কভারস্টোরি I কৃত্রিমতার কীর্তিতে
চিরচেনা রূপ পাল্টাচ্ছে শ্রমনির্ভর টেক্সটাইল অ্যান্ড আরএমজি ইন্ডাস্ট্রি। মনুষ্যনির্মিত ধীশক্তির প্রভাবে। হাইপার ডিজিটাল যুগে প্রবেশের কল্যাণে। বাদ পড়েনি দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি পোশাকশিল্প খাতও। পসার চলছে প্রতিনিয়ত। একদম প্রাথমিক ধাপ থেকে পোস্টপ্রোডাকশন অব্দি। গতানুগতিক প্রক্রিয়া অনুসরণকারী প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে উৎপাদন আর মুনাফায় বিশ্বমানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রয়াস নিয়ে। বিস্তারিত নাদিমা জাহানের লেখায়
এখন অহরহই ঘরে বা অফিসে ডিজিটাল স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট এলেক্সা বা সিরিকে মুখে মুখে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। চেহারা চেনার ফেসিয়াল রিকগনিশন অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে। সেলফ ড্রাইভিং স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, রাইডশেয়ারিং অ্যাপে ওয়েটিং টাইম নির্ধারণ, হাতের লেখা চিনতে পারা অনলাইন ব্যাংকিং অ্যাপ এবং স্মার্টফোনসমূহ, যাত্রাপথে ট্রাফিক জ্যামের বৃত্তান্ত দেওয়া নেভিগেশন অ্যাপ, স্মার্ট হোম ডিভাইস যেমন স্মার্ট ফ্রিজ বা এসি—আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অসংখ্য ব্যবহারিক প্রয়োগ বর্তমান সময়ে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহৎ পরিসরে, ভারী শিল্প বা যেকোনো ধরনের বড় আকারের উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এখন এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাত টেক্সটাইল ও রেডিমেড পোশাক (আরএমজি) ইন্ডাস্ট্রিতে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সর্বাত্মক ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। সুখের কথা হলো, গত কয়েক বছরে এদিক থেকে দেশে অকল্পনীয় ও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কী
সেই ১৯৫৬ সালে জন ম্যাকার্থি এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন। যেখানে তিনি বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মেশিন তৈরির বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকেই এআই বলেছেন। আবার মানবিক পর্যায়ের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা প্রয়োজন হয় এমন সব কার্য সম্পাদনে সক্ষম কম্পিউটার সিস্টেম গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিশেষজ্ঞরা যুগ যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এসব টাস্ক বা কাজের মধ্যে আছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বস্তু বা ব্যক্তি শনাক্তকরণ, জটিল সমস্যার সরলীকরণ বা সমাধান ইত্যাদি।
রকম-সকম
শুধু মেশিন লার্নিং বা ডিপ লার্নিং নয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মোটাদাগে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন ন্যারো এআইয়ের কাজ হলো যেসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সিস্টেম আছে, তারই উন্নতি সাধন করা। অন্যদিকে জেনারেল এআই বা সত্যিকারের এআই মেশিন সার্বিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিস্তারিত কাজ করে; যা সেসব মেশিনকে নিজে নিজে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী করে তোলার উদ্দেশ্যেই কাজ করে। আবার মেশিন লার্নিং বলতে সাধারণভাবে বোঝায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তি অর্জন বা স্থাপন করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন বা উন্নয়ন। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রকে শেখানোর বা তৈরি করারও চারটি ধরন আছে। সুপারভাইজড লার্নিং হচ্ছে একেবারে হাতে ধরে শেখানো, যাতে বিভিন্ন জটিল টাস্ক যেমন যেকোনো ধরনের ফোরকাস্টিং খুব ভালোভাবে করতে পারে মেশিন। আনসুপারভাইজড লার্নিং আবার তুলনামূলকভাবে বেশ সৃজনশীল প্রক্রিয়া। এখানে সুপারভাইজড লার্নিংয়ের মতো আগে থেকেই কোনো ধারণা বা প্যাটার্ন শিখিয়ে দেওয়া হয় না; বরং প্রাপ্ত তথ্য থেকে বা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যন্ত্র যেকোনো সমাধানের দিকে দিকনির্দেশনা দেয়। বলা হয়, এআইয়ের ধারাটিই সর্বাধিক সম্ভাবনাময়। এ ছাড়া সেমি বা আংশিক সুপারভাইজড এআই বা বহুল আলোচিত এসএসএল ধরনের এআই তথ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার রি ইনফোর্সমেন্ট লার্নিং সিস্টেমকে শেখায় পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে টাস্কের ধরন বা দিক বদলে ফেলা। অন্যদিকে, ডিপ লার্নিং হচ্ছে মেশিন লার্নিংয়েরই বিশেষ রূপ। মানব মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে যথাসম্ভব হুবহু অনুসরণ করাই এর কাজ। শুধু তথ্য-উপাত্ত ও লক্ষ্য—এই দুটির ব্যাপারে জ্ঞানাহরণ করে এ ক্ষেত্রে নিজে নিজে সঠিক বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো হয় যন্ত্র ও সিস্টেমকে।
টেক্সটাইল ও রেডিমেড পোশাকশিল্পে এআই
টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প অনেকটাই শ্রমনির্ভর শিল্প খাত। এ ক্ষেত্রে বহুবিধ প্রডাক্ট ডিজাইন, নানা ধরনের ইনপুট ম্যাটেরিয়াল, বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার পরিবর্তনশীল পরিমাণের প্রোডাকশন ইত্যাদি বিষয় লক্ষণীয়। তাই পুরোপুরি কার্যকরভাবে যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা এ ক্ষেত্রে বেশ দুরূহই বলা চলে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানের ব্যাপারে উচ্চ মানদণ্ড, ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বর্তমান সময়ে এই টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প ক্রমেই অটোমেশনের আওতায় চলে আসছে। প্রযুক্তিগত উন্নতি ও উৎকর্ষ তো বটেই, মডেলিং, ডিজাইন আর সিমুলেশন গবেষণায় উত্তরোত্তর বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার সুফল হিসেবে এখন টেক্সটাইল ও পোশাক খাত অনেকটাই যন্ত্রচালিত। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা এবং পরিস্থিতিভেদে নানা উপায়ে সঠিক প্রক্রিয়া নির্বাচন, মানবশ্রমের ওপর নির্ভরশীলতা ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর ওপর নির্ভর করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে সফলতা লাভের সম্ভাবনা।
টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের একদম প্রাথমিক ধাপ থেকেই এআই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। ফাইবার গ্রেডিং, ইয়ার্ন বা সুতার গুণগত মান নির্ণয়, ফ্যাব্রিকের খুঁত বিশ্লেষণ, ডাই বা রঙের সঠিক মিশ্রণ, ফর্মুলা নির্বাচনসহ পোশাকশিল্পের সব ধরনের প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন ও প্রোডাকশন-পরবর্তী কার্যক্রমে এআই ব্যবহৃত হতে পারে। এআইয়ের একটি শাখা আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কাপড়ের ভৌত গুণাবলি যেমন চাপ বা টান নেওয়ার ক্ষমতা, কাপড়ের ওপরে আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার প্রভাব ইত্যাদি তথ্য পাওয়া যায়; সেই সঙ্গে সুতা ও কাপড়ের গ্রেডিং, খুঁত বিশ্লেষণ এবং তার কারণ ও উৎস অনুসন্ধান, পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ, পর্যবেক্ষণসহ কার্যকরভাবে রিটেইলিংয়ের ধাপগুলো অনুসরণ করা যায়।
টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের বিভিন্ন ধাপে এআই
তন্তু ও সুতা উৎপাদন
