skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I নীলিমায় নীল

বাংলার নীল। বেঙ্গল ইন্ডিগো। এর জগৎজোড়া খ্যাতি। চাহিদাও। ঔপনিবেশিকতাই একে প্রসারতা দিয়েছিল, যদিও বাঙালির ইতিহাসে তা এক যন্ত্রণার অধ্যায় হয়ে আছে। আজ আর নেই নীলকর সাহেবদের নিপীড়ন; বরং পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষাপটে সেই নীল আজ কল্যাণের বার্তাবহ। সমৃদ্ধির অনুঘটক। কেয়ার বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে পরিবর্তনের সেই গল্প সরেজমিনে ঘুরে এসে লিখেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার এস.এম. মাঈন উদ্দিন ফুয়াদ

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি সব সময় যে মঙ্গলজনক হয়, তা হলফ করে বলা যাবে না; বরং কোনো কোনো সময়ে তাতে মন্দই প্রকট থাকে। আবার উল্টোটাও ঘটে বৈকি। বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে এই পুনরাবৃত্তিই উন্মোচন করে নতুন দিগন্ত। তৈরি হয় নতুন সুযোগ। বাংলায় নীল চাষ অন্তত সেই মঙ্গলের বার্তা শোনায়। ইতিহাসের দিক থেকে নীল চাষ নিয়ে আমাদের ধারণা খুব নেতিবাচক। বিশেষত নীলকর সাহেবদের অত্যাচার আর নীল বিদ্রোহের সেই ইতিহাস আজও বাঙালিকে তাড়িয়ে ফেরে। কিন্তু নেপথ্যের বাস্তবতা হলো, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মাটিতে কৃষকেরা অন্যান্য ফসলের ফাঁকে ফাঁকে নীল চাষ করতেন। উৎপাদিত সেই কৃষিপণ্য এ দেশে বাণিজ্য করতে আসা আরব, ওলন্দাজ আর গ্রিক বণিকেরা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতো ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চলের বাজারে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, বাংলার নীল বা বেঙ্গল ইন্ডিগো বিশ্বের সেরা নীলগুলোর একটি।
যা হোক, ১৭৮৮ সালের দিকে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের ফলে নীলের চাহিদা বহুগুণ বাড়ে। এর জোগান দিতে গিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মূলত এ দেশের কৃষকদের বাধ্য করে বছরভর নীল চাষে। তার ওপর ১৮৩৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে ভূমি অধিগ্রহণের বৈধতা লাভ করে। এই সুযোগ পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগিয়ে ভূমি অধিগ্রহণ করে সেই ভূমিরই কৃষককে আবার বাধ্য করে নীল চাষে। কারণ, বিশ্বব্যাপী নীলের চাহিদা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে উন্মাদ ও নির্দয় করে দিয়েছিল। তারা বাড়তি মুনাফার লোভে কৃষককে বাধ্য করেছে নীল চাষে। বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু শস্য আবাদের জায়গা ছিল, তাতেও ইংরেজরা বাধ্য করেছিল নীল চাষে। ফলে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে। পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ১৮৫৭ সালে বাঙালি সশস্ত্র বিপ্লব গড়ে তোলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে, যা নীল বিদ্রোহ হিসেবেই পরিচিত ছিল।
যা হোক, ১৮৭০ সালে সিনথেটিক ইন্ডিগো বা রাসায়নিক নীল আবিষ্কারের ফলে বাংলায় উৎপাদিত ন্যাচারাল ইন্ডিগোর বা প্রাকৃতিক নীলের চাহিদা স্তিমিত হয়ে যায় বিশ্ববাজারে।
পুনর্জাগরণ
যে মাটিতে নীলকরদের চাবুকের আঘাতে জর্জরিত হয়ে কৃষকেরা নীল চাষে বাধ্য হতেন, ১৫০ বছর পরে সেই রংপুরের মাটিতেই নীল ফিরে এসেছে কৃষকের আশীর্বাদ হয়ে। মজার বিষয় হলো, কৃষকেরা সানন্দে তাদের জমিতে নীল চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কারণ, স্থানীয় কৃষক এখন জেনেছেন, নীল চাষ আসলে কৃষিজমির জন্য ক্ষতিকর নয়; বরং তা জমির উর্বরতা বাড়ায়। অথচ আমরা উল্টোটাই জেনে এসেছি।
নীল চাষে কৃষিজমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে। কারণ, নীল লেগিউম জাতীয় শস্য। এর শিকড়ে রয়েছে একধরনের ব্যাকটেরিয়া, যা নাইট্রোজেন মজুত করে। তা মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে বেড়ে যায় জমির উর্বরতা। এ ছাড়া নীল গাছের যেকোনো অংশ মাটিতে পড়ে পচে গিয়ে প্রাকৃতিক সারের কাজ করে। ফলে অন্য ফসল ভালো হয়। এসব তথ্য এখন চাষিরা জেনেছেন। তাই নীল চাষ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই পুনর্জাগরণে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। কারণ, আগে নীল চাষের মুনাফা চলে যেত ইংরেজদের কাছে। বর্তমানে মুনাফা সরাসরি কৃষকের কাছেই থেকে যাচ্ছে।
পুনর্জাগরণের এই ইতিহাসও খানিকটা বৈচিত্র্যপূর্ণ। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে ফেলে যাওয়া নীল গাছ যে সত্যিকারের সেই ঐতিহাসিক নীল গাছ, তা রংপুরের স্থানীয় কৃষকেরা জানতেনই না। নীল গাছকে তারা কিছুদিন আগেও চিনতেন না; বরং তারা এটাকে ‘মালখড়ি’ হিসেবেই জেনেছেন; যা কেবল জ্বালানির কাজে লাগে। নীল চাষের পুনর্জাগরণে এমসিসির ভূমিকাও ব্যাপক। স্থানীয় বাজারে প্যাকেটজাত নীল পাউডার এরাই প্রথম বাজারজাত করে।
মালখড়ি থেকে নীল
রংপুরের অধিবাসীদের স্বাবলম্বী করার জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয় আন্তর্জাতিক এনজিও কেয়ার বাংলাদেশ। ‘নিজেদের জন্য নিজেরা’ তেমনই একটি স্থানীয় প্রকল্প। এর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় কারুশিল্পে পারদর্শীদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাদের কর্মসংস্থান এবং সেখান থেকেই লিডারশিপ তৈরি করা।
এই প্রকল্পে স্থানীয় কারুশিল্পীদের সবচেয়ে বেশি পারদর্শিতা ছিল সূচিকর্মে। ঐতিহ্যবাহী এই কাজকে সমকালীন ফ্যাশনে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে এবং এর মানোন্নয়নের জন্য মাঝেমধ্যে প্রকল্পটিতে বিদেশি ডিজাইনাররা কাজ করে থাকেন। তেমন একজন ডিজাইনার তার নিয়মিত কাজের মধ্যেই ‘মালখড়ি’ দেখে কৌতূহলী হন। পরে তিনি লক্ষ করেন, এটি আসলে সেই নীল গাছ। নীল আহরণ প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা করে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন। তখন থেকেই ‘নিজেদের জন্য নিজেরা’ প্রকল্পের সূচিশিল্পের সঙ্গে নীল উৎপাদন যোগ হয়ে যায়। এমন তথ্য জানিয়েছেন কেয়ার বাংলাদেশ-এর লিভিং ব্লু প্রকল্পের টেকনিক্যাল অফিসার সৈয়দ মুর্তজা জাহাঙ্গীর।
লিভিং ব্লু
কারুশিল্পীদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যে কেয়ার-এর তত্ত্বাবধানে ‘নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ (এনসিভিআই) প্রতিষ্ঠান চালু হয় রংপুরের রাজেন্দ্রপুরে। কারুশিল্পীদের নিয়ে কাজ করে অনেক কোম্পানি দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাদের জীবনের মান কতটুকু উন্নত হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যইে কেবল কারুশিল্পীদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তাদের হাতে তাদেরই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য এনসিভিআই গঠন করে কেয়ার। এর মূল লক্ষ্য নীল চাষে প্রান্তিক চাষিদের স্বাবলম্বী করা, নীল সংগ্রহের পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন, নীলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি করা। পাশাপাশি প্রাকৃতিক নীলের রাঙানো পণ্য তৈরি ও বাজারজাত করা। ‘লিভিং ব্লু’ আসলে এনসিভিআইয়ের ব্র্যান্ড নেম; যা ইতিমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে পণ্যের গুণ ও মানের বদৌলতে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে। লিভিং ব্লু স্থানীয়ভাবে শুধু নীলের গুঁড়া বাজারজাত করে। আর নীলের গুঁড়া এবং পণ্য উভয়ই বাজারজাত করে আন্তর্জাতিক বাজারে। কৃত্রিম রঙের নেতিবাচক প্রভাবের জন্য বিশ্বজুড়ে নতুন করে জোর দেওয়া হচ্ছে প্রাকৃতিক রঙের ওপর। ফলে ন্যাচারাল ইন্ডিগোর চাহিদা বাড়ছে। নতুন করে বাজার তৈরি হয়ে গেছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তাই এর চাহিদা, জোগান, সর্বোপরি চাষ পদ্ধতি নিয়ে নীলপ্রেমীদের আগ্রহের সীমা নেই।
আমরা জানার চেষ্টা করেছি এর চাষ, রঙ উৎপাদন এবং ডায়িং পদ্ধতি সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে লিভিং ব্লু কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় অনেক তথ্যই হাতে এসেছে, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
নীল বীজ সংগ্রহের সবচেয়ে বড় বাজার রংপুরের পাগলাপীরে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাটেও পাওয়া যাচ্ছে। এক কেজি নীল বীজের দাম ১৬০ থেকে ২৫০ টাকা। এক কেজি বীজে ২৫ শতক জমিতে চাষ করা যায়। দোআঁশ মাটিতে নীল গাছ ভালো হয়। অন্য মাটিতেও এটি জন্মে। নীল বীজ বোনার আগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এটি বোনা হয়। ১৫-২০ দিন লাগে চারা গজাতে। জন্মানোর ৬০ দিন পর নীল গাছ কাটা শুরু হয়। এর উচ্চতা সাড়ে ৩ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাথা থেকে নিচের দিকে ১৮ ইঞ্চিতে গিয়ে নীল গাছ কাটতে হয়। কমপক্ষে তিনবার কাটা যাবে ২০ দিন পরপর। তবে ভালো রঙ প্রথমবার কাটা গাছের ডাল থেকেই পাওয়া যায়।
চোখ রাখুন আগামী সংখ্যায়…

এই লেখা তথ্যবহুল করতে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন: টেকনিক্যাল অফিসার সৈয়দ মুর্তজা জাহাঙ্গীর, লিভিং ব্লুর প্রডাকশন ম্যানেজার মজিবুল হক মমি, ‘নিজেরা কটেজ’-এর ডিজাইনার ও গবেষক ফাইকুজ্জামান বাদশা ও ডিজাইনার আশরাফুর রহমান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top