ফিচার I সিরামিক ইয়ার্ন
এতে তৈরি হয় বিশেষ ধরনের ফ্যাব্রিক, যা শরীরে শীতল অনুভূতি দেয়
ইন-অরগানিক ফাইবার মূলত শিল্পকারখানায় বেশি ব্যবহৃত হয়। এগুলোর কাঁচামাল বিভিন্ন রকমের খনিজ পদার্থ। এ ধরনের সুতা বা ফাইবারকে মিনারেল উল অথবা ফাইবার কিংবা ম্যান-মেইড ভিট্রেয়াস ফাইবার (এমএমভিএফ) বলে। এদের থারমাল ইনসুলেশন, ফায়ার প্রটেকশন, অ্যাকুইস্টিক প্রটেকশনের জন্য ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং অনেক টেকসই। মিনারেল উলের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় সিরামিক সুতা।
এটি প্রাকৃতিক বা সিনথেটিক খনিজ কিংবা ধাতব অক্সাইড থেকে তৈরি, বিশেষ করে সিলিকন। সিরামিক সুতা উচ্চ তাপমাত্রা প্রতিরোধের জন্য পরিচিত। এটি ২৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে। এ ছাড়া সিরামিক ফাইবার থেকে তৈরি টেক্সটাইল (ফ্যাব্রিক, ড্রেস) খুবই হালকা ওজনের হয়ে থাকে। কম তাপ পরিবাহিতা এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ সিরামিক ফাইবারের ভেতর দিয়ে সহজে তাপ যাতায়াত করতে পারে না। এর রাসায়নিক স্থায়িত্ব বাইরের বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর উপাদানের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। সাধারণত সিরামিক ফাইবার সুতা উচ্চ তাপমাত্রার সিলিং করতে এবং সিরামিক ফাইবার টেপ, দড়ি বা ফ্যাব্রিক উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
সিরামিক ফাইবার বানানোর প্রক্রিয়াটা খুব সহজ নয়। এখন পর্যন্ত এটি উৎপাদনের ছয়টি পদ্ধতি রয়েছে। সেগুলো হলো সিভিডি টেকনিক, মেল্ট স্পিনিং টেকনিক, স্লারি স্পিনিং, ক্যামিক্যাল কনভারশন, প্রি-সিরামিক পলিমার প্রসেসিং, সিঙ্গেল ক্রিস্টাল ফাইবার প্রডাকশন। সিরামিক ফাইবার বানাতে আগে সিভিডি টেকনিক ব্যবহৃত হতো। তবে এখন মেল্ট স্পিনিং টেকনিক এবং স্লারি স্পিনিং পদ্ধতির প্রয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ, সিভিডি টেকনিকের চেয়ে এ দুটি উৎপাদন প্রক্রিয়া তুলনামূলক বেশি সহজ।
এটি বানাতে প্রথমে সিলিকার মতো রাসায়নিক পদার্থকে উত্তপ্ত করা হয়, গলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। এরপর একে চুলের মতো স্ট্র্যান্ডে কাটা হয়। সিরামিক সুতা বানানোর জন্য, সিরামিক ফাইবার মেশিনের মাধ্যমে কারডিং করা হয়, বিভিন্ন রকমের অরগানিক ফাইবারের সঙ্গে। এভাবে রোভিং করা হয়। এটি হলো ফাইবারের নরম স্ট্র্যান্ড, যা সুতাতে রূপান্তরের আগে টুইস্ট করে এর ভেতরে থাকা সব ধুলা-ময়লা, অপ্রয়োজনীয় উপাদান পরিষ্কার করা হয়। এরপর রোভিংয়ের সঙ্গে গ্লাস ফিলামেন্ট বা স্টিল ওয়্যার মেশানোর নিয়ম। এই কম্বিনেশন সুতা বানানোর আগ পর্যন্ত বিশেষ মেশিনের সাহায্যে স্পানিং বা কাটা হয়। যে অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে টেনসিল স্ট্রেন্থ উল্লেখ থাকে, সেখানে গ্লাস ফিলামেন্ট রিইনফোরসড সিরামিক সুতা দিয়ে তৈরি টেক্সটাইলের ৫৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে স্টিল ওয়্যার বা তার মিশ্রিত সিরামিক সুতার টেক্সটাইলে তাপ পরিবাহক ক্ষমতা ১০৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেখানে টেনসিল স্ট্রেন্থ গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেখানে সিরামিক সুতা বা টেক্সটাইল ১২৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়।