তন্তু শনাক্তকরণ ও নিশ্চিতকরণে আগের মতো কেমিক্যাল দিয়ে বা আগুনে পুড়িয়ে অপচয় না বাড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপ ও রামান স্পেকট্রোগ্রাফি ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। এআই ব্যবহার করে তন্তুসমূহকে রং, কতটুকু মিহি তার পরিমাণ, সমসত্ত্বগুণ, বল সইবার শক্তি ইত্যাদি বিষয়ের নিরিখে নির্ভুলভাবে গ্রেডিং করা যায়। তন্তু ও সুতাশিল্পের প্রযুক্তিতে এখন ভার্চ্যুয়াল মডেলিংও ব্যবহৃত হচ্ছে।
কাপড় উৎপাদন
কাপড়ের গুণগত মান এবং ভৌত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ ও নির্ণয়ে এআই অত্যন্ত কার্যকর। কাপড় তৈরির প্রক্রিয়ার নির্ভুল তথ্য দিতে পারে এটি। রং বা ডাইং প্রসেসের বেলায়ও এ কথা সত্য। ফ্যাব্রিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁত চিহ্নিত করা ও নির্ভুলভাবে উৎস অনুসন্ধান করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এসব ডিভাইস।
অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং
বিশাল লক্ষ্যমাত্রার উৎপাদনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, খুঁতের পরিমাণ কমিয়ে আনা, সামগ্রিকভাবে উৎপাদন খরচের অপটিমাইজেশন ইত্যাদি কারণে মূল ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে এআই দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ডিজাইন থেকে শুরু করে সুতার প্লেসমেন্ট, কাপড়ে সুতার পারফরম্যান্স, সেলাইয়ের প্রক্রিয়া, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ—এই ব্যাপারগুলো ম্যানুয়ালি মানবনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় করতে গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া দুষ্কর। বর্তমানে ডিজাইনের সফটওয়্যারগুলো পুরোপুরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর। তবে প্রাথমিকভাবে এ ক্ষেত্রে হিউম্যান ইনপুট দিতেই হয়। কারণ, আপনা থেকে ডিজাইন জেনারেট করার অবকাশ নেই এখানে। আর রোবটিকস তো এখন কাপড় ও তৈরি পোশাক উৎপাদনের ক্ষেত্রে আবশ্যক। কারণ, ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় সমপর্যায়ের গতি, নির্ভুল ফল, কার্যকারিতা পাওয়া সম্ভব নয়।
উৎপাদন পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অনড় লক্ষ্য নিয়েই এগোতে হয় পোশাক খাতের ম্যানেজারদের। বটলনেকিংয়ের মতো উৎপাদনব্যবস্থার ত্রুটি কমিয়ে এনে সবচেয়ে সহজে ও দ্রুততম সময়ে উৎপাদনের পথটি এখন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যন্ত্রই বলে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডিসিশন সাপোর্ট সিস্টেম এখন পোশাকশিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মেশিন লে আউট, ফ্লোর প্ল্যান, লাইনের মেশিনগুলোর পর্যায়ক্রমিক সজ্জা—এর সবই ঠিক করে দিতে পারে এআই নির্ভর সফটওয়্যার।
চূড়ান্ত পর্যায়ে পোশাক পরিদর্শন ও বিপণন
রিজেক্টেড বা বাতিল করা গার্মেন্টের স্তূপ কমাতে এআইয়ের মদদে প্রতিটি পর্যায়ে এখন পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। আর চূড়ান্ত পর্যায়েও মাপ, সেলাই বা ফ্যাব্রিকে ত্রুটি চিহ্নিতকরণ, অ্যাকসেসরিজ স্থাপনের ক্ষেত্রে ভুল নিরূপণ ইত্যাদি বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রই করে থাকে। বিপণনব্যবস্থার বহু গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় যেমন ভোক্তাদের স্টাইল সাজেশন, ফ্যাশন ফোরকাস্টিং, প্রেডিকশন, বাজার অনুসন্ধান ও মার্কেট অ্যানালাইসিস ইত্যাদি সম্পন্ন করতে বর্তমান সময়ে এআইয়ের বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার
দেশে তৈরি পোশাকশিল্প বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের দিক থেকে অনেক দেশ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ইতিমধ্যেই সেলাইয়ের জন্য সিউবট, অত্যাধুনিক ইআরপি সফটওয়্যার, ডিজিটাল বিপণনব্যবস্থার পাশাপাশি থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এরপরেই আসে বৃহৎ গার্মেন্টস উৎপাদক চীনের কথা। স্মার্ট ক্লোদিং প্রযুক্তির বাস্তবায়নে দারুণ সফল দেশটি। ভার্চ্যুয়াল পোশাক ডিজাইন, উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভার্টিক্যাল ও হরাইজন্টাল সিস্টেমের সমন্বয়, ইআরপি, আরএফআইডি প্রযুক্তি, ডিজিটাল মার্কেটিং, ভোক্তাকেন্দ্রিক পোশাক ডিজাইন, অগমেন্টেড রিয়েলিটিনির্ভর প্রডাক্ট ও শপিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যাপক ব্যবহার সুনিশ্চিত করে প্রতিনিয়ত আরও আধুনিক হয়ে উঠছে চীন। পোশাক খাতে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামও এ ব্যাপারে বেশ অগ্রবর্তী। এ ক্ষেত্রে সেলাইয়ে সিউবট, ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে ভার্টিক্যাল ও হরাইজন্টাল সিস্টেমের সমন্বয়, এডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং আর থ্রিডি প্রিন্টিংয়ে এআইয়ের স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি
অটোমেশনের দিক থেকে বাংলাদেশে এক দশক ধরেই টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প খাত অনেক এগিয়ে গেছে। স্পিনিং মিল, নিটিং মেশিন, অ্যাকসেসরি, বোতাম, জিপার, এমবেলিশমেন্ট, সিক্যুইন ওয়ার্কসহ অন্যান্য এমব্রয়ডারির ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে বেশ বড় পরিসরে। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে ভুবনমানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রোবটিকস, এআই নির্ভর ইআরপি সফটওয়্যার, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সফটওয়্যার ইত্যাদি যুক্ত হতে শুরু করে দেশীয় পোশাকশিল্প খাতে। রোবটিক স্পিনার অ্যান্ড রোটার, থ্রিডি কালার প্রিন্টিং সফটওয়্যারসহ ইনভেন্টরি আর রিসোর্স ব্যবস্থাপনার জন্য এআইনির্ভর সিস্টেম এখন বড় বড় সব অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিতেই আছে। এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং বা ইআরপি সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সফটওয়্যারগুলো হিউম্যান রিসোর্স ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, ইনভেন্টরি, সেলস, ফিন্যান্সসহ সব ব্যাপারে ম্যানেজারদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিকটতম নির্ভুল সমাধান দিচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বনামধন্য রেডিমেড পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপ। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির সাপ্লাই চেইনের প্রধান এলাহী মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের আরএমজি খাত এআইয়ের দিক থেকে বিগত বছরগুলোতে যে কতটা এগিয়ে গেছে, তা ভাবাই যায় না। আমরা এখনো মনে করি, পোশাক কারখানা মানেই হচ্ছে কিছু সেলাই মেশিন চলছে এবং ম্যানুয়ালিই সব কাজ হচ্ছে। পোশাকশিল্পের ধরনটাই এমন যে এই লেবার ইনটেনসিভ খাতে মানবশ্রম এবং তার ফলে মানবকর্মীর প্রয়োজন থাকবেই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অটোমেশনের ব্যবস্থা না থাকলে বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী সমসত্ত্ব বা হোমোজেনাস কোয়ালিটি এবং বহাল রাখা বিশাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন রক্ষা করা সম্ভব নয়।’
‘ইআরপি সফটওয়্যারের কথা তো বলাই হয়েছে, এর সঙ্গে অত্যন্ত আধুনিক সব ডিজাইন সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছে বেশির ভাগ বড় আরএমজি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে। এতে ব্যবহৃত অত্যন্ত ব্যয়বহুল অটোক্যাড ও অন্যান্য ডিজাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে এখন দেশে বসেই ডিজাইন জেনারেট করা হচ্ছে। তাই আমাদেরকে এখন আর বিদেশি ফরমাশ অনুযায়ী ডিজাইনে অ্যাপারেল তৈরি করতে হচ্ছে না। ফ্যাব্রিক লেইং, স্প্রেডিং, কাটিংয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অটোমেশন এখন খুবই সাধারণ ব্যাপার বাংলাদেশে। আর এ ক্ষেত্রে এআই ইনফিউজড সিস্টেমই ব্যবহার করা হয়। একই কথা ডাইং ও প্রিন্টিংয়ের বেলায়ও প্রযোজ্য। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কালার সফটওয়্যারই কাঙ্ক্ষিত রঙের রেসিপি জেনারেট করে, প্রিন্টিং ও ডাইং প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, ডেনিমের ওয়াশের নির্ভুল হবার ব্যাপারটিও এখন এই সফটওয়্যারগুলোর দায়িত্ব। এ জন্য রিজেক্টেড বা বাতিল করা প্রডাক্ট, কাটিং বা ডাইং ওয়েস্ট কমে আসে লক্ষণীয় পরিমাণে।’
এলাহী মঞ্জুরুল হক আরও জানান, প্রোডাকশন বা ম্যানুফ্যাকচারিং লাইনের প্রতিটি মেশিন সেন্ট্রাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। সেই সঙ্গে উৎপাদনের গতি, পরিসংখ্যান, ত্রুটি-বিচ্যুতি—সব ব্যাপারে এআইয়ের কল্যাণে রিয়েল টাইম ডেটা পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যবস্থাপনা টিমের খুব সুবিধা হয়। কোথাও কোনো সমস্যা থাকলে দ্রুত চিহ্নিত হয়। লক্ষ্যপূরণ নিশ্চিত হয়। এভাবে ভোক্তা সন্তুষ্টি অর্জনের ফলেই দেশের আরএমজি খাত এগিয়ে যাচ্ছে জোর কদমে। বিপণন, ইনভেন্টরি, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্ট, অডিট—দেশের বড় বড় অ্যাপারেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ক্ষেত্রেই এখন এআইয়ের সদর্প বিচরণ। তিনি আরও জানান, এতে যে বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার হয়, তার ব্যয়ভার ছোট ছোট কোম্পানির পক্ষে কোনোমতেই বহন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে হা-মীম গ্রুপ বর্জ্য শোধনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে থাকে এবং সেখানেও এআই নির্ভর যন্ত্রপাতি ইনস্টল করা হয়েছে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে।
বহুদিন ধরে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো এ দেশেও শিল্প খাতে অটোমেশন বা যান্ত্রিকীকরণের ব্যাপারে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব চলে আসছে জনসাধারণের মাঝে। এর কারণ হচ্ছে, ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় কাজ করে আসা শ্রমিকদের চাকরি হারানোর আশঙ্কা, যা সত্যিকার অর্থে উড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অটোমেশনই শুধু নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকলে আমাদের টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প কখনোই আশানুরূপ অবস্থান অর্জন করতে পারবে না বিশ্বদরবারে। এ জন্য সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে নতুন সেটআপের উপযোগী করে সব শ্রমিককে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পোশাক খাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গৃহীত টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ফান্ড স্কিমের আদলে পলিসি বা নীতিগত অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন একাডেমিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে দেশের টেক্সটাইল ও পোশাক খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন উৎপাদনব্যবস্থার প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নে শুধু পোশাকমালিকদের বা সরকারের নয়, সবারই কার্যকর ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
লেখক: প্রকৌশলী
মডেল: অভিনেত্রী জয়া আহসান
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কিয়ারা
জুয়েলারি: আমিসে
স্টাইলিং: ফয়সাল তুষার
ছবি: জিয়া উদ্দীন
কৃতজ্ঞতা: এসকে ডেকর