skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ফ্যাশনের নতুন পর্ব

আর সবকিছুর মতো ফ্যাশনের পৃথিবীও গেছে বদলে। সময়ের প্রয়োজনে। জোরালো হয়েছে মিনিমালিজমের ধারা। বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন ডিজাইনাররা। ব্র্যান্ডগুলো তো বটেই

ফ্যাশন জগৎকেও অতিমারিজনিত মন্দা মোকাবিলা করতে হয়েছে। সে জন্য খুঁজে নিতে হয়েছে নতুন পথ। যেমন ত্রিশের দশকে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর সময় যখন সবার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ, তখনই আবির্ভাব হয় রেডি টু ওয়্যার পোশাকের। আবার চল্লিশের দশকে রাজনৈতিক সংঘাত ফ্যাশনে নিয়ে আসে ‘ফাংশনাল’ পোশাক। একইভাবে এই মহামারির জন্য ফ্যাশন বিশ্বে বিরাট পরিবর্তন ঘটছে। একে সংস্কার বলায় শ্রেয়। পরিচিত ফ্যাশনে যুক্ত হচ্ছে নতুন ট্রেন্ড। এই ধারা কেবল স্টাইলের জন্যই নয়, এটি মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্যও।
আরও টেকসই
কয়েক বছর ধরেই ফ্যাশন বিশ্বে শুরু হয়েছে টেকসই ফ্যাশনের চর্চা। বছরের গোড়ার দিকে একেই ধরা হচ্ছিল প্রধান ট্রেন্ড হিসেবে। নতুন স্বাভাবিকতায় এটি এখন ‘গোলায়াথ’ (অতি বিশাল ও শক্তিশালী) ট্রেন্ড। ফ্যাশনের গতিময়তায় নতুন ও ইউনিক ট্রেন্ডের পাল্লায় পড়ে এত দিন পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন হয় সাসটেইনেবল ফ্যাশন চর্চা। মহামারি এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। গত কয়েক মাসে ফ্যাশনের দুনিয়ায় যে পরিবর্তন দেখা গেছে, তাতে সাসটেইনেবল ফ্যাশনেরই প্রভাব লক্ষণীয়। এখন যত ট্রেন্ড আছে বা আসছে, সবকিছু একে ঘিরেই তৈরি হচ্ছে।
ধীরে চলো
ফার্স্ট ফ্যাশনের রাজত্ব শেষ হতে চলেছে। সময় এখন মন্থরতার। ফার্স্ট ফ্যাশনে দেখা যেত রানওয়েতে নতুন ট্রেন্ড আসতে না-আসতে তা চলে গেছে ওয়্যারড্রোবের ভেতরে! ব্র্যান্ডগুলো ক্রেতাদের নিত্যনতুন পণ্যের চাহিদা মেটাতে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশ থেকে সস্তা শ্রমে, নিম্নমানের কাপড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোশাক বানিয়ে নিত। করোনার প্রতিক্রিয়ায় এসব ব্র্যান্ডের ওপর বেশ খারাপ একটি প্রভাব পড়েছে। কোয়ারেন্টাইন বা লকডাউনের জন্য কমবেশি সবাই গৃহবন্দী। ফলে অনেকের আর্থিক অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। এই অবস্থায় যখন বেঁচে থাকাটাই একটা চ্যালেঞ্জ, তখন কেউ ফ্যাশন প্রোডাক্ট কেনা নিয়ে নিশ্চয় মাথা ঘামাবে না।
অন্যদিকে শিপিং আটকে যাওয়ায় অনেক পণ্য ঠিক সময়ে এসে পৌঁছায়নি। পৌঁছানো প্রোডাক্টগুলো ইন-স্টক বা ইনভেন্টরিতেই রয়ে গেছে। যেগুলোর বিপণন সম্ভব হয়নি। ফলে অনেক ফার্স্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ড বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক ব্র্যান্ড টিকতে না পেরে হারিয়ে যাবে। এই অবস্থাকে বিশ্লেষকেরা নাম দিয়েছেন ‘ফ্যাশন ডারউইনিয়ান শেক-আউট’। যারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে টিকে থাকবে, তারা নিজেদের ভালোর জন্যই বেছে নেবে স্লো ফ্যাশনের কৌশল।
