ফিচার I প্যাচওয়ার্ক পরিক্রমা
টুকরা সব কাপড়ের জমাটি জোড়। তাতেই তৈরি হচ্ছে শার্ট, স্কার্ট, শাল, এমনকি শাড়ি। প্রক্রিয়া সনাতন, কিন্তু তৈরি করছে সমকালীন ট্রেন্ড। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
প্যাচওয়ার্ক। সহজ ভাষায় জোড়াতালি। ছোট ছোট কাপড়ের টুকরা একসঙ্গে জুড়ে একটি সম্পূর্ণ কাপড় তৈরি করার প্রক্রিয়াই প্যাচওয়ার্ক। মজার ব্যাপার হলো, এটি তৈরির জন্য কাপড়ের বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আলমিরা থেকে রেখে দেওয়া কাপড় বের করে তা দিয়েই তৈরি করে নেওয়া যায় সহজে। পোশাক পুনর্ব্যবহারের মাধ্যম হিসেবে প্যাচওয়ার্ক এখন তাই দারুণ জনপ্রিয়।
ফাস্ট ফ্যাশনে কেনাকাটার তালিকায় পোশাকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কারণ, নানা রকম অপশনের ভিড়ে একই কাপড় বহুদিন ব্যবহারের আগ্রহ হারাচ্ছেন ফ্যাশনসচেতনেরা। ফ্যাশন-বর্জ্য তাই এখন চিন্তার বিষয়। প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব। নতুন করে ব্যবহার করা যায় বাতিলের খাতায় তুলে রাখা পোশাকগুলো। নিয়ন্ত্রণ করা যায় ফ্যাশন-বর্জ্য।
প্যাচওয়ার্কে তৈরি পোশাক ও অনুষঙ্গের বিশেষত্ব নজরকাড়া। কৌশলগত কারণে এই মাধ্যমে পোশাক হয়ে ওঠে রঙিন। যেহেতু বেশ কিছু ফ্যাব্রিক একত্র করে তৈরি করা হয়, তাই বিভিন্ন রং এতে দৃশ্যমান হয়। একটির সঙ্গে অন্য কাপড়ের টুকরা জুড়ে দেওয়া হয় সেলাইয়ের মাধ্যমে। তাই সুতার ব্যবহার চোখে পড়ে। বাহারি কাপড়ের টুকরো আর উপযুক্ত সুতার বন্ধনে সম্পন্ন হয় প্যাচওয়ার্ক। এটি বিভিন্ন ধরনের প্যাটার্নের হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় প্যাচ ব্লক, লগ কেবিন ব্লক, স্টার ব্লক। কাপড় টুকরো করে নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্যাটার্নের ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন চারকোনা, আয়তাকার, ত্রিভুজ, স্ট্রিপ-শেপড, ডায়মন্ড, হেক্সাগন, ক্লামশেলস। প্যাচওয়ার্কের বেশ কিছু টেমপ্লেট রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করেও নকশা করতে দেখা যায়। কাপড়ের টুকরাগুলো জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এখানেও দেখা যায় বৈচিত্র্য। যেমন চেইন সেলাই, স্ট্রিপ, দুটি ট্রায়াঙ্গেল ইউনিট একত্রীকরণ, সমারসেট, রিভার্সড পিস পিয়ার্সিং, সেমিনোল ইত্যাদি।
আমাদের দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডে প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ হয়েছে সীমিত। কলেবরে বেড়েছে অল্প। প্যাচওয়ার্ককে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে এমন ব্র্যান্ডের সংখ্যা বেশি নয়। বিশ্বরঙ জন্মলগ্ন থেকেই প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ করছে বলে জানালেন এর স্বত্বাধিকারী বিপ্লব সাহা। তিনি বলেন, ‘একটি কাপড়ের ওপর আরেকটি কাপড় বসিয়ে নকশা তৈরি করার এ পদ্ধতি উপমহাদেশের ফ্যাশন-সচেতনদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়। বিশ্বরঙ মেয়ে ও ছেলেদের পোশাকে প্যাচওয়ার্ক করে থাকে। বেশ কিছু রকমফের রয়েছে এর। কখনো কাপড়ের সঙ্গে কাপড় জুড়ে, কখনো ফুল-পাখির নকশা সেলাই করে বসিয়ে, আবার কখনো ঝালর বানিয়ে কাপড়ে বসিয়ে নিয়ে করা হয় প্যাচওয়ার্ক। কাজটা সূক্ষ্ম, তাই সময়সাপেক্ষ। মনোযোগী, দক্ষ কারিগরদের দিয়ে করানো হয়। এখন অনেকেই মেশিন ও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে সারছেন প্যাচওয়ার্ক। কিন্তু হাতে তৈরি করতে গেলে প্রয়োজন মেধা, শ্রম আর সময়। আমি মনে করি, সৃজনশীলতা আর দক্ষতার সংমিশ্রণে হাতেই তৈরি হতে পারে প্যাচওয়ার্কের দারুণ সব নকশা। আমাদের দেশে এর চাহিদা রয়েছে। এর বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে ক্রমশ।’
ফ্যাশন ডিজাইনার চন্দনা দেওয়ান প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ করছেন বহু বছর ধরে। এবারের কতুর ফ্যাশন উইকে দেখা গেছে চন্দনার প্যাচওয়ার্ক। ফ্যাশন হাউস যাত্রা কাজ করছে এ নিয়ে। খুঁত ব্র্যান্ডটিও কাজ করে যাচ্ছে। স্পয়েল্ড ফর চয়েজ কাজ করেছে প্যাচওয়ার্ক মাধ্যমে তৈরি কাঁথা নিয়ে। গয়নাতে প্যাচওয়ার্কের মুনশিয়ানা দেখিয়েছে সুতলি। অনলাইন ব্র্যান্ড কন্যাসুন্দরীতে ডিজাইনার কাজী নুসরাত নাদিয়া নিজস্ব নকশায় করেছেন এর কাজ। গামছা দিয়ে প্যাচওয়ার্ক শাড়ি তৈরি করেছে ফ্যাশন ব্র্যান্ড পদ্ম। প্যাচওয়ার্কে ব্লাউজ তৈরি করেছে ভারমিলিয়ন, লাজবান্তি।
