বিশেষ ফিচার I ক্রিস্তিয়ঁ দিওরের স্বপ্নভুবনে
জার্মানিতে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান নানা মিউজিয়াম। দেখেন ডিজাইনারদের কাজ। সম্প্রতি ক্রিস্তিয়ঁ দিওরের এক্সিবিশন দেখার অনন্য অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার মির্জা মান্নান
প্যারিসকে বলা হয় ফ্যাশনের জন্মভূমি। যুগ যুগ ধরে শিল্প-সাহিত্য আর সংস্কৃতির তীর্থ হিসেবে পরিচিত এই ফরাসি জনপদ। লাক্সারি ফ্যাশনের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিস্তিয়ঁ দিওর। তাঁর জন্মও এই ফ্রান্সে। ১৯০৫ সালে, গ্রানভিলে। ফ্যাশন ডিজাইনকে দিওর নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। ওত্ কতুর ডিজাইনে এত ব্যাপ্তি আর বৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করতে কোনো ডিজাইনারকে দেখা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তীকালে প্যারিসের ফ্যাশন-মুকুট ধরে রাখার পেছনে ছিল তাঁর অনবদ্য অবদান। এই বরেণ্য ডিজাইনার ১৯৫৭ সালে মারা গেলেও তাঁর ব্র্যান্ড ‘দিওর’ এখনো বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ও জনপ্রিয় লাক্সারি ফ্যাশন হাউজ।
ডিজাইনের স্টুডেন্ট হওয়ায় ক্রিস্তিয়ঁ দিওরের ফ্যাশনের ওপর পড়াশোনা আর আগ্রহ ছিল কলেজ জীবন থেকেই।
স্নাতকোত্তর পড়ার জন্য এখন আমি জার্মানিতে। এখানে আসার পর থেকেই আশায় ছিলাম দিওরের এই এক্সিবিশন অথবা ফ্যাশন শো দেখার। অবশেষে সুযোগ এলো। গত ৩০ বছরে প্যারিসের ইতিহাসে তো বটেই, এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় দিওর এক্সিবিশন। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘ক্রিস্তিয়ঁ দিওর: কতুরিয়র দু রিভে’ (ক্রিস্টিয়ান ডিওর: স্বপ্নের ডিজাইনার)। প্রায় এক বছর (৮ এপ্রিল ২০১৭ থেকে ৭ জানুয়ারি ২০১৮) ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্য মুজি দেস আর্টস দেকোরেতিভে। ইউরোপিয়ান স্টুডেন্ট পাসে বিশ্ববিদ্যালয় টিমের সঙ্গে ঢুকে পড়ি দিওরের কল্পনার রাজ্যে। মোট ৩২ হাজার বর্গফুটের এক্সিবিশন সাজানো ছিল বিভিন্ন থিমে। আজ অব্দি দিওরের সেরা পোশাকগুলো সরাসরি দেখার এক দুর্লভ সুযোগ ঘটেছে এখানে। দিনের পর দিন, অনেক মানুষের পরিশ্রমে তৈরি সূক্ষ্ম কারুকাজের প্রতিটি ড্রেসই দিওরের মাস্টারপিস। পুরো এক্সিবিশনের কিউরেটিং ছিল অনবদ্য। সামঞ্জস্যপূর্ণ আলোকসজ্জা আর অপেরার সুর যেন দিওরের মহিমা প্রকাশ করেছে। প্রিন্সেস গ্রেস, লেডি ডায়ানা ও এলিজাবেথ টেলর থেকে জেনিফার লরেন্স, নাটালি পোর্টম্যান থেকে রিহানা- বিভিন্ন সময়ে সেলিব্রিটিদের পরা পোশাকগুলো ছিল আলাদাভাবে লেবেলিং করা।
দিওর হাউজের ৭০তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে স্থান পায় তিন শতাধিক গাউন। যেগুলো সেই ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি তৈরি করেছে। এর মধ্যে ছিল দিওরের নিজের ডিজাইন করা গাউনগুলোও। পাশাপাশি প্রদর্শিত হয়েছে দিওর পরবর্তীকালে তাঁরই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরা অসামান্য প্রতিভাধর সব ডিজাইনারের সৃষ্টিসৌকর্য। এই তালিকায় রয়েছেন ইভস সাঁ লোর, মার্ক বোহান, জিয়ানফ্রাঙ্কো ফেরি, জন গ্যালিয়ানো মায় হালের র্যাফ সিমসন হয়ে বর্তমানের মারিয়া গ্রাৎসিয়া চিউরি। গাউনগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে নানা আঙ্গিকে মাল্টিলেবেল ইনস্টলেশনের মাধ্যমে।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল পর্দার পেছনের গল্পগুলো সামনে নিয়ে আসা। স্কেচ থেকে শুরু করে, সম্পূর্ণ কালেকশনের দৃশ্যায়ন এর আগে কোনো ফ্যাশন হাউজ প্রকাশ করার সাহস পায়নি। শত শত নকশা আর প্যাটার্নের মসলিন কাপড়ে ট্রায়াল স্যাম্পলগুলো দেখে বারবারই মনে হয়েছে, এ কোনো মানুষের কাজ নয়। আজ থেকে ৫০ বছরের বেশি আগে কেউ একজন ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে এত কিছু করে গেছেন, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। শুধু ফ্যাশনের বিবর্তনই নয়, এই গুণী ডিজাইনারের শৈশব, অপ্রকাশিত চিঠি, দলিল, আত্মপ্রতিষ্ঠার কণ্টকময় পথের নানান নিদর্শনে ঋদ্ধ ছিল এই প্রদর্শনী।
প্রথমে তিনি পড়েন পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে। কিন্তু চেয়েছিলেন আর্কিটেক্ট বা মিউজিক কম্পোজার হতে। এরপর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ৩০ বছর বয়সে ফ্যাশন ড্রয়িং শিখে ফ্যাশন ইলাস্ট্রেটর হয়ে যান। প্রথম কাজ করেন কতুরিয়র রবার্ট পিগে আর লুসিয়েন লেলংয়ের সঙ্গে। এই সময়ে এক হস্তরেখাবিদ তাঁর হাত দেখে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা মিলে যায়। কারণ, ১৯৪৬ সালে প্রথম ফ্যাশন হাউজ খোলেন দিওর। পরের বছরই সাড়া ফেলে দেন ফ্যাশন শো করে। এমনটি নাকি এর আগে আর দেখেনি বিশ্ব। আর মেয়েরা নতুন লুক লুফে নেয়। রাতারাতি ভুবনখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরও দিওর সাম্রাজ্যের সূর্য ডোবেনি বরং জাজ্বল্যমান।
শিল্পের প্রতি অসীম আগ্রহ থেকে গ্যালারি খোলার জন্য বাবার কাছ থেকে অর্থ নেন তরুণ দিওর। ১৯২৮ সালে তিনি গ্যালারিও করেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর বাবা আর্থিক সংকটে পড়ে যাওয়ায় সেটা বন্ধ করে দিতে হয়। ওই সময়েই তিনি তরুণ শিল্পী সালভাদর দালি, আলবার্তো জিয়াকোমেত্তি, মারসেল দুশম্প, ম্যাক্স আর্নেস্টের মতো তরুণ শিল্পীদের