skip to Main Content

ফিচার I রঙের শুভাশুভ

পৃথিবী বিচিত্র বর্ণে ভরা। প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতিকে। ফলে বিভিন্ন তিথির মধ্যে এগুলোর বাছবিচার চলে আসছে। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ

বর্ণহীন পৃথিবীর কথা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করা সম্ভব কি? এ কথা ভাবতেই কি অন্ধকার লাগছে সব? লাগারই কথা। রং আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূর্য ছাড়া যেমন বিশ্ব চরাচর অচল, তেমনই রং ছাড়া জীবনও অসম্ভব। রঙের ছোঁয়ায় জীবনের জলসা ঘর সতত উজ্জ্বল এবং রঙিন। রং শুধু জীবনে বৈচিত্র্য আনে না, জীবনকে বদলায়। ভাগ্যকে যেমন বশ মানায়, জীবনে অপার দীপ্তিও দান করে।
রঙের সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখা যায় সনাতন ধর্মে। এর ধর্মীয় রং বিবেচনা করা হয় লাল রংকে। প্রায় প্রতিটি মাঙ্গলিক কাজে লাল রঙের ব্যবহার হয়ে থাকে। প্রায় সব দেব-দেবীর মূর্তিতে লাল সিঁদুরের তিলক পরানো হয়। এ ছাড়া লাল তিলক শৌর্য আর বিজয়েরও প্রতীক। লাল তিলক লাগালে ব্যক্তির মধ্যে তেজস্বিতা, পরাক্রম, গৌরব এবং যশের অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই লাল রঙের বিশিষ্ট স্থান রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সনাতন নারীদের জীবনে। সধবা নারীরা মাথায় সিঁদুর বা লাল টিপ পরেন। লাল রং থেকেই নারীর গৌরব, সম্মান, সৌভাগ্য এবং স্নেহ বিকশিত হয়। বিবাহ, জন্ম এবং যেকোনো উৎসবে আনন্দের মনোভাব ব্যক্ত হয় লাল রং দিয়েই। ধনদাত্রী লক্ষ্মীও পরেন লাল বস্ত্র। লাল রং ধনসম্পদ, সম্পত্তি সমৃদ্ধির শুভ প্রকাশ করে। মা লক্ষ্মীকে লাল পদ্মফুলের ওপর বসানো হয়। লাল পদ্ম সমৃদ্ধির প্রতীক।
সনাতন ধর্মে গেরুয়া হলো আধ্যাত্মিক প্রকাশের রং। এটা জ্ঞান, ত্যাগ, তপস্যা এবং বৈরাগ্যের প্রতীকও বটে। হিন্দু যোগী, তপস্বী, সাধু, বৈরাগী সবাই গেরুয়া বস্ত্র পরেন। এই রং শুভ সংকল্পের সূচক।
সবুজ রং সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে ব্যাপ্ত রয়েছে। মুনিঋষিরা নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য উঁচু সবুজ পর্বত শীর্ষে, লম্বা ঘাসের সবুজ মাঠের মধ্যে শান্ত-সুখী পরিবেশকে আপন করে নিয়েছিলেন।
জ্ঞান, বিদ্যা ও বিবেকের প্রতীক হলো হলুদ রং। এই রং সুখ, শান্তি, অধ্যয়ন, জ্ঞান, যোগ্যতা, একাগ্রতা এবং মানসিক বৌদ্ধিক উন্নতিরও প্রতীক। হলুদ বা বাসন্তী রং মস্তিষ্ককে প্রফুল্ল ও উত্তেজিত করে। জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ আনে। ভগবান শ্রী বিষ্ণুর পোশাকের রংও হলুদ। ভগবান শ্রী গণেশের ধুতিও হলুদ রঙের। সকল মঙ্গলকার্যে হলুদ ধুতি পরা গণেশ বিঘ্ননাশকারী বলে গণ্য হন।
নীল রং শক্তি, পৌরুষ এবং বীরত্ব মনোভাবের প্রতীক। শক্তি-পৌরুষের বার্তা আছে নীল রঙে। পুরুষোত্তম ভগবান শ্রী রামকৃষ্ণ এবং লীলা-পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ—উভয়েরই শরীরের বর্ণ ছিল নীল। এই রঙের পোশাকধারী ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়।
সাদা রঙের সৃষ্টি সাতটি বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণে। সূর্যের সাদা রশ্মিকে ভেঙে দিলে তা থেকে সব রকমের রং বেরিয়ে আসে। এতে সব রকমের রঙের কিছুটা ছায়া থাকে। সাদা রং পবিত্রতা, শুদ্ধতা, বিদ্যা এবং শান্তির প্রতীক। জ্ঞান ও বিদ্যার রং সাদা। সাদা রং বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর সব থেকে প্রিয়।
