skip to Main Content

ফিচার I জীবনের জন্য সবুজায়ন

পরিবেশদূষণে বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে গাছ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে। সুস্থ রাখে আমাদের

বৃক্ষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পরিবেশ বাঁচায়। মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২২ হাজার বার প্রশ্বাসের ফলে ১৬ কিলোগ্রাম অক্সিজেন গ্রহণ করে। সবুজ উদ্ভিদ সূর্যালোকের সংস্পর্শে কার্বন ডাই-অক্সাইডকে অক্সিজেনে রূপান্তর করে এবং বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
মানুষ ও প্রাণীর খাদ্যের উল্লেখযোগ্য উৎস বৃক্ষ। তা ছাড়া ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রার ভারসাম্য, বায়ুমন্ডলের বিশুদ্ধতা, পাখির নিরাপদ আবাসস্থল, মাটির ক্ষয় রোধ, ঝড়ের সময় ধ্বংসাত্মক বাতাসের গতিকে প্রশমিত করা—এসবেরও সহায়ক। প্রয়োজনের তুলনায় গাছ যত কমবে, এমন সুবিধাও তত কমে আসবে। এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়তে থাকবে এবং বিপর্যয়কালীন ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে।
গবেষকদের মতে, একটি দেশের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য মোট ভূখন্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে এর পরিমাণ ১০ ভাগের নিচে। এ দেশে বৃক্ষনিধন চলে নির্বিচারে। বনভূমি উজাড় করে এসব গাছ বিদেশে রপ্তানি হয় না, বরং অনেক সময় চোরাই পথে পাচার হয়। ফলে একদিকে বৃক্ষ উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে দেশ অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, জলযান তৈরিতে এবং জ্বালানির কাজেও গাছ নিধন হয়। গৃহস্থালির কাজে, ইট পোড়াতে, ছোট ছোট শিল্পকারখানায় জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু এই বাস্তবতা বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশে অনেকটাই ভিন্ন। বিশেষত, উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যথেষ্ট বনভূমি থাকার পরও তারা কাঠের ব্যবহার অনেক কমিয়ে দিয়েছে। সেখানে কৃত্রিম কাঠ, কাগজ, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদির মাধ্যমে সুদৃশ্য আসবাব তৈরি করছে। বিশেষ প্রয়োজনে খুবই সীমিতসংখ্যক বৃক্ষ তারা কাটে। পরিবেশ সুরক্ষার দায়বদ্ধতার কারণেই তারা মূলত কাঠের আসবাবের ব্যবহার হ্রাস করেছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অনেক দেশে কৃত্রিম বনভূমিও তৈরি করা হয়েছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক ইউনিট ইউনিসেফের একটি তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতিবছর ৮ হাজার ৫০০ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। অথচ বায়ুদূষণরোধে কার্যকর তেমন কিছুই করা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে শতকরা ২১ ভাগ। যদি কোনো কারণে এর ঘাটতি হয়ে অন্য গ্যাসের ঘনত্ব বা বালুকণার পরিমাণ বেড়ে যায়, তবে বায়ুদূষণ ঘটে। সবুজায়ন এই দূষণ কমাতে কার্যকর।
অন্যদিকে বাংলাদেশে নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে। এতে প্রাণিকুল হারাচ্ছে আবাসস্থল, কমছে খাদ্যের উৎস। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আধুনিক যুগে নগর উন্নয়ন দরকার। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় বৃক্ষ এবং প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার কোনো উদ্যোগ নেই। শহরকে মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে সীমিত সুযোগের মধ্যে বৃক্ষরোপণ, সংরক্ষণ এবং প্রাণিকুলের আবাসস্থল বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
প্রতিদিনই নগর বিস্তৃত হচ্ছে। প্রচুর মানুষ জীবিকাসহ অন্যান্য প্রয়োজনে শহর ও শহরতলিতে বাস করে। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য আধুনিক জীবনযাপনের জন্য। সে কারণে শহরের উন্নয়ন যেন পরিবেশবান্ধব ও মানুষের বাসযোগ্য হয়, সেভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরতলির ৭৮ হাজার ৫২৯ একর জমি বন বিভাগের নামে রেকর্ড হয়নি। আবার অনেক জমি ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়েছে। এসব দোটানার মধ্যে বৃক্ষ ও বনসম্পদ উজাড় হচ্ছে।
দেশজুড়ে ছোট-বড়-মাঝারি মানের ব্যাপক শিল্পায়ন, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, যাতায়াত ব্যবস্থার প্রসারসহ জীবনের নানা প্রয়োজনে যন্ত্রের বর্ধিত ব্যবহার অস্বীকার করা যায় না। এ কারণে প্রকৃতির ওপর বিরূপ চাপ বেড়েছে। এমনকি চাষের জমিও রক্ষা পাচ্ছে না অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে। কলকারখানার ধোঁয়া, দূষিত তরল, বর্জ্য, ক্ষতিকর গ্যাস উদ্গিরণ—এসবই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। বিপুল পরিমাণে বিষাক্ত তরল পদার্থ নিঃসরণের ফলে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, এমনকি মাটি হয়ে উঠেছে বৃক্ষের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তা ছাড়া নিঃসরিত গ্যাস ও ধোঁয়া থেকে তাপ তৈরি হচ্ছে, বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকর গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব উপাদান প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণিকুলের জন্য ক্ষতিকর।