সিরামিক সুতা ও টেক্সটাইল মূলত উচ্চ তাপমাত্রার সিলিং এবং ইনসুলেটিং অ্যাপ্লিকেশনে বিস্তৃত ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ তাপ ও বিদ্যুতের উত্তরণ, স্থানান্তর, লিকেজ রোধ বা হ্রাস করতে, এগুলো এমন উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসে। অনেক বছর ধরে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ফর্মের সিরামিক টেক্সটাইল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অ্যারোস্পেস, অটোমোটিভ, ইলেকট্রিক্যাল, পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে সিরামিক ফাইবারের শিল্ড, কারটেইন, লাইনিং, ইনসুলেশন, ব্ল্যানকেট, সিলস ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সিরামিকের ব্ল্যানকেট বা কম্বল সরাসরি আগুনের শিখায় এক্সপোজ হতে পারে এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োগের ক্ষেত্র বেশ উপযুক্ত। তাই এই ফর্ম ধাতুবিদ্যা এবং পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পগুলোতে বেশি ব্যবহৃত হয়। বড় বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিরামিকের কাপড় ফায়ার ডোর, চুল্লির অস্তরণ, বিশেষ তাপ প্রতিরোধী কনটেইনার, বিশাল হিট পাইপের আস্তরণ দেওয়া হয়।
সিরামিক ফাইবারের দড়ি অ্যাসবেসটস দড়ির খুব ভালো বিকল্প। এটি হিট ইনসুলেশন উপকরণে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া তাপ প্রতিরোধী কাঠামো সংযুক্ত করতে সিরামিকের দড়ি বেশ কাজে লাগে। উচ্চ তাপমাত্রার পাইপ, উত্তপ্ত ইস্পাতের জাংশন, সম্প্রসারিত জয়েন্ট ইত্যাদির বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে।
সিরামিক উলের কাগজ বিভিন্ন নিরোধক হিসেবে আদর্শ। যেখানে উচ্চ তাপমাত্রা ধরে রাখতে হবে বা বের করতে দেওয়া যাবে না, সেখানে গ্যাসকেট হিসেবে এই কাগজ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া এটি ঘর্ষণ হ্রাস করতে প্যাকিং উপকরণ রূপেও কাজে লাগানো যেতে পারে।
একটি অ্যাডিটিভ হিসেবে সিরামিক ফাইবার বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য কাঠামোর জন্য পারফেক্ট। এগুলো ছাদ, নানান ধরনের হিটিং ইক্যুইপমেন্ট চারপাশের দেয়াল এবং তাপ প্রতিরোধী হওয়া দরকার এমন অন্যান্য কাঠামোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ইনসুলেটিং উপাদান হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও সিরামিক সুতা এখন গ্রীষ্মকালীন ফ্যাশনেবল পোশাক বানাতে স্বল্প পরিসরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ, এর রয়েছে বিশেষ শীতল বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের কাপড়ে খুব অল্প সিরামিক থাকে। যেমন ৯৫ শতাংশ রেয়ন এবং ৫ শতাংশ সিরামিক। সিরামিক ফ্যাব্রিকের তৈরি কাপড় পরিধান করলে শরীর শীতল থাকে। এ ধরনের ফ্যাব্রিক পরলে দেহের তাপমাত্রা অন্তত ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এ ছাড়া এটি ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর ইউভিএ এবং ইউভিবি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। সিরামিক ফ্যাব্রিকের নরম শাইনিনেস, অ্যান্টি-স্ট্যাটিক, ওয়াশেবল কোয়ালিটির জন্য ধীরে ধীরে বাচ্চাদের পোশাক তৈরিতে এর ব্যবহার বেড়ে চলেছে। সিরামিকে সুতা খুব দ্রুত নিটিং শিল্পে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ফাহমিদা শিকদার
ছবি: ইন্টারনেট