বাস্তুশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরনের রঙের গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন রং ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের প্রতীক এবং তাদের ব্যবহারও আলাদা। রংগুলো পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুসারে পরপর দুটি ভিন্ন ধারার প্রভাব তৈরি করে। একটি শুভ ও পরিপূরক, অন্যটি অশুভ ও বিরোধী। পরিপূরক রং জীবনে আকর্ষণ, সুস্থিতি, সংযম, শৃঙ্খলা, সংহতি ও সদর্থক প্রভাব জাগায়। অন্যদিকে বিরোধী রংগুলো জীবনে বিরূপতা, অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, বিরোধ, উদ্বেগ ও সংঘাত বাড়ায়। রঙের প্রভাব ব্যক্তিজীবনের মতো সমাজ ও জাতীয় জীবনেও পড়ে। ব্যক্তিজীবনে বিশেষ কয়েকটি রং প্রিয় বা অপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রঙের প্রভাব শুধু দেখতে ভালো লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন রঙের একাধিক সুপ্রভাব এবং কুপ্রভাবও রয়েছে। সপ্তাহের কোন দিন কোন রঙের পোশাক পরবেন, জেনে নিন—
শনি গ্রহের প্রতি উৎসর্গীকৃত শনিবার। গ্রহরাজকে খুশি করতে এদিন নীল রঙের পোশাক পরা উচিত, তাহলে শনির কোপ আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
রবিবার অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে চাইলে গোলাপি রঙের পোশাক পরুন। এই দিনটা সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শাস্ত্রমতে সূর্যকে প্রসন্ন রাখতে গোলাপি রং বিশেষ উপযোগী।
সোমবার সাদা রঙের পোশাক পরা শুভ। সোমবারকে চন্দ্রের দিন হিসেবে মনে করা হয় এবং চাঁদের রং সাদা। পবনপুত্র হনুমানের দিন হিসেবে মঙ্গলবারকে ধার্য করা হয়।
রামায়ণ অনুসারে, শ্রী রামের প্রতি তার আনুগত্যের প্রমাণ দিতে নিজের সারা শরীরে কমলা রঙের সিঁদুর মেখেছিলেন হনুমান, তাই মঙ্গলবার কমলা রঙের পোশাক পরলে শ্রী রামের আশীর্বাদ আপনার সঙ্গে থাকবে।
বুধবারকে গণেশের দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই এই দিন সবুজ রঙের পোশাক পরিধান করাই শাস্ত্রমতে শুভ।
যদি চান যে শুভশক্তি আপনাকে ঘিরে থাকুক, তাহলে এই বৃহস্পতিবার হলুদ রঙের পোশাক পরতে কখনোই ভুলবেন না।
শুক্রবার দেবী দুর্গার উদ্দেশ্যে নিবেদিত। অশুভ শক্তির প্রতীক অসুর বধ করেছিলেন দেবী দুর্গা। মনে করা হয় যে এদিন নানা রঙে রঙিন পোশাক পরলে দেবী দুর্গা সন্তুষ্ট হবেন এবং আপনার ওপর তার আশীর্বাদ বর্ষিত হবে।
এ ছাড়া দুর্গাপূজার নয় দিনে নয় রকম বা ভিন্ন ভিন্ন রঙের শাড়ি পরা হয়, তা হয়তো অনেকেই জানেন। তবে এই ভিন্ন ভিন্ন রঙের শাড়ি পরার কারণ অনেকেই হয়তো জানেন। মা দুর্গা নয়টি রূপে আবির্ভূত হন। এই নয়টি রূপের সঙ্গে নয়টি রঙের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়।
হলুদ
দেবী দুর্গার প্রথম অবতার শৈলপুত্রী। দেবী শৈলপুত্রী শক্তির প্রতীক। হলুদ রংটি উজ্জ্বলতা এবং আনন্দের প্রতীক। দেবী শৈলপুত্রী নান্দী অর্থাৎ ষাঁড়ের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। হিমালয়ের কন্যা রূপে জন্ম হয়েছিল বলে তার নাম হয়েছিল শৈলপুত্রী। তাকে করুণাময়ী মমতাময়ী মা রূপে পূজা করা হয়।
সবুজ
