ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I LFWউইন্টার ফেস্টিভ-২০১৯
শীত, উৎসব ও বিয়ের পোশাক নিয়ে প্রসিদ্ধ ও তরুণ ডিজাইনারদের কালেকশন। দুটি ইভেন্টে। একটি ল্যাকমে ফ্যাশন উইক, অন্যটি ইন্ডিয়া কতুর উইক
শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এরপর থেকে প্রতিবছরই উপমহাদেশীয় ফ্যাশনের নতুন সব চমক নিয়ে হাজির হয়েছে ল্যাকমে ফ্যাশন উইক। এবার ২০ বছরে পা দিল এই আয়োজন। কুড়ির তারুণ্যে উজ্জ্বল এবারের আসর। সেখানে ছিল আসছে শীত এবং উৎসবের পোশাকের নতুন ট্রেন্ডের বর্ণিল উপস্থাপনা। শুধু তা-ই নয়, জুতা, ব্যাগ, কেশসজ্জা, প্রসাধনের ট্রেন্ডের সাক্ষৎ পাওয়া যায় এই মঞ্চে। মুম্বাইয়ের পাঁচ তারা হোটেল সেন্ট রেজিসে ২১ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত চলে ফ্যাশনের এই মহাযজ্ঞ। প্রবীণ-নবীন ফ্যাশন ডিজাইনারদের পাশাপাশি এই উৎসবে বসেছিল তারার হাট। র্যাম্পে মডেলদের পাশাপাশি ছিল বলিউড তারকাদের ঝলমলে উপস্থিতি।
এবারের আয়োজকেরা হলো লাভ অ্যান্ড কেয়ার, আইএনআইএফডি, খাদি ইন্ডিয়া, নেক্সা, আরআই এলান, #স্ট্রিটফিট, ক্যাপ্রিসি, সিম্বা, স্মার্টওয়াটার, ল্যাকমে স্যালন, দ্য রিয়েল কাট ডায়মন্ড, বোটসহ অনেকে।
২১ আগস্ট মনীশ মালহোত্রার উৎসবের জমকালো পোশাক সম্ভারের প্রদর্শনী দিয়ে শুরু হয় এবারের ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের আয়োজন। এই ফ্যাশন শোতে সামনের সারিতে উপস্থিত ছিলেন কারিশমা কাপুর, কারিনা কাপুর, করণ জোহর, খুশি কাপুরের মতো বলিউড এ লিস্টাররা। শো স্টপার হয়ে র্যাম্পে আলো ছড়িয়েছেন ক্যাটরিনা কাইফ। পরেছিলেন মনীশ মালহোত্রার ডিজাইন করা কালো লেহেঙ্গা ও চোলি।
রেডি টু ওয়্যার
এবারের ফ্যাশন উইকে কী ছিল না? যেমন ছিল বিখ্যাত সব ডিজাইনারের করা উৎসবের পোশাকের সম্ভার, তেমনি ছিল শীতের পোশাকের রেডি টু ওয়্যার কালেকশনের বাহার। যদি রেডি টু ওয়ার কালেকশনের কথাই বলি, তবে বলতে হবে নতুন চারটি লেবেল, সিক্স ফাইভ সিক্স স্ট্রিট, বিস্কিট, গুন্ডি স্টুডিও এবং জায়ওয়াকিংয়ের কথা। প্রতিটি ব্র্যান্ডই হাজির করেছে স্ট্রিট স্টাইলের নিজস্ব ধারা।
সিক্স ফাইভ সিক্স স্ট্রিটের প্রতিষ্ঠাতা ডিজাইনার দিল্লির দুই বোন আভনি এবং আম্বার আনেজা মঞ্চে এনেছেন তাদের ‘উই টু পয়েন্ট ও’ প্রজেক্ট। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন ‘উইকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিস্কিটের শ্রুতি ও হারষা বিশ্বজিৎ ‘ইউনিসেক্স’ পোশাকের কনসেপ্ট ‘স্পেসড আউট’নামের প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হন। এর প্রধান ফোকাস ছিল ক্লিন লাইন, নিউট্রাল কালার এবং স্টেটমেন্ট অ্যাকসেসরিজ। জয় অজয় জালালের ব্র্যান্ড জায়ওয়াকিংয়ের কালেকশনে ছিল বোল্ড নিওন রঙের ব্যবহার। বিস্কিটের মতো তারাও জেন্ডার নিউট্রাল কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছেন। আর গুন্ডি স্টুডিওর পুরো আয়োজনে ছিল অত্যন্ত সাহসী উপস্থাপনা। ডিজাইনার নাতাশা সুমান্তের মিউজ র্যাপার রাজকুমারী র্যাম্পকে একটি স্টেজ শোকেসে পরিণত করে।
শীতে সাধারণত সবাই ঘুরতে যায়। এটা মাথায় রেখে কিছু ফ্যাশন ডিজাইনার তৈরি করেছেন বিচিত্র পোশাক। বাঙালি ডিজাইনার নীলাঞ্জনা ঘোষ এবং কণিকা সচদেবের কথা না বললেই নয়। ‘যাযাবর’ এর এই দুই ডিজাইনার মধ্যবিত্তদের কথা চিন্তা করে তাদের ‘চায় অ্যাট মুঘলাই জংশন’ সংগ্রহে বানিয়েছেন জনপ্রিয় ডিজাইনার রিতু কুমারের সংগ্রহে ছিল হাল ফ্যাশনের ভ্রমণকালীন পোশাক, যা হালকা ধাঁচের, কিন্তু স্টাইলিশ। তবে রিতু কুমারের নজরকাড়া সংগ্রহে ছিল নারী ঘোড়সওয়ারিদের জন্য ডিজাইন করা নতুন ধরনের পোশাক এককথায় অসাধারণ।
কয়েকজন ডিজাইনার পুরোনো ধারাও ফিরিয়ে আনেন ল্যাকমের মঞ্চে। পল্লবী মোহন সত্তর দশকের ট্রেন্ডে নতুনত্বের পাশাপাশি প্রদর্শন করেন হিট সেট ফ্যাব্রিক, শিফনের ওপর সিকোয়েন্স, পালকের কাজ। সোনাল ভারমা ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাবেকিয়ানার সঙ্গে আনেন চেক প্রিন্টের কোট, প্যান্ট, গাউন।
‘এস’-এর সুনয়নার আয়োজনে ছিল সুতির হট প্যান্ট-শর্ট টপ, ডেনিমের বেলবক্স, জাম্প স্যুট, স্কার্ট আর লং জ্যাকেট। এসডব্লুউজিটির আয়োজনে ছিল কালো, গাঢ় চকলেট, ধূসর রঙের লং গাউন, কোট, নেট-কটন মিক্স গাউন, পালাজো। শীতের পোশাকে অভিনবত্ব ছিল অনুরাগ গুপ্তার ডিজাইনেও।
উৎসবের রঙে রঙিন
বিয়ের পোশাকের নতুন ধারা নিয়ে ল্যাকমের মঞ্চে হাজির ডিজাইনাররা। জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেখানো হয় গৌরাঙ্গ শাহ, জয়ন্ত রেড্ডি, অর্পিতা মেহতা, অনুশ্রী রেড্ডির কালেকশন। ব্যান্ড পার্টির বাদ্য, বিয়ের গান, মঞ্চ, কনে- সব মিলিয়ে ল্যাকমের মঞ্চের চারদিকে ছিল বিয়ের উষ্ণতা এবং উৎসবের আমেজ। অর্পিতা মেহেতার বিয়ের বিভিন্ন মুহূর্তের পোশাক পরে র্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা।
গৌরাঙ্গ শাহের ‘পেশওয়াই’ সংগ্রহে ছিল বৈচিত্র্যময় শাড়ি ও লেহেঙ্গা। অনুশ্রী রেড্ডির ‘গুলাল’ আয়োজনে দেখা গেছে বিয়ের পোশাকের সাবেকি ধাঁচ- ভারী জারদৌসি, কাতান ও মুক্তোর কাজ, তবে নতুনত্ব ছিল কাপড়ে। আবরণের ডিজাইনার অলকা শর্মা উৎসবের পোশাককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি চা-পাতা, হলুদসহ নানান প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে রাজস্থানের প্রাচীন মেওয়াড় শিল্পকলা ‘ডাবু’কে তুলে ধরেন পোশাকে।
সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে
ল্যাকমে ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় দিন মানেই সাসটেইনেবল ফ্যাশন ডে। সুতি পোশাকের জন্য। ডিজাইনাররা ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী কাপড় ব্যবহার করে সমকালীন পোশাকের যে নতুন ধারা তৈরি করেন, তা এই দিবসের মূল বিষয়। পৃষ্ঠপোষকতার সূত্রেই ইভেন্টটির নাম খাদি ইন্ডিয়া শো।
এতে ডিজাইনার গৌরব খানিজো টাইডাইয়ের পোশাকের সঙ্গে উপস্থাপন করেন স্কার্ফ কোট, ধুতির ওপর কোট, জ্যাকেট। পল্লবী ধিওয়ানি পরিবেশন করেন পিঙ্ক ও ধূসর রঙের মিশ্রণে নানা ধরনের শর্ট কুর্তা, প্যান্ট, কোট। ডিজাইনার অনুজ ভুটানি খাদিকে তুলে ধরেন এইখানে।
তবে সাসটেইনেবল ফ্যাশনকে অন্য ধারায় নিয়ে গেছেন বিখ্যাত ডিজাইনার অমিত আগারওয়াল ও আব্রাহাম অ্যান্ড ঠাকুর। উভয়ই মঞ্চে আনেন সাসটেইনেবল সিনথেটিক কাপড়ের তৈরি নজরকাড়া পোশাক।
জেনারেশন নেক্সট
এবারও ল্যাকমে ফ্যাশন উইকে একদল তরুণ ডিজাইনার বড় বড় নামজাদা ডিজাইনারের পাশাপাশি পোশাক প্রদর্শনের সুযোগ পান। আইএনআইএফডি আয়োজিত ‘জেন নেক্সট’ শীর্ষক এই আয়োজনে সারা দেশের ৪০০ ডিজাইনারের মধ্য থেকে বাছাই করা সেরা ছয়জন পোশাক প্রদর্শন করেন।
সাহিব ভাটিয়ার সংগ্রহে ছিল শীতের ট্রেঞ্চ কোট, জ্যাকেট, ব্লেজার। এগুলোয় ছিল একই সঙ্গে জাপানি ট্র্যাডিশনাল লেয়ারিং এবং অস্ট্রেলিয়ান অ্যাবওরিজিনাল আর্টের ছোঁয়া। গৌরব সিং খাদি কাপড়ে লেয়ারিং, ড্রেপিং, বনিং টেকনিক ব্যবহার করে বানিয়েছেন দারুণ সব জ্যাকেট, টপস, স্কার্ট। অঙ্কিতা শ্রীবাস্তব সবাইকে তার কালেকশনের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেন সম্পূর্ণ নতুন এক ফ্যাব্রিক, যার নাম ‘কুপরো’। একে ভেগান সিল্কও বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন রকমের কাপড়ের অভিনব ব্যবহার। লিনেন, লিনেন সিল্ক, সিল্ক অরগ্যাঞ্জা, পাট এবং সুতি কাপড়ের পোশাক দেখা গেছে তার সংগ্রহে।
লাদাখের স্ট্যানজি পালমো তার তৈরি পোশাকে স্থানীয় সৌন্দর্য তুলে ধরেন। তিনি ব্যবহার করেন পশমিনা, নাম্বু নামের লাদাখ উল, রেয়ন, সুতি ও লিনেন কাপড়। সবাইকে পরিচয় করিয়ে দেন সেখানকার ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘গোঞ্চা’র সঙ্গে। আসামের মঞ্জুশ্রী সাইকিয়ার ‘উরা মাকু’ সংগ্রহে ছিল ওই অঞ্চলের শিল্পকলা। এরি, মুগা সিল্ক, অর্গানিক সুতি, চান্দেরি সিল্ক দিয়ে তিনি পরিবেশন করেন র্যাপ স্কার্ট, ল্যাপেল লেস জ্যাকেটের সঙ্গে প্যান্ট, কোট ড্রেস।
আরও কিছু
ল্যাকমে ফ্যাশন উইক একই সঙ্গে আর্ট ও ফ্যাশন প্রদর্শনের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। যখন আর্টের কথাই এলো, তখন কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনারের কথা না বললেই নয়। সলিতা নন্দার পোশাকে ছিল রঙের বাহার। অন্যদিকে ডিজাইনার দিয়া-রাজবীরের পোশাকগুলোতে ছিল ফুলের ছোঁয়া। ফ্লোরাল এমব্রয়ডারির ওপর সিকোয়েন্সের কাজ করা চোলি ও ব্লাউজ এবং লেহেঙ্গার কালেকশন ছিল তাতে।
এবার আরও নজর কাড়ে স্টেফানো ফুনারি এবং পূর্ণিমা পান্ডের ‘আই ওয়াজ আ শাড়ি’ কালেকশন। কাপড় রিসাইকেলের এটি একটি অনন্য উদ্যোগ। সারা দেশ থেকে তারা পুরোনো শাড়ি সংগ্রহ করে ছয় বছর ধরে বানাচ্ছে নানা ধরনের স্টাইলিশ পোশাক। বাদ যাচ্ছে না জুতা, ব্যাগ, পাগড়িও।
২৫ আগস্ট শেষ হয় ফ্যাশনের এই মহোৎসব। এই দিন ল্যাকমের পণ্যদূত হয়ে মঞ্চে হাঁটেন কারিনা কাপুর।
ইন্ডিয়া কতুর উইক ২০১৯
ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এবং হিন্দুস্তান টাইমসের আয়োজনে গত ২২ থেকে ২৮ জুলাই হয়ে গেল ইন্ডিয়া কতুর উইক ২০১৯। দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে। এটি ছিল কতুর উইকের দ্বাদশ আসর। এবারের আয়োজন ছিল একটু ভিন্ন। কারণ, প্রায় সপ্তাহব্যাপী চলে এই ব্যয়বহুল এবং অভিজাত ফ্যাশনের মহোৎসব। আর প্রতিটি ভেন্যুতে কেবল একজন ডিজাইনারের পোশাকই প্রদর্শিত হয়। বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার অমিত আগারওয়াল, সুনিত ভারমার পাশাপাশি পোশাক প্রদর্শন করেন রাহুল মিশ্র, তরুণ তাহিলিয়ানি, পঙ্কজ অ্যান্ড নিধি, রেয়নু টেন্ডন, শ্যামল অ্যান্ড ভূমিকা, ফাল্গুনী পিককসহ অনেকে।
অমিত আগারওয়ালের শো দিয়ে শুরু হয় এবারের কতুর উইক। তার সৃষ্টিতে ছিল লেয়ারিং, শিলুয়েটের ব্যবহার। কাপড় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন রিসাইকেল পলিমার। রঙে ছিল বৈচিত্র্য। পাম, গোল্ড, ব্লাশ, সিলভার, এমারেল্ড, আইভরি রঙের বাহারি সব গাউন এবং স্যুট ছিল তার কালেকশনে। অমিত আগারওয়ালের মতো গৌরব গুপ্তা উপস্থিত হন গাউনের সম্ভার নিয়ে। পার্টির পাশাপাশি এগুলো পরা যাবে বিয়েতেও। একই কথা খাটে তার ডিজাইন করা ছেলেদের স্যুটের ক্ষেত্রেও।
প্রথমবারের মতো কোনো ফ্যাশন উইকে পোশাক নিয়ে হাজির হন পঙ্কজ ও নিধি। এর আগে কেবল প্রাইভেট কাস্টমারদের জন্যই পোশাক ডিজাইন করেছেন তারা। তাদের কালেকশনে ছিল কনের জন্য লং জ্যাকেট এবং ফিটেড ড্রেস। পাশাপাশি পোশাকে ছিল থ্রিডি হ্যান্ড কাট অ্যাপ্লিকের উপস্থিতি।
শ্যামল অ্যান্ড ভূমিকার ডিজাইনার শ্যামল শোধানের মতে ইন্ডিয়ান কতুর অসম্পূর্ণ থাকবে ভারী ঐতিহ্যবাহী এমব্রয়ডারি এবং কারিগরের হাতের ছোঁয়া ছাড়া। ফলে তাদের লেহেঙ্গা, ব্লাউজ ও শাড়িতে ছিল ভারী হাতের কাজ। অন্যদিকে আরেক ডিজাইনার ফাল্গুনী পিকক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন জারদৌসি, চিকানকারি এবং অ্যাপ্লিকের কাজ দিয়ে। তবে সব ডিজাইনারের কালেকশনে লাল রঙের আধিক্য দেখা গেছে। এবারের কতুর উইকে শো স্টপার হিসেবে র্যাম্পে ছিলেন অদিতি রাও হায়দারি, কিয়ারা আদভানির মতো বলিউড তারকারা।
ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট