ফিচার I আয়ুর্বস্ত্র
যেন রোগ ভোলানোর জাদু। এমন এক বস্ত্র, যা সারাতে পারে ত্বকের সমস্যাও। কীভাবে? খুঁটিনাটি জানিয়েছেন জাহেরা শিরীন
‘স্বস্থস্য স্বাস্থ্য রক্ষনম’ আর ‘আতুরস্য বিকার প্রশমনন চ’। যার অর্থ সুস্থের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং অসুস্থের চিকিৎসা। আয়ুর্বেদের মূল লক্ষ্য এ দুটি। যার পুরো প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত ভেষজ উদ্ভিদ, প্রাণিজ ও খনিজ দ্রব্যের ওপর। ফলে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পুরোনো আয়ুর্বেদ নামক বিশেষ এ জীবনবিজ্ঞান পুরোপুরি পরিবেশবান্ধবও বটে, যা মানব শরীরকে প্রাকৃতিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার সঞ্চার করে, যার ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী। তাই যাপিত জীবনচর্চায় আয়ুর্বেদের অনুশীলন জনপ্রিয় আজ অব্দি। রূপচর্চাতে এর ব্যবহার বহু পুরোনো প্রসঙ্গ। তবে সম্প্রতি ফ্যাশনও আলোকিত হচ্ছে আয়ুর্বেদের অনুপ্রেরণায়। যদিও এই ধারা বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। আয়ুর্বস্ত্র নামে। আয়ুর্বেদেরই শাখা হিসেবে। প্রাচীন সেই প্রথাতেই এখন প্রভাবিত হচ্ছে ফ্যাশন বিশ্ব। কারণ, ফ্যাশন-সচেতনদের মাঝে প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়ার ঝোঁক প্রবল। প্রতিদিনকার পরিধেয় পরিবেশকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা নিয়েও বাড়ছে সতর্কতা। ফলাফল আয়ুর্বস্ত্রে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন অনেকেই।
আর হবেন নাই-বা কেন? নাইলন, পলিয়েস্টার বা অ্যাক্রিলিকের মতো সিনথেটিক ফ্যাব্রিকগুলোর উৎপাদন স্বল্প সময়ে সম্ভব, সাশ্রয়ী হলেও বছরের পর বছর অপচনশীল রয়ে যায়। ফ্যাব্রিকগুলোর মাইক্রোফাইবার ধুয়ে গিয়ে সমুদ্রের পানি দূষিত করে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এমন কাপড়ে তৈরি পোশাক দিয়ে প্রতিনিয়ত দূষিত হয় পরিবেশ। এ ছাড়া নন-ন্যাচারাল এসব ফ্যাব্রিক ব্রিদেবল নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আরামপ্রদ নয়, বরং অস্বস্তিদায়ক। আর শরীরের ত্বকের জন্যও ক্ষতিকর। সিনথেটিক কাপড়ে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ডাইয়েরও বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এত সব বিবেচনায় আয়ুর্বস্ত্র নিঃসন্দেহে ভালো বিকল্প। কারণ, স্টাইলিংয়ে নতুনত্ব নিয়ে আসার পাশাপাশি সচেতন ফ্যাশন সমাধান দিতে এর জুড়ি নেই। তা ছাড়া এসব ফ্যাব্রিকে তৈরি পোশাক শরীরের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষায় সহায়ক।
কী এই আয়ুর্বস্ত্র? আয়ুর্বেদের অনুপ্রেরণায়, বৈদিক শাস্ত্র মেনে তৈরি হয় এই কাপড়। মূলত অর্গানিক সুতি, প্রাকৃতিক সিল্ক, উল বা পাটের কাপড়কে বিভিন্ন ধরনের আয়ুর্বেদিক উপাদানের নির্যাস দিয়ে সিক্ত করে বা রাঙিয়ে নিয়েই তৈরি হয় বিশেষ এ ফ্যাব্রিক। ফলে উপাদানগুলোর রং তো বটেই, এর ঔষধি গুণাবলিও শুষে নেয় কাপড়। এ থেকে তৈরি পোশাক পরে নিলে ফ্যাব্রিকের মাধ্যমেই তা পরিধানকারীর ত্বকের সংস্পর্শে আসে। ভেষজ গুণাবলি ত্বকের মাধ্যমে প্রবেশ করে শরীরে।