দ্বিতীয়া তিথিতে ব্রহ্মচারিণী রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। ব্রহ্মচারিণী দেবীর দ্বিতীয় অবতার। এর সঙ্গে রয়েছে সবুজের সম্পর্ক। রংটি প্রকৃতি, শক্তি এবং উন্নতির প্রতীক।
ধূসর
তৃতীয়া তিথিতে চন্দ্রঘণ্টা রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। এটা দুর্গার তৃতীয় অবতার। দেবী চন্দ্রঘণ্টা বাঘের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। চন্দ্রঘণ্টা বীরত্বের প্রতীক। নিজের ভক্তদের রক্ষায় সর্বদা প্রস্তুত থাকেন চন্দ্রঘণ্টা।
কমলা
চতুর্থী তিথিতে কুষ্মান্ডা রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। কুষ্মান্ডা দেবী দুর্গার চতুর্থ অবতার। রংটি আনন্দ এবং শক্তির প্রতীক। দেবী কুষ্মান্ডা সিংহের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি মাতা কুষ্মান্ডার থেকে, তাই অন্ধকার বিশ্বব্রহ্মান্ডের মধ্যে মাতা কুষ্মান্ডা প্রাণের স্পন্দন এনেছিলেন।
সাদা
দেবী দুর্গার পঞ্চম অবতার। পঞ্চমী তিথিতে স্কন্দমাতা রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। এটা শান্তি ও শুভ্রতার প্রতীক। দেবী স্কন্দমাতা সিংহের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। স্কন্দমাতা হলেন জ্ঞানের দেবী। স্কন্দমাতাকে বিশ্বের প্রথম প্রসূতি স্ত্রী রূপে কল্পনা করা হয়। তিনি ভগবান কার্তিকের মায়ের রূপে পরিচিত।
লাল
ষষ্ঠী তিথিতে কাত্যায়নী রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। কাত্যায়নী দেবীর ষষ্ঠ অবতার। দেবী কাত্যায়নী সিংহের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। মহিষাসুর বিনাশের জন্য মা কাত্যায়নীর আবির্ভাব। তাই বলা হয়, মা কাত্যায়নীর পূজা করলে সব ধরনের ব্যাধির এবং অশুভ শক্তির বিনাশ হয়। মহিষাসুর বধের জন্য ঋষি কাত্যায়নের ঘরে মা কাত্যায়নীর জন্ম, তাই তার অপর নাম মহিষাসুরমর্দিনী।
নীল
সপ্তমী তিথিতে কালরাত্রি রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। কালরাত্রি দেবীর সপ্তম অবতার। অনেকেই তাকে মা কালী নামে আরাধনা করে থাকেন। দেবী কালরাত্রি গাধার ওপর অধিষ্ঠাত্রী। রক্তবীজ বধ করার জন্য দেবী দুর্গার কালরাত্রি রূপে প্রকাশিত হওয়া। কালরাত্রি রূপে মা সব অন্যায়ের বিনাশ করেছিলেন।
গোলাপি
অষ্টমী তিথিতে মহাগৌরী রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। মহাগৌরী দেবীর অষ্টমতম অবতার। রংটি আশার আলো দেখায়। মহাগৌরী ষাঁড় ও সিংহ উভয়ের ওপরই অধিষ্ঠাত্রী। প্রকৃতির দুটি রূপ একটি মা কালরাত্রি, যা অতি ভয়াবহ। এটা প্রলয়ের সঙ্গে তুলনীয়, দ্বিতীয়টি মা মহাগৌরী। এটা শান্ত স্থির অতি পূর্ণ রূপে করুণাময়ী রূপ।
বেগুনি
নবমী তিথিতে সিদ্ধিদাত্রী রূপে মা দুর্গার পূজা করা হয়। সিদ্ধিদাত্রী দেবীর নবমতম অবতার। দেবী সিদ্ধিদাত্রী সিংহের ওপর অধিষ্ঠাত্রী। সিদ্ধি অর্থাৎ মুক্তি প্রাপ্তি। দেবীপুরাণ অনুসারে মহাদেব মা দুর্গার কাছ থেকে সিদ্ধির জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, যার কারণে মহাদেবের অর্ধ শরীর দেবীরূপে প্রকাশিত হয়েছিল। মহাদেবের সেই রূপ অর্ধনারীশ্বর নামে পরিচিত।

মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: স্বপ্নযাত্রা
জুয়েলারি: সিক্স ইয়ার্ড স্টোরি ও তিতলি- দ্য বাটারফ্লাই
ছবি: জিয়া উদ্দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top