খুঁত প্যাচওয়ার্কের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে ক্লদিংয়ের বিভিন্ন পণ্য। আর রয়েছে সোফা, রানার, কোস্টার, পর্দা। পোশাক থেকে শুরু করে গৃহস্থালির এসব পণ্যে প্যাচওয়ার্ক নিয়ে আসার মূল কারণ ক্রেতা চাহিদা।
খুঁতের স্বত্বাধিকারী ফারহানা হামিদ জানান, ঢাকা শহরের জীবনের রং নাগরিকদের দেশি কাপড়ে নিয়ে আসার জন্য প্যাচওয়ার্কের কাজ শুরু করেছিল খুঁত। মূলত শহুরে জীবনে অভ্যস্ত মানুষের পোশাকে নিয়ে আসার জন্যই এই আয়োজন। আর প্যাচওয়ার্কের পোশাকের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন।
কাজী নুজ্জাত নাদিয়া, কাজী ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী। শাড়িতে প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ‘শাড়িকে উজ্জ্বল করে তুলতে আমরা প্যাচওয়ার্ক নিয়ে কাজ করে থাকি,’ বলেন নাদিয়া।
প্যাচওয়ার্ক একটি সৃজনশীল কাজ। নিজে থেকেও প্র্যাকটিসের মাধ্যমে এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। পছন্দের কাপড় দিয়ে তৈরি করে নেওয়া যায় মনমতো প্যাচওয়ার্ক। প্রথমে বেছে নিতে হবে কোন কোন কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করা হবে। পুরোনো কাপড় ব্যবহার একদমই আবশ্যক নয়। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন প্যাচওয়ার্ক করা হতো, তখন ব্যবহৃত হয়েছিল পুরোনো কাপড়। সে ক্ষেত্রে খুঁজে নিতে হবে ঠিক কোন কোন পোশাক আর পরা হবে না, সেগুলো। তারপর কেটে নিতে হবে ফ্যাব্রিক। আয়তাকার কিংবা চারকোনা করে কেটে নিলে সুবিধা হবে সেলাই দিতে। একটি প্যাচওয়ার্ক প্রোডাক্ট তৈরি করতে ৫ থেকে ৮টি ভিন্ন ফ্যাব্রিক বেছে নিলে সেটা দেখতে আকর্ষণীয় হবে। অলংকরণ ও ফ্যাব্রিকের ভিন্নতা প্যাচওয়ার্ককে আকর্ষণীয় করে তোলে। সলিড কালার ও প্যাটার্ন—এই দুয়ের সংমিশ্রণ হলে প্যাচওয়ার্ক হবে নান্দনিক। ফ্যাব্রিক বেছে রাখার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটি ফ্যাব্রিক যেন ধুয়ে নেওয়া থাকে। সাধারণত ফ্যাব্রিক ধোয়ার পরে শ্রিংক করে। এতে কাপড়ের আকার পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই ধুয়ে নিয়ে তবেই ব্যবহার করা উচিত। ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে চেষ্টা করতে হবে একই ওজনের কাপড় বেছে নেওয়ার। সুতি, সিল্ক ও লিনেন ধরনের কাপড়ের ব্যবহার প্যাচওয়ার্কে বেশি হয়। টুকরা কাপড়গুলোতে ওজনের পার্থক্য থাকলে প্যাচওয়ার্ক তার সৌন্দর্য হারাতে পারে। তবে কোন কাপড়ের পরে কোন কাপড় বসানো হবে, সেটার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। নিজের চোখের ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিলেই চলবে। এ ক্ষেত্রে রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা। যত ভিন্নতা, নান্দনিকতা ততই বেশি। চেকের পাশে ফুল, ফুলের পাশে এক রং। কোথাও স্ট্রাইপ, কোথাও ডিজিটাল প্রিন্ট—যেভাবে খুশি সাজানো যেতে পারে। ফ্যাব্রিক বাছাই হয়ে গেলে আয়রন করে নেওয়া চাই। তাহলে ফ্যাব্রিকের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঁজ এড়ানো যাবে। প্যাচওয়ার্ক ব্যবহারে পোশাক তৈরি করার ক্ষেত্রে আগে থেকে প্যাটার্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে কাজ সহজ হবে। প্রয়োজন বুঝে ফ্যাব্রিক বাছাই, টুকরো করার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। ফ্যাব্রিক একটির সঙ্গে অপরটি জুড়ে দেওয়ার সময় এমন সুতা ব্যবহার করতে হবে, যেটি সবচেয়ে উজ্জ্বল রংটির সঙ্গে মিশে যাবে। প্যাচওয়ার্ক যেহেতু বিভিন্ন রকম ফ্যাব্রিকের সমন্বয়, তাই উজ্জ্বল রঙের সুতার ব্যবহার একটির সঙ্গে অপরটির অবস্থান আরও নজরকাড়া দেখাবে।
মডেল: শর্মী ও বৃষ্টি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: বিশ্বরঙ
ছবি: জিয়া উদ্দীন