আয়ুর্বস্ত্র তৈরিতে হলুদ, দারুচিনি আর লবঙ্গের মতো কিচেন এসেনশিয়াল বরাবরই জনপ্রিয়। এগুলো কাপড়কে রাঙায় সুন্দরভাবে, ন্যাচারাল ডাই হিসেবে চমৎকার। সেই সঙ্গে এগুলোতে থাকা শক্তিশালী হিলিং প্রোপার্টি শরীর ও ত্বকের জন্য উপকারী। যেমন হলুদের ব্যবহার কাপড়কে রাঙায় বিভিন্ন শেডের সোনালি আর হলুদ রঙে। সেই সঙ্গে এই কাপড়ে তৈরি পোশাক পরে নিলে হজমশক্তি বাড়ে। সারে ত্বকের জ্বালাপোড়া। ফুল বরাবরই আয়ুর্বেদের অংশ। বোটানিক্যাল ডাই হিসেবেও এগুলো চমৎকার। গাঢ় রঙের জিনিয়া, গাঁদা আর ক্যালেন্ডুলার ব্যবহার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। কাপড়ে সুন্দর রং তো দেয়ই, পাশাপাশি এগুলোর হিলিং এবং কামিং প্রোপার্টি দেহকে সুস্থ রাখে, রাখে প্রশান্ত। আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত সবুজ গাছগাছড়াও কাপড়কে বিভিন্ন রঙে রাঙাতে পারে। যেমন নিমপাতা দিয়ে ডাই করলে ন্যাচারাল বেইজ রং ধরে কাপড়ে। তুলসী কাপড়কে রাঙায় আর্দি অলিভ গ্রিনে। আর সবুজ গাছপালায় রাঙানো পোশাক থেকে মেলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল আর ইমিউনিটি বুস্টিং প্রোপার্টি। ডাইংয়ের ক্ষেত্রে ইন্ডিগো প্ল্যান্টের রয়েছে বহু বছরের জনপ্রিয়তা। এর ব্যবহারে কাপড়ে নানা শেডের নীল রং সৃষ্টি হয়। আর ইন্ডিগোর রাঙানো পোশাক ডিটক্সিফিকেশনে সহায়ক। ত্বকের জন্যও কোমল।
সারাতে পারে জ্বালাপোড়ার অস্বস্তি। এগুলো ছাড়াও চন্দন, চিত্রাথাই (আদাগাছ), লজ্জাবতীও ব্যবহৃত হচ্ছে আয়ুর্বস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়ায়, যা পরলে দেহের টক্সিন দূর হয় বলে প্রমাণ মিলেছে। সেই সঙ্গে মেটাবলিজম সমুন্নত হয়। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ত্বকের এলার্জি, অ্যাজমা সারাতেও সহায়ক এই ধরনের ফ্যাব্রিক। নিশ্ছিদ্র ঘুমের জন্যও আয়ুর্বস্ত্র দারুণ কাজের। তাই শুরুতে আয়ুর্বস্ত্র ব্যবহারে তৈরি করা হতো স্লিপওয়্যার, আন্ডারগার্মেন্টস, বেড কাভারিং, টাওয়েল, রোগীর অ্যাপ্রন আর মেডিটেশন ক্লদিং। কিন্তু সম্প্রতি ডিজাইনাররা এবং ব্র্যান্ডগুলো নতুনভাবে ভাবতে শুরু করেছে এই ফ্যাব্রিক নিয়ে। প্রতিদিনকার পোশাক থেকে পার্টিওয়্যার—সবেতেই স্টেটমেন্ট হিসেবে আয়ুর্বস্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে চলছে নানান নিরীক্ষা। এ ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বরাবরই এগিয়ে। ফলাফল, পদুচেরি বেসড ডিজাইনার ব্র্যান্ড ‘উপসনা’ এবং কলকাতা বেসড ব্র্যান্ড ‘এসসাহা’ তে মিলছে আয়ুর শাড়ি। আয়ুর্বস্ত্রে তৈরি। ভারতীয় ফ্যাশন লেবেল ‘লিকয়নে হেমান্ত’-এর দুই ডিজাইনার ডিডিয়ার লিকয়নে এবং হেমান্ত সাগার আয়ুর্বস্ত্র নিয়ে কাজ করছেন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। ব্র্যান্ডটির ‘আয়ুর্গানিক’ নামের কালেকশনটি তৈরি হয়েছে আয়ুর্বস্ত্র ঘিরে। তারা তৈরি করছেন মডার্ন শিলুয়েটের ট্রেন্ডি সব পোশাক। ড্রেস, শার্ট এমনকি ব্লেজারও। প্রতিটিই সার্টিফাইড আয়ুর্বস্ত্রে তৈরি। ব্র্যান্ডটি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। কারণ, আয়ুর্বস্ত্রে তৈরি এসব পোশাক শুধু স্টেটমেন্টই সৃষ্টি করছে না, পরিধানকারীর সুস্থ জীবনধারাতেও অবদান রাখছে উল্লেখযোগ্যভাবে। নিরাপদে রাখছে প্রকৃতির ভারসাম্য।
ছবি: হাসান রাজা