ছুটিরঘণ্টা I ইস্তাম্বুলের ঐশ্বর্য
ইস্তাম্বুলের আছে নিজস¦ রঙ। তাতেই রঞ্জিত অটোমান রাজবংশের ঐতিহ্যলালিত প্রাসাদ আর প্রার্থনাগৃহ। কারুকার্যময় সোনালি, সামুদ্রিক নীল ও সূর্যাস্তকালীন আকাশের রক্তিমে সাজানো। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
এয়ারপোর্ট থেকে নেমে বাস ধরে চললাম শহরের প্রাণকেন্দ্র সুলতান আহমেত স্কয়ারে। পথের পাশে বসফরাস নদী। কী গভীর নীল তার জল। এ শহরের মধ্যে বসফরাস দুই পাশের কৃষ্ণসাগর আর মারমারা সাগরকে আলাদা করেছে।
শহরটা এত আধুনিক আর সুসজ্জিত প্রাচীন যে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলা যায়। পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন শহর, জনসংখ্যাও কম। খুব উঁচু দালানকোঠা নেই। নগরের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যেন ভবনের উচ্চতায় অসমতা না থাকে। বেশির ভাগ ভবনের ছাদে লাল রঙের টালি। দূর থেকে মনে হয় বসফরাসের নীলের সঙ্গে লালের সমন্বয়।
সুলতান আহমেত স্কয়ার তখন উৎসবে মুখর। রাত আটটা। এখনো দিনের আলো ঝলমল করছে। তখন রমজান মাস, ইফতারের সময় রাত সাড়ে আটটা। সে কারণেই এত ভিড় ইস্তাম্বুলের এই প্রধান ট্যুরিস্ট স্পটে। এক জায়গায় দেখলাম, বিশাল মঞ্চে কয়েকজন স্থানীয় শিল্পী ঐতিহ্যবাহী অটোম্যান নৃত্য পরিবেশন করছেন। বাহ্, রোজার মাসে জনসাধারণের জন্য কত না মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা। বাস থেকে নেমে আমি হোটেল খুঁজতে লাগলাম। কেউ ইংরেজি জানে, কেউ জানে না। কিছুক্ষণ ঘোরার পর স্থানীয় একটা ছেলে আমাকে হোটেল চিনিয়ে দিল। আর হোটেল খুঁজতে গিয়ে কত যে প্রাচীন বাড়িঘর দেখলাম। পথে বিশাল গোলাপ বাগানে সারি সারি গোলাপের গুচ্ছ গুচ্ছ ঝাড় নুয়ে যেন আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। হোটেলে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল। এ রকম প্রাচীন গলিতে হোটেল বুক করার কারণ পুরোনো ইস্তাম্বুলকে অনুভব করা।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আটটায়। ইস্তাম্বুলে আমার প্রথম দিন। হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, আশপাশের সব বাড়িঘর আর মসজিদ, গির্জা কয়েক শ বছরের পুরোনো। বাড়িগুলো সংস্কার বা রঙ কিছুই করা হয়নি, পুরোনো ভাব বজায় রাখার জন্য বোধ হয়।
হোটেল থেকে বের হয়ে চললাম সুলতান আহমেত স্কয়ারের দিকে। আজকে শুধু আশপাশ ঘুরে দেখব। হাঁটতে শুরু করলাম। কারণ, প্রধান আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পটগুলো হাঁটা দূরত্বেই।
পথে শিশুদের খেলার একটা পার্ক দেখে ঢুকে পড়লাম। তখন একটিমাত্র শিশু এক বুড়োর সঙ্গে পার্কে বসে ছিল। জানতে পারলাম, শিশুটির নাম ইসমেত আর বুড়োটি এর পিতামহ। ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে ফের হাঁটতে শুরু করি। পুরোনো বাড়িঘর, স্থাপনা, ভেঙে পড়া দেয়ালের ছবি তুলছিলাম। এ শহর ছাব্বিশ শ বছরের পুরোনো আর শুধু এই এলাকার রাস্তা আগের দিনের মতোই রাখা হয়েছে, পথের বরফি পাথরের খাঁজে খাঁজে ইতিহাস যেন কথা বলছে।
সরু পথের দুপাশজুড়ে বিভিন্ন দোকানের পসরা। সবই স্যুভেনির। নয়তো রেস্তোরাঁ বা ট্যুর এজেন্সি। ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয়দের আবাসস্থল।
যারই ছবিই তুলতে চাই না কেন, হাসিমুখে রাজি হয়ে যায়। এ রকম সুখী ও বন্ধুবৎসল জাতি আর হয় না।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। পাশে একটা ফ্যাশন হাউস ছিল। আমাকে হঠাৎ উদয় হওয়া কেতাদুরস্ত স্যুট টাই পরা এক ভদ্রলোক বলল, ‘ম্যাডাম, তুমি কি মাইন্ড করবে আমার পরিচয় জানালে?’
ভাবলাম, একি জ্বালা রে বাবা।
সে বলল, ‘আমি ডেভি, ফ্রম ইতালি, আমার শোরুম পাশেই যেখানে ফাইনেস্ট ডিজাইনার কাপড়, জুতা আছে।’
আমি না না করতে করতে সে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল শোরুমের ভেতরে। আমি কখনো কোথাও ভ্রমণে গেলে কিছুই কিনি না। দামি জিনিসপত্র তো আরও না। শোরুমে ঢুকে বিনীতভাবে বললাম, ‘আপাতত আমার কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই। পরে দরকার মনে হলে আসব।’
দোকান থেকে ছাড়া পেয়ে কয়েক কদম হেঁটে সুলতান আহমেত মসজিদ বা ব্লু মস্কের সামনে এসে পৌঁছলাম। বাইরে থেকে মসজিদের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সংস্কারের কাজ চলছে তাই অর্ধেক মসজিদই ঢাকা রয়েছে। মসজিদের সামনে হরেক স্যুভেনির আর খাবারের দোকান।
স্থানীয় পুলিশ হাসি হাসি মুখ করে সুখী চালে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোনো অনিয়ম বা অপরাধের খবর নেই। দোকান খুলে রেখে চলে গেলে চুরি হয় না। খুন, গুমের কোনো রেকর্ড নেই, ঘরেবাইরে মেয়েরা নিরাপদ।
সুলতান আহমেত মস্ক বা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন অটোমান বাদশাহ সুলতান আহমেত। ১৬০৯-১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে। একে ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদও বলা হয়ে থাকে। কারণ, এর প্রতিটি গম্বুজ নীল আর ভেতরের টাইলসে একই রঙের প্রাধান্য। রাতে চারদিক থেকে নীল আলোর ফোয়ারা ছোটে।
প্রত্যেক বাদশাহই একটি হলেও বিশালায়তনের মসজিদ নির্মাণ করে গেছেন। যিতভাতোরোক চুক্তির (পনেরো বছর দীর্ঘ অটোমান ও অস্ট্রীয় রাজার যুদ্ধের মীমাংসায়) পর সুলতান আহমেত নিজের নামে ইস্তাম্বুলে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সে সময় তার হাতে যথেষ্ট অর্থ ছিল না। সে জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়ার পাশে অনেকখানি জায়গাজুড়ে মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচিত হয়। সে সময় আয়া সোফিয়া ছিল ইস্তাম্বুলের সবচেয়ে সম্মানিত মসজিদ— ইসলামিক জ্ঞান অর্জন, আলোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ পীঠস্থান। আয়া সোফিয়াকে টপকে সুলতান যে তার পাশেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে যাচ্ছেন, এতে ওলামারা নাখোশ ছিলেন।
সুলতান আহমেত মসজিদ নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় আট বছর। আয়তনে ও সীমানায় ইস্তাম্বুলের যেকোনো মসজিদের চেয়ে বড়। আকাশ সীমানার অনেকখানি অংশ আর বিযেনটিন রাজকীয় প্রাসাদের মসজিদের দখলে চলে যাওয়া দক্ষিণাংশের বড় জায়গা সে সময়ে অনেকেরই পছন্দ হয়নি।
বসফরাসের তীর ঘেঁষে, এ অপার নীল জলরাশির দিকে মুখ করে মসজিদের দিন কাটে।
এই মসজিদে রয়েছে পাঁচটি বড় ও আটটি মাঝারি আকারের গম্বুজ, ছয়টি মিনার। অটোমান ক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যকৌশল ও ইসলামিক নকশার আদলে এবং কিছুটা পার্শ্ববর্তী আয়া সোফিয়ার অনুকরণে এটি নির্মিত। স্থপতি ছিলেন সেদেফকার মেহমেত আগা, বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ সিনানের শিষ্য। সিনানের স্থাপত্যকলা অনুসৃত হয়েছে মসজিদের নকশায়।
প্রবেশপথের দরজায় মাথার ওপরে খোদাই করা আছে কোরআনের আয়াত।
মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকতেই বৃত্তাকার আঙিনা। সেখানে ওজু করার স্থান। আর আঙিনার মাঝখানে রয়েছে বিশালাকৃতির ফোয়ারা। উল্লেখ্য, অটোমান বাদশাহদের নির্মিত যেকোনো স্থাপনাই সুবিশাল ও রাজকীয়। তাদের তৈরি মসজিদগুলো যেমন বড় তেমনি প্রতিটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাঝখানে একটি বিশাল উঠোন, এর কেন্দ্রে বড় একটি ফোয়ারা।
মসজিদের ভেতরের উপরাংশ সাজানো রয়েছে টিউলিপের নকশা করা ২০ হাজার সিরামিক টাইলস দিয়ে। নিচে ২৬০টি রঙিন কাচের জানালা। হাতে আঁকা কাচগুলো সুলতান উপহার পেয়েছিলেন ভেনিসের রানির কাছ থেকে। কাচের রঙের কারণে মসজিদের অভ্যন্তর উজ্জ্বল দেখায়।
একেবারে নিচে আরও ২০ হাজার সিরামিক টাইলস বসানো। সেগুলোয় হাতে আঁকা নকশা। মসজিদের থামগুলো মর্মর পাথরের তৈরি। ভেতরের ছাদ গম্বুজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোলাকার। ছাদে সুচারু নকশায় লাল, নীল, সবুজ, খয়েরি, সোনালি রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। এ রঙগুলো অটোমান সময়কার চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিটি গম্বুজের ভেতরে আলাদা নকশা। মাঝখানে গোল করে কোরআনের আয়াত ক্যালিগ্রাফি করা, যা করেছিলেন তখনকার বিশিষ্ট শিল্পী সাইয়েদ কাসিম গুবারি। আর সে আয়াতকে কেন্দ্র করে চারপাশে ফুলের নকশা।
মসজিদের মিহরাব মর্মর পাথরের তৈরি। মিহরাবের সবচেয়ে উপরে ফুল, লতা, পাতা খোদাই করা নকশা। একটু নিচে সবুজ রঙের ওপর সোনালি হরফে কোরআনের আয়াত লেখা। ঠিক তার নিচেই ইমাম সাহেবের দাঁড়াবার স্থান। তা-ও রাজকীয় খোদাই করা, সোনালি রঙে ঢাকা। যেন কেউ সোনা দিয়ে মুড়ে দিয়েছে মিহরাবটি। এর দুপাশে রঙিন কাচের জানালা, বাহারি তার রঙ আর নিখুঁত তার নকশা।
মাথার ঠিক ওপরে যে সিরামিক টাইলস মসজিদের দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর রঙ নীল আর সমুদ্রাভ সবুজ। নিপুণ শিল্পীদের গুণী হাতের ছোঁয়ায় সেসব এখনো জ্বলজ্বল করছে আর জানান দিচ্ছে দেয়ালের অংশ হয়ে। এ ধরনের অঙ্কনকে বলা হয় ইযনিক, যেখানে নীল আর সমুদ্রাভ সবুজ রঙের ব্যবহার বেশি।
প্রতিটি গম্বুজের কেন্দ্রবিন্দু থেকে ঝুলে আছে বিশালাকৃতির ঝাড়বাতি। সুলতানদের আমলে নাকি এগুলো সোনা আর দামি হিরাজহরতে আবৃত ছিল। পরে মূল্যবান পাথর সরিয়ে নিয়ে জাদুঘরে স্থানান্তর করা হয়।
মসজিদের কার্পেটের রঙ টকটকে লাল। সূর্যাস্তের আগে আকাশ যেমন লাল হয়ে যায়, মেঝে ঠিক সেই রঙ ধারণ করেছে। তাতে আছে ফুল-পাতার নকশা। তুরস্কের আরামদায়ক নরম কার্পেটের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী!
নারীর নামাজ পড়ার স্থান আলাদা। খাঁজকাটা কাঠের দেয়াল দিয়ে তা আবৃত। এক জায়গায় লেখা আছে, ‘নামাজ পড়ার সময় নিজের ব্যাগের দিকে খেয়াল রাখবেন।’ বুঝতে পারলাম না, ব্যাগের দিকে খেয়াল রাখলে নামাজে মনোযোগ আসবে কীভাবে!
মসজিদ প্রাঙ্গণের বড় একটা অংশে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ।
তবে ভেতরে অমুসলিম নারীপুরুষের প্রবেশে বাধা নেই। নারীর মাথা ও পা ঢেকে যেতে হয়। সে জন্য প্রবেশদ্বারেই রাখা আছে স্কার্ফ আর লম্বা স্কার্ট।
সুলতান আহমেত মসজিদের মিনার নিয়ে কয়েকটি গল্প আছে। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গল্পটি বলছি। সুলতান তাঁর স্থপতিকে বলেছিলেন মসজিদের মিনারগুলো সোনা দিয়ে মুড়ে দিতে। কিন্তু তিনি শুনেছিলেন ছয়টি নির্মাণ করতে। কারণ, তুর্কি ভাষায় ছয় এবং সোনা দুটো শব্দ শুনতে প্রায় একই। তাই মসজিদে মিনার নির্মিত হলো ছয়টি। এদিকে মক্কা নগরীর মসজিদ আল হারামের মিনারও ছয়টি। এই মিল রাখা যায় না। তাই সুলতানের নির্দেশে মসজিদ আল হারামে আরও একটি মিনার নির্মিত হলো। সে আমলে বর্তমান সৌদি আরব তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
উল্লেখযোগ্য তথ্য : ঢাকা থেকে আকাশপথে ইস্তাম্বুল পৌঁছতে সময় লাগে (বিরতিহীন) আট ঘণ্টা কিংবা একটু বেশি।
ইস্তাম্বুলে সব মানের হোটেলের ব্যবস্থা আছে।
তুর্কি খাবারের সঙ্গে আমরা কমবেশি পরিচিত, এই যেমন কেবাব বা ডোনার। আমাদের দেশেই আমরা তুর্কি খাবার রেস্তোরাঁয় গিয়ে খুশিমনে খাই। তুরস্কে তো পছন্দ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় খাবার অবারিত।
ছবি: লেখক