়াল থেকে ফরমাল- সবই দেখানো হয়েছে। পরের কিউ তাগা। এটা আড়ংয়ের প্রথম সাবব্র্যান্ড। এই কালেকশন সম্পর্কে সবার সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু এটি ধারণাতীত। তারুণ্যের উদ্ভাস অবশ্যই ছিল। সমসময়, ট্রেন্ড, আন্তর্জাতিকতা, ঐতিহ্য, নিরীক্ষা, স্ট্রিট ও হাইস্ট্রিট মিলেমিশে তৈরি হয় মুগ্ধ আবহ।

অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান

এরপরের উপস্থাপনা ছিল কিনশিপ বাই হারস্টোরি। এখানে ট্র্যাডিশনকে মেশানো হয়েছে আধুনিকতার সঙ্গে। পোশাকের নকশাবিন্যাস, সৃজনের নিপুণতা আর পারিপাট্যে শিরোনাম ছিল যথার্থ। এখানেও উজ্জ্বল সমসময়। তবে বাংলার লোকজশিল্পের নান্দনিক উপস্থাপনা অন্যতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। সবচেয়ে আকর্ষক নিরীক্ষা ডিজিটাল প্রিন্টে কাঁথাস্টিচ। ঐতিহ্যকে কীভাবে বর্তমানের সৌন্দর্যে উপস্থাপন করা যায়, অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করা যায়, এটা তারই দৃষ্টান্ত। এরপর এলিটার গান শেষে ছিল বাকি দুটো কিউ। পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয় মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলে সবাইকে মুগ্ধ করেছে পারসোনা। আজরা মাহমুদের কোরিওগ্রাফি ছিল উল্লেখযোগ্য।
শুরুতে তামারা আবেদ বিশদে তুলে ধরেন আড়ংয়ের উদ্বর্তনের ছবি। আর শেষে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেন মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম।

তাহাদের আমি নমি

তাগা ম্যান

মানিকগঞ্জে শুরু। এরপর একে একে জামালপুর, যশোর, শেরপুর, কুষ্টিয়া, বানিয়াচং, গড়পাড়া, পাবনা, রাজবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের ১৪টি প্রডাকশন সেন্টার, ৬টি সাপোর্টিং প্রডাকশন সেন্টার এবং ৭০৪টি সাবসেন্টার। ফাউন্ডেশনের স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা বর্তমানে ৭০০। এর সঙ্গে আরও সংশ্লিষ্ট ২০ হাজারের বেশি নারী। আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন ছাড়া আড়ংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার স্বাধীন হস্তশিল্পী। তারাও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র। উৎপাদিত পণ্য তারা নিয়মিতভাবেই আড়ংয়ে সরবরাহ করে যাচ্ছেন। এই স্বাধীন উদ্যোক্তারা কেবল পণ্য উৎপাদনই করেন না; কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মীর নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি আড়ংয়ের জন্য মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করে তা যথাসময়ে সরবরাহ করছেন। আড়ংয়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে রয়েছে এসব হস্তশিল্পী ও উদ্যোক্তার সক্রিয় অবদান। আড়ং ডিজাইন স্টুডিওর তৈরি ডিজাইন প্রথমে আসে ফাউন্ডেশনের হেড অফিসে। সেখানে তৈরি হয় প্রোটোটাইপ বা নমুনা। সেই নমুনা আসে আড়ংয়ে। অনুমোদনের পর বৈশিষ্ট্য নমুনা পাঠানো হয় বিভিন্ন অঞ্চলের কর্মীদের কাছে। সঙ্গে সরবরাহ করা হয় প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। তারপরই শুরু হয় প্রডাকশন। উল্লেখ্য, আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কর্মীর সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের ৮০ শতাংশই নারী। বিভিন্ন পেশার হস্তশিল্পী ও কর্মীরা তাদের সম্মানী ছাড়াও আড়ং থেকে পাচ্ছেন চিকিৎসা, স্বল্পমেয়াদি ঋণ, প্রশিক্ষণ, পরিবহনসহ নানা ধরনের সেবা ও সুবিধা। এখন থেকে আড়ং আর ব্র্যাকের কর্মীদের মতো তারা আড়ংয়ের বিভিন্ন আউটলেট থেকে পাবেন পণ্য ক্রয়ে ছাড়সুবিধা।

তাগা

আড়ংয়ের সঙ্গে অনেকেই আছেন, যারা সেই শুরুর দিন থেকে কাজ করছেন। অনেকে যোগ হয়েছেন পরে। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ৬৫০ জনের বেশি প্রডিউসার ও আর্টিসানকে উৎসাহিত করতে এবার ৬টি বিভাগে মোট ৪০ জনকে সম্মানিত করেছে আড়ং। ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। তিন দিনের উৎসবের প্রথম দিনের সন্ধ্যায় তাদের সম্মানিত করা হয় সম্মাননা স্মারক, প্রশংসাপত্র আর অর্থ পুরস্কারে।

