সাক্ষাৎকার I বছরে অন্তত একটা দিন খাদি পরুন —মাহিন খান
দীর্ঘদিন ধরে ফ্যাশন ডিজাইনার ও উদ্যোক্তা হিসেবে সুপরিচিত তিনি। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশীয় পোশাকের প্রসার ঘটাতে কাজ করে চলেছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সারাহ্ দীনা
ক্যানভাস: স্লো ফ্যাশন এবং সাসটেইনেবল ফ্যাশন সম্পর্কে বলুন। এখন এই ট্রেন্ড ক্রুশিয়াল জায়গায় পৌঁছে যাওয়ার কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মাহিন খান: সাসটেইনেবল ফ্যাশন একটি প্রক্রিয়ায় পণ্য তৈরির এমন সব ধাপ, যেগুলো পৃথিবীর জন্য কোনো প্রকার খারাপ প্রভাব তৈরি করে না, বরং ভালোর প্রভাব বিস্তারে কাজ করে। পণ্য তৈরির জন্য প্রথমেই দরকার হয় তন্তু, এ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার রাসায়নিক ব্যবহার না করে তন্তু উৎপাদন এবং হাতে চালিত যন্ত্র ব্যবহার করে পণ্য প্রস্তুত করা হয়। নকশায় প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী মোটিফ প্রাধান্য পায়। ইয়ার্ন রঙিন হয় প্রাকৃতিক ডাই ব্যবহারে। ফেয়ার ট্রেড, যথাযথ পারিশ্রমিক, এথিকস মানা হয়। অপচয় রোধ করা যায়। পরিবেশে বিরূপ প্রভাব তৈরি হয় এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। সব ধাপে মানবজাতিসহ পরিবেশের সবকিছুর ভালোর জন্য কাজ করা হয়। সাসটেইনেবল প্রক্রিয়ায় তৈরি প্রডাক্ট স্লো ফ্যাশন নামে পরিচিত।
আমাদের দেশে সাসটেইনেবল ফ্যাশন ট্রেন্ড নতুন নয়। ত্রিশ বছর ধরে আমরা কাজ করে যাচ্ছি সাসটেইনেবল প্রক্রিয়ায়। কিন্তু আমরা তখন এই টার্ম ব্যবহার করতাম না। বিশ্ব এখন আগের চেয়ে প্রকৃতি নিয়ে বেশি সচেতন। পরিবেশবাদ সাসটেইনেবল এবং স্লো ফ্যাশনের জনপ্রিয়তায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
ক্যানভাস: আমাদের দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখন বিশ্বের স্লো অ্যান্ড সাসটেইনেবল ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে কতটা সমান্তরাল?
মাহিন খান: আমাদের দেশে সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে কাজ করা বেশ ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য। বিভিন্ন প্রতিকূলতার পরেও বেশ কয়েকজন ডিজাইনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে আগাতে হলে এ প্রক্রিয়ার ডিজাইনার ও উদ্যোক্তাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ম্যাটেরিয়াল সহজলভ্য করতে হবে, শ্রমিক কল্যাণের জন্য আরও কাজ করতে হবে, দেশের বোদ্ধাসমাজ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে যুক্ত হয়ে যুগোপযোগী পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে।
সাসটেইনেবল ফ্যাশন প্রডাক্টকে বিদেশি পণ্যের সঙ্গে তুলনা করে চাকচিক্যহীন বলে অভিযোগ করা হয় অনেক সময়ই। এর সঙ্গে রয়েছে পণ্যমূল্য নিয়ে অভিযোগ। আমাদের সম্ভাব্য ক্রেতাদের আরও বেশি এই ফ্যাশনপ্রক্রিয়া এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানাতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে বোঝাতে হবে নিজ দেশের পণ্য ব্যবহারের গুরুত্ব ও গর্ব। কেননা নিজস্ব ঐতিহ্যের বিকাশ ও পুরুৎপাদনের মধ্য দিয়েই একটি দেশ বিশ্বে নিজের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে পারে।
ক্যানভাস: এফডিসিবির সর্বশেষ এক্সিবিশনে থিম ছিল সাসটেইনেবল ফ্যাশন। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।
মাহিন খান: এবারের এক্সিবিশনে আমরা নিজস্ব শিকড়ে ফিরে গেছি। সাসটেইনেবল ফ্যাশনের মূল তত্ত্ব অনুযায়ী ফ্যাব্রিক-মোটিফ-রঙের ক্ষেত্রে পুরোপুরি দেশজ উপাদান ব্যবহার করেছি। প্যাটার্নে গ্লোবাল ট্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের ঐতিহ্যকে সবার সামনে তুলে এনেছি। আমাদের দেশের শতভাগ সাসটেইনেবল খাদি কাপড় হারিয়ে যেতে বসেছে। অমূল্য এ সম্পদকে ধরে রাখতে নিয়মিত প্রদর্শনীর পাশাপাশি নাগরিক জীবনে এর ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। বছরে অন্তত একটি দিন খাদির পোশাক পরে শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে। এটি আমাদের নিজেদের। নিজস্বতাতেই বিশ্বদরবারে আমাদের পরিচয় ঘটবে। আমি সবাইকে সাসটেইনেবল ফ্যাশন থিমের প্রদর্শনীর কথা মনে করিয়ে দিয়ে আহ্বান জানাব, অন্তত একটি দিন খাদির পোশাক পরুন। এই শিল্প টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
ক্যানভাস: গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে আপনি কীভাবে সাসটেইনেবল ফ্যাশনকে তুলে এনেছেন, সে সম্পর্কে বলুন।
মাহিন খান: সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইভেন্টে অংশ নিয়েছি। এ ধরনের ইভেন্টে জুরিরা পণ্য দেখে সবদিক বিবেচনা করে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। থাইল্যান্ড, প্যারিস, মালয়েশিয়া, নিউইয়র্কে আমাদের দেশের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পেরেছি। ভবিষ্যতে আমি সাসটেইনেবল ফ্যাশন নিয়ে দুবাইতে প্রদর্শনী করতে চাই। বিশ্বকে আমাদের দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আমার ঐকান্তিক ইচ্ছা। নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার এই প্রত্যয় নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি, তা বাস্তবায়িত হলে আমাদের ফ্যাশনও বিশ্বসভা উজ্জ্বল করে তুলবে।
মডেল: মৌসুম
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: মায়াসির বাই মাহিন খান
ছবি: তানভীর