প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং মানুষের জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন ও আধুনিকীকরণের জন্য নগর বিস্তৃত হবে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। এখন গ্রামও আর আগের মতো নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে মানুষ ও প্রাণিকুলের জীবন বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণ করা দরকার। নগর-পরিকল্পনার মধ্যে বৃক্ষশোভিত পার্ক অর্থাৎ ক্ষুদ্র পরিসরে বনায়ন রাখা প্রয়োজন। তা ছাড়া রাস্তার বিভাজকে গাছ লাগানো যেতে পারে। যেগুলো শহরের যান্ত্রিক ধোঁয়া থেকে সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করবে। সে জন্য বিভাজকের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখা দরকার—কোন ধরনের গাছ শহরের পরিবেশ, মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যেমন বিভাজক বা সড়কদ্বীপে রোপণ করা দরকার ছোট ঝোপজাতীয় গাছ অথবা যেগুলোর লম্বা ডালপালা অনেক ওপরে ছড়িয়ে যায় এমন বৃক্ষ। খেয়াল রাখতে হবে, সেগুলো যেন যানবাহন চলাচলের সময় রাস্তার আশপাশ দেখার ক্ষেত্রে কোনো বাধার সৃষ্টি না করে। সড়কের দুপাশের লাগানো যায় বড় গাছ। যেগুলো হতে হবে ঘন পাতাযুক্ত। যেন তার ছায়ায় পথচারীরা বিশ্রাম নিতে পারে। সেসবও হতে পারে ফল, ফুল, কাঠ বা ঔষধি গাছ।
ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট পার্ক, আছে রাস্তার বিভাজক, লেকের পাড়, নদীর তীর আছে। এসব জায়গায় পরিবেশ বুঝে বৃক্ষ নির্বাচন করা প্রয়োজন। যদিও এখানে দেশি ও পরিবেশ-উপযোগী বৃক্ষের চেয়ে বিদেশি এবং বাংলাদেশের মাটি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন গাছই বেশি চোখে পড়ে। এসব বৃক্ষের বেশির ভাগেই পাখি বাস করতে পারে না। তা ছাড়া এমন ধরনের কীটপতঙ্গ জন্মায় যেগুলো বাংলাদেশের প্রকৃতির পক্ষে সহায়ক নয়। এসব বৃক্ষের যেগুলোতে ফুল ও ফল হয়, সেসব পাখি খায় না। এসব গাছ প্রচুর পানি শোষণ করে। ফলে ওই অঞ্চলের মাটিতে লতাগুল্ম, ঝোপজাতীয় ছোট ছোট উদ্ভিদ সাধারণত জন্মে না। কাজেই কেবল পাখিই নয়, এসব লতাগুল্ম ও ঝোপঝাড়ে অন্যান্য পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ, প্রজাপতি ইত্যাদি ছোট ছোট প্রাণী বাস করতে পারে না। কেননা এসব প্রাণী একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। পাখি ফল ও কীটপতঙ্গ খায়। পতঙ্গ, প্রজাপতি পরাগায়ন ঘটায়; ফুল ফোটে, ফুলের গন্ধে ও মধুর লোভে মৌমাছি আসে—এভাবে চলে একটা প্রাকৃতিক জীবনচক্র, যেটি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণে বিপর্যস্ত।
আরও একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সেটি হলো, ঢাকা শহরের অনেক জায়গায় রাস্তা সংস্কার, বিভাজক বা সড়কদ্বীপ, ফুটপাত মেরামত ও তৈরি, ভবন নির্মাণ ইত্যাদি কাজ এসব স্থানের বৃক্ষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না নিয়ে করা হয়। অসংখ্য প্রচুর গাছ কাটা পড়ে। নগরের এসব স্বল্প পরিসর জায়গায়ও বৃক্ষ বাঁচতে পারে, সেখানে কান্ডের চারপাশে প্রয়োজনীয় মাটি রাখা দরকার। দুই কংক্রিটের মাঝে কয়েক ইঞ্চি স্থান মাটি দিয়ে ভরাট করে গাছ লাগালে তা সহজেই বাঁচবে। সংস্কারকাজ অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু বৃক্ষ বাঁচিয়ে বা সেগুলো টিকে থাকার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেও তা হতে পারে।
রাস্তার যে কোনাকাঞ্চি, আইল্যান্ড বা সড়কদ্বীপ থাকে, সেগুলোকে ভাবতে হবে একটি ক্ষুদ্র সবুজ অঞ্চল হিসেবে। সেখানে ঝোপঝাড়, উক্ত এলাকার পরিবেশের বিবেচনায় বৃক্ষ নির্বাচন করে রোপণ করা যায় তবে কিছু পাখি, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গসহ অন্যান্য প্রাণী বাঁচতে পারে। শহরের কংক্রিটের মাঝে কিছু সবুজায়ন জীবনে প্রশান্তি আনবে। দূষণ কমবে। জীববৈচিত্র্যের কিছুটা সংরক্ষণ হবে।
আমাদের নগরের সব জায়গায় অট্টালিকা, যানবাহন, কলকারখানা। পুরো শহর কংক্রিটে ভরা, কোথাও কোনো মাটি নেই। সুতরাং নগর-পরিকল্পনায় সড়ক বিভাজক, পার্ক, লেকের পাড়, নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে পরিবেশ উপযোগী বৃক্ষরোপণের আওতায় আনা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শহর হয়ে উঠতে পারে সবুজ এবং প্রাণী ও মানুষের বসবাসের উপযোগী।

 মনোজ দেব
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top