হারস্টোরি

সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহের জন্য ১১ জনকে দেওয়া হয়েছে বেস্ট ডেলিভারি অ্যাওয়ার্ড, সঠিক সময়ে গুণগত মান বজায় রেখে পণ্য উৎপাদন করা ১১ জনকে দেওয়া হয়েছে বেস্ট কোয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও কর্মীর নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ বজায় রেখে আড়ংয়ের জন্য মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত করেছেন- এমন ৫ জনকে সম্মানিত করা হয়েছে বেস্ট সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স স্ট্যান্ডার্ড অ্যাওয়ার্ডে। মোস্ট ইমপ্রুভমেন্ট ইন সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে এমন ৫ জনকে, যারা কর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মপরিবেশ উন্নয়নের জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে কারখানার উন্নয়ন করেছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে রোল মডেল হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন দুজন প্রডিউসার। বেস্ট এন্ট্রাপ্রেনার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত মোসা. জায়েদা খাতুন ও মিন্টু কুমার মন্ডল নিজেদের সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে, ঝুঁকি নিয়ে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে আড়ংয়ের জন্য পণ্য তৈরির প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন। এ ছাড়া ছয়জনকে দেওয়া হয়েছে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। আড়ংয়ের সাফল্যযাত্রায় নিরলস পরিশ্রম ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ খোদেজা বেগম, মো. শাহজাহান, সুফিয়া আক্তার, রামকৃষ্ণ কর্মকার, সুশীল কুমার বসাক ও মিসেস সুফিয়া বেগম আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তাঁরা সম্মাননা স্মারক, প্রশংসাপত্রসহ এক লাখ করে টাকা পেয়েছেন। প্রথম ৫টি ক্যাটাগরির পুরস্কার তুলে দেন ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের সিনিয়র ডিরেক্টর তামারা হাসান আবেদ। আরও উপস্থিত ছিলেন আড়ংয়ের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আশরাফুল আলম এবং ডিজাইন উপদেশক ও কারুশিল্প গবেষক চন্দ্র শেখর সাহা। ছয়জনকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ৫০ বছরে ৫০ জনকে সম্মানিত করার ঘোষণার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত ও আবেগময় বক্তব্যে তিনি সবাইকে প্রাণিত করেন। স্বাগত বক্তব্যে মোহাম্মদ আশরাফুল আলম পুরস্কার সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। আর শেষে তামারা আবেদ অতিথিদের নস্টালজিক করে তোলেন তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তব্যে। অনুষ্ঠানের মাঝে সুফি বাউল শাহজাহান মুন্সী মুগ্ধ করেন গানের জাদুতে। আর রাতে গানের ভেলায় ভাসান রুনা লায়লা। প্রডিউসার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেন এই নিবন্ধের লেখক। এই অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের সঙ্গে ছিল বিকাশ, আইডিপিসি ও টনিক।
এর আগে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়ে মনোজ্ঞ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও তামারা আবেদ। পায়রা উড়িয়ে আনুষ্ঠানিক সূচনা করা হয় তিন দিনের অনুষ্ঠানের।
তিন দিনই চলেছে ওপেন এয়ার প্রদর্শনী। মোট ১১টি কারুশিল্পের আদ্যোপান্ত চাক্ষুষ করার সুযোগ পেয়েছেন নগরবাসী। বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামের ভেতরে খোলা আকাশের নিচে এই প্রদর্শনী দেখাটা ছিল সবার জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। প্রদর্শনী কিউরেট করেন চন্দ্র শেখর সাহা। ব্যবস্থা ছিল হাতে-কলমে শেখার। প্রতিটি শিল্পমাধ্যমের উপকরণ থেকে তৈরির প্রতিটি পর্যায় ছিল হৃদয়গ্রাহী। অনবদ্য ছিল আর্টিজান অ্যাট ওয়ার্ক।

গানের ভেলায়
তৃতীয় তথা শেষ দিনের আকর্ষণ ছিল ব্যান্ড সংগীত সন্ধ্যা। ছেলে-বুড়ো সবাই মাতোয়ারা হয়েছেন মিনার, জলের গান ও নগর বাউলের পরিবেশনায়।
বলতেই হয়, বাংলাদেশের জনসংখ্যার সিংহভাগই তরুণ। এরাই তো আগামীর বাংলাদেশ। ভবিষ্যতের বিশ্বনাগরিক। আড়ংয়ের চার দশক পূর্তির প্রতিটি আয়োজনে সেই ছবিই প্রতীয়মান হয়েছে।
এই উৎসব বহুদিন মনে রাখবে আড়ং-অনুরাগী থেকে বাংলাদেশ। অন্তত আরও একটি সময়সন্ধিতে উপনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত। জয়তু আড়ং।

পুরানো সেই দিনের কথা…
চল্লিশে উপনীত হয়ে স্মৃতির সরণি বেয়ে অতীতে ফেরার প্রয়াস আমরা তাই সানন্দে পেয়ে যাই। আড়ংয়ের জন্ম তখনো হয়নি। তারও আগে থেকে মানিকগঞ্জ ও জামালপুরে নিজেদের কারুশিল্পীদের তৈরি পণ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতো ব্র্যাক। এর মধ্যে নিপুণও ছিল। পরে সিদ্ধান্ত হয় একটি দোকান নিজেরাই পরিচালনা করার। এর নেপথ্যে ছিলেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। এই প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৭৭ সালে ব্র্যাকের সঙ্গে এমসিসির (মেনানাইট সেন্ট্রাল কমিটি) চুক্তি হয়। যৌথভাবে এক বছর ওই কারুপণ্যের দোকান পরিচালিত হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে জন্ম আড়ং-এর। শুরু নতুন পথচলার। পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। আড়ংয়ের ডিজাইন অফিস তখন মগবাজারে। এই আউটলেটের পেছনের একটি বাড়িতেই ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিল এর অফিস। তখন ডিজাইনার ছিলেন তিনজন। তাঁদেরই একজন চন্দ্র শেখর সাহা। তিরাশি সালে এর অফিস চলে আসে সোবহানবাগে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তোবারক হোসেনের বাড়িতে। দোতলা ভবন। নিচে দোকান, উপরে অফিস। সঙ্গে গ্যারেজে টেইলারিং ইউনিট। সে বছরই মগবাজারে আড়ং আউটলেট খোলার পাশাপাশি মানিকগঞ্জে শুরু হয় আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম।
নিঃশব্দে বাড়তে থাকে আড়ংয়ের কর্মপরিধি। ফলে দোতলা বাড়িতে জায়গা না হওয়ায় ১৯৮৫ সালে পাশের বাড়িটিও নেওয়া হয়। এটা ছিল তোবারক হোসেনের ভায়রার বাসা। এই বাড়ির দোতলায় কোয়ালিটি কন্ট্রোল সেকশন খোলা হয়। নিচে ডিজাইন স্টুডিও। আরও কিছুদিন আড়ং নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় নেয়। আর সঠিক সময়ে সোবহানবাগ থেকে আড়ং চলে আসে লালমাটিয়ার আদেল প্লাজায়। সেটা জুলাই ১৯৮৭। আর পরের বছর সোবহানবাগের অফিস স্থানান্তর করা হয় শ্যামলীতে। সেখানে ছিল ছয় বছর। ১৯৯৬ সালের আড়ংয়ের অফিস আসে মহাখালীর আড়ং ভবনে। এটা এখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস। আর ওই ভবন থেকে স্থায়ীভাবে আড়ংয়ের অফিস তেজগাঁওয়ের আড়ং সেন্টারে নিয়ে আসা হয় ২০০৮-এ।
৪০ বছরে আউটলেটের সংখ্যা ২১। ঢাকা ছাড়াও আড়ংয়ের উপস্থিতি নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও খুলনায়। আগামী বছর এই কাফেলায় যোগ হবে আরও দুটি। একটি ঢাকায়, অন্যটি ঢাকার বাইরে।

পিঠোপিঠি বেড়ে ওঠা
আড়ং। জ্ঞান হওয়া অবধি শুনে আসছেন এই শব্দ। ১৯৭৮ সালে শুরু আড়ংয়ের; তিনি তখন চার। পরে অফিস সোবহানবাগে আসার পর প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে অন্তত কয়েক ঘণ্টা তাঁর কেটেছে আঙ্কেল আর আন্টিদের টেবিলে টেবিলে। আঁককষা, লেখালেখি- আরও কত কী। এ যেন পিঠোপিঠি বেড়ে ওঠা। বাড়িতে নিয়মিত আলোচনা, পরিকল্পনা এমনকি ফটোশুট হচ্ছে। তাই বলে এর সঙ্গে জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে যাবে, তা অন্তত ভাবেননি। অথচ আজ সামনে থেকে সামলাচ্ছেন আড়ংয়ের কর্মযজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বেই উদযাপিত হলো আড়ংয়ের ৪০ বছর পূর্তি। সম্প্রতি সেসব নিয়েই কথা বলেছেন ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের সিনিয়র ডিরেক্টর তামারা হাসান আবেদ।

তামারা হাসান আবেদ

আমেরিকায় ইকোনমিকস আর ফাইন্যান্সে উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করে ক্যারিয়ার গড়েন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ে। কিন্তু নাইন-ইলেভেন সব ওলট-পালট করে দেয়। প্রতিবেশী হারানোর বেদনা, মুসলমানদের ওপর মানসিক নিগ্রহ মিলিয়ে তাঁর মন টিকছিল না। বাবাকে ফেলে বিদেশে থাকতে ইচ্ছেও হচ্ছিল না। তবে দেশে ফিরলেও ভবিষ্যৎ ভেবে উঠতে পারছিলেন না। জাতিসংঘে চাকরি নিয়ে আফগানিস্তানে যাওয়ার কথাও ভেবেছেন, বলছিলেন তিনি।
এদিকে তখন ক্রান্তিতে আড়ং। পুরোনোরা না থাকায় নেতৃত্বের সংকট স্পষ্ট। বাবার অনুরোধে তাই খন্ডকালীন দায়িত্ব নেওয়া। তা-ও কেবল ডিজাইন ডিপার্টমেন্টে। সেটা জানুয়ারি ২০০২। কিন্তু অর্থনীতি থেকে ডিজাইনে আসার দ্বিধা সরিয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। ডিজাইন থেকে প্রডাকশন হয়ে রিটেইলিং। ধীরে ধীরে পুরো প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হন। আর মার্চ থেকে পুরো দায়িত্ব নেন।
মধ্যবর্তী ১৬ বছরে আড়ংকে তিনি উন্নীত করেছেন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। টার্নওভার ছুঁয়েছে ৮৫০ কোটিতে। তবে নিজেকে নস্টালজিক মানুষ না বললেও নস্টালজিয়া তাঁকে ছাড়ছে না। আড়ংয়ে ৪০ বর্ষপূর্তিতে দাঁড়িয়ে লুক ব্যাক তাঁকে করতেই হয়েছে, স্বীকার করলেন তামারা।
১০ বছর আগে ৩০ পূর্তি উদযাপিত হয়েছিল ধুমধাম করে। এবার চার দশক পূর্তি উদযাপন করলেন মহাসমারোহে। তামারা বললেন, আয়োজন সবার জন্য। তবে তরুণেরা একটু বেশিই প্রাধান্য পেয়েছে। তা ছাড়া আমাদের সমৃদ্ধ কারুশিল্পের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম সেভাবে পরিচিত নয়। প্রদর্শনী আর হাতে-কলমে শেখার মধ্য দিয়ে আমাদের লোকশিল্পের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করানোটাও ছিল উদ্দেশ্য।
আড়ং একটা নাম, একটা ব্র্যান্ড বা স্রেফ একটা প্রতিষ্ঠান নয়। এর সঙ্গে সম্পর্ক প্রজন্মান্তরের। সব বয়সের সম্পৃক্ততায় সেটাই প্রমাণিত হয়। তাই তো তামারা বললেন, সেই আটাত্তর সাল থেকে যারা আছেন, তারা হয়তো এখন কাজ করতে পারেন না। কিন্তু তাদের ছেলেরা দায়িত্ব নিয়ে সময়োপযোগী দৃষ্টিভঙ্গিতে আড়ংয়ের জন্য কাজ করছেন। একইভাবে ভোক্তা থেকে আড়ংয়ের কর্মী- প্রজন্মান্তর হয়েছে সবার। তবে আবেগ থেকে গেছে অবিকল। সবার কাছে আড়ং তার নিজের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিগত ১৬ বছরে আড়ংকে সময়োপযোগী করার, জ্যেষ্ঠদের পাশাপাশি তরুণদের চাহিদা পূরণের নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তাগা থেকে হারস্টোরি হয়ে তাগা ম্যান- প্রতিটি সাবব্র্যান্ডই দারুণ সফল। ফ্যাশন এবং লাইফস্টাইল পণ্যের পাশাপাশি চার দশক পূর্তিতে আড়ং-অনুরাগীদের জন্য নতুন উপহার বিউটি প্রডাক্ট। যোগ হচ্ছে স্কিন কেয়ার লাইন, জানালেন তামারা।
পাশাপাশি দেশের বাইরে আউটলেট না খুলে বরং গ্লোবাল ই-কমার্সকে শক্তিশালী করায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি।
মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, হাইস্ট্রিট থেকে স্ট্রিটওয়্যার- বছরের পর বছর প্রডাক্ট লাইনে এই বৈচিত্র্য সফলভাবে বজায় রেখে চলেছে আড়ং। এর কারণ হিসেবে তামারা মনে করেন, সবাইকে নিয়ে ভাবার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।
এ ছাড়া বৈশ্বিক ফ্যাশন পরিমন্ডলের পরিবর্তিত পরিস্থিতি আর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মাথায় রেখেই ভবিষ্যৎ প্রডাক্ট লাইন নিয়ে কাজ করছে আড়ং, এ-ও যোগ করলেন তামারা আবেদ।

sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ফয়সাল সুমন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top