স্মরণ I স্যার ফজলে হাসান আবেদের বর্ণাঢ্য জীবন
গত ২০ ডিসেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল তখনকার হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচংয়ে তাঁর জন্ম। সৈয়দা সুফিয়া খাতুন এবং সিদ্দিক হাসানের দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
১৯৫২ সালে পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্সে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে না পড়ে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান।
১৯৫৪ সালে আবেদ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। কিন্তু দুই বছর পর তিনি এ বিষয়ে পড়া বাদ দিয়ে লন্ডনে হিসাবশাস্ত্রে অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে ‘কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং’-এর ওপর তিনি প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত লন্ডন, কানাডা ও আমেরিকায় চাকরি করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে আসেন। তখন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। প্রতিদিনই মিছিল-মিটিং চলছে। একপর্যায়ে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। শুরু হয় ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন।
১৯৭০ সালে ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির চট্টগ্রাম অফিসে যোগ দেন। এরপর পদোন্নতি লাভ করে ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। শেল অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা— এই তিনটি দ্বীপের লাখ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মারা যায়।
ফজলে হাসান আবেদ, তাঁর বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সহকর্মী কায়সার জামান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবীর এবং নটর ডেম কলেজের শিক্ষক ফাদার টিম মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন, ত্রাণ বিতরণ করতে তাঁরা মনপুরায় যাবেন। এ সময় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলে মনপুরা দ্বীপের বিপন্ন ও বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সর্বস্ব এবং স্বজন হারানো মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা বিধ্বস্ত ঘরবাড়িও তৈরি করে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৭১ সালের মে মাসে লন্ডনে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সম্পৃক্ত হন স্বাধীনতাসংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তোলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন।
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধে ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা।
‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, প্রচারপত্র বিলি, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। পথনাটক, তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের কাজেও তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফজলে হাসান আবেদ সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
এক কোটি শরণার্থী, যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা তখন দেশে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আবেদ ভারত প্রত্যাগত শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিলেটের সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলকে তিনি তাঁর কর্ম এলাকা হিসেবে বেছে নেন।
১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন থেকেই বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিটি সংক্ষেপে ব্র্যাক-এর শাল্লা প্রকল্পের প্রথম পর্বের সূচনা হয়। এটিই ব্র্যাকের আনুষ্ঠানিক জন্মদিন।
দায়িত্ব পালন ও অবসর গ্রহণ
১৯৭২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা।
২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি ২০০১ থেকে ২০০৮ এবং ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০১৯ সালের ১ আগস্ট ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং চেয়ার ইমেরিটাস হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর গত ২৪ জুলাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন পদ থেকে এবং ২৬ আগস্ট ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারপারসন পদ থেকেও অবসর নেন।
সম্মাননা
১৯৮০ সালে র্যামন ম্যাগসাইসাই, ২০১০ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানজনক নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত হন, ২০১১ সালে ওয়াইজ প্রাইজ অব এডুকেশন, ২০১৪ সালে লেভ তলস্তয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল, স্প্যানিশ অর্ডার অব সিভিল ম্যারিট, ২০১৫ সালে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে সাউথ এশিয়ান ডায়াসপোরা অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
ক্যানভাস ডেস্ক