ফ্যাশন ডারউইনিয়ান শেক-আউটের জন্য এখন স্লো ফ্যাশনের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এতে ব্র্যান্ডগুলো আস্তে আস্তে বিখ্যাত হচ্ছে। কারণ, এরা ভালো মানের পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে পোশাক ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বানানোতে বেশি জোর দিয়ে থাকে।
বি মিনিমাল বি হিউম্যান
ফার্স্ট ফ্যাশনের চক্করে পড়ে আগে মানুষ প্রয়োজন ছাড়াও শুধু চোখ আর মনের তৃষ্ণা মেটাতে ইচ্ছেমতো জামাকাপড়, জুতা ও অন্যান্য জিনিস কিনে আলমারি ভরিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এসব কম দামি নিম্নমানের পণ্যগুলোর শেষ আশ্রয় হয় ভাগাড়ে। এতে অপচয় হয় অর্থ ও সময়ের, বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবেশের ওপর। কয়েক বছর ধরে অনেক ইনফ্লুয়েন্সার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিনিমালিস্টিক জীবনধারা জনপ্রিয় করার জন্য প্রচারণা চালাচ্ছে। মানুষকে নানাভাবে উৎসাহিত করছে। পশ্চিমে অনেকেই এ ধরনের জীবনধারা সাদরে গ্রহণ করেছে, এর বিপক্ষ মতও আছে। কারও কারও ধারণা, পুরোপুরি মিনিমাল হওয়া সম্ভব নয় বা এটি বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়। তবে অতিমারি শিখিয়েছে, চাইলেই যে কেউ মিনিমাল হতে পারে। লকডাউনে এমন একটি অবস্থায় ছিল গোটা বিশ্বের মানুষ, যেখানে শুধু নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ছাড়া আর কিছু কেনার কথা ভাবতে পারেনি।
ফ্যাশনে এখন মিনিমাল ট্রেন্ড চলে এসেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনই সময় মানুষের ভেতর এই চিন্তা ছড়িয়ে দেওয়ার। ওয়্যারড্রোবে যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কখনো পরা হয় না এমন পোশাক বিলিয়ে দেওয়া দরকার সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে। অথবা দেওয়া যায় কোনো ব্র্যান্ডকে, যারা পুরোনো পোশাক, অনুষঙ্গ রিসাইকেল বা আপসাইকেল করে। পশ্চিমে এমন অনেক ব্র্যান্ড এখন বেশ নাম করেছে।
অনেকের এক পোশাক দ্বিতীয়বার না পরার নাক-উঁচু স্বভাব আছে। এর থেকেও বের হওয়ার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও সেলিব্রিটিরা জোট বেঁধেছে। অনেকে জনপ্রিয়দের অনুসরণ করে। এখন তারকাদেরও নিজেদের পুরোনো পোশাক পুনর্ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। সেসব ছবিও ঘুরে বেড়াচ্ছে ম্যাগাজিনের পাতায়। এ ছাড়া জনসাধারণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে স্লো ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো থেকে কেনাকাটা করার জন্য। কারণ, এদের ভালো মানের পণ্য চাইলে বছরের পর বছর ব্যবহার করা যাবে। এতে কমবে ঘন ঘন শপিং করার প্রবণতা। তাই বলা যায়, ফ্যাশন প্রোডাক্ট ব্যবহারে দায়িত্বশীল, সচেতন ও বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ হতে যাচ্ছে নতুন স্বাভাবিকতার বড় ধারা।
বৈশ্বিক নয়, আঞ্চলিক
ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো লোকাল ও গ্লোবাল- দুই ধরনের ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে পণ্য উৎপাদন করে। এখন লোকাল ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। কেননা, এ সময় অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বেশ ঝুঁকি। ব্যবসার খাতিরে অনেক ব্র্যান্ড লোকাল ইন্ডাস্ট্রির সাহায্যে নিজেদের কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। এতে তাদের খরচ অনেক কমেছে। এ ছাড়া লকডাউনের ভেতর অনলাইনে শপিং জনপ্রিয় হয়েছে। যারা এভাবে কেনাকাটা করেন, তারা অর্ডার দিয়ে বেশি দিন অপেক্ষা করতে চান না। তাদের কথা মাথায় রেখে লোকাল ইন্ডাস্ট্রি থেকে আগে যে পরিমাণ পণ্য তৈরির ব্যবস্থা হতো, আগামী দিনগুলোতে তা আরও বেড়ে যাবে। ফলে জনপ্রিয়তা বাড়ছে লোকাল ফ্যাশন ব্র্যান্ডের।
ডিজিটালাইজেশন
মহামারি ফ্যাশনে প্রযুক্তিকে আগের থেকে আরও বেশি সংযুক্ত করেছে। বলা যায় প্রযুক্তি বাঁচিয়ে দিয়েছে ফ্যাশনকে! নয়তো হারিয়ে যেত চীন, মস্কো, লন্ডন, মিলান, প্যারিস, ওত কতুর- সব ফ্যাশন উইক। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে মানুষ সরাসরি উপভোগ করতে পেরেছে এই আয়োজনগুলো। ডিজিটাল ফ্যাশন উইককে এখন অনেকে সাসটেইনেবল ফ্যাশনের একটি অংশ হিসেবে ধরে নিয়েছে। নতুন বাস্তবতায় ফ্যাশন উইক ভার্চ্যুয়ালি বেশি অনুষ্ঠিত হবে, তা বলা যায়।
নিউ ফরমাল
অতিমারির আরেক বাস্তবতা- ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। ঘরে থাকলে সবাই একটু আরামদায়ক পোশাকেই থাকতে চান। ভার্চ্যুয়াল অফিসের জন্য তাই সবার পছন্দ প্লেইন ক্যাজুয়াল কমফোর্ট ওয়্যার। এ জন্য অনেকে বেছে নিচ্ছেন নরমাল টি-শার্ট, সোয়েট শার্ট আর প্যান্ট। একেই ধরে নেওয়া হচ্ছে ‘নিউ ফরমাল’ পোশাক। অনেকেরই অভিমত, এভাবে যদি ঘরে বসে সবাই অফিস করতে থাকেন, তাহলে ধীরে ধীরে ফরমাল পোশাক হারিয়ে যাবে। আবার অফিসে কাজ করার ধারা শুরু হলেও এর প্রভাব থাকতে পারে।
জীবনের জন্য অনুষঙ্গ
মাস্ক এখন অপরিহার্য। মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির জন্য বাধ্যতামূলক বেশির ভাগ জিনিসই আমাদের কাছে একঘেয়ে লাগে। তবে মাস্কের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। ধারণার চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি এটি হয়ে উঠেছে অপরিহার্য ফ্যাশন অনুষঙ্গ। বিভিন্ন ব্র্যান্ড বাজারে এনেছে নানা ডিজাইনের বৈচিত্র্যময় মাস্ক। অনেকে ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচ করে ঘরেই বানিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি গ্লাভস পরার চলও শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে প্লাস্টিক সামগ্রী পরলেও এখন ফ্যাশনেবল গ্লাভসের দিকে ঝুঁঁকছে সবাই। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে মহামারি পরিস্থিতি শেষ হয়ে গেলেও মানুষের সুস্থ জীবনের তাগিদে এই অনুষঙ্গগুলো থেকে যাবে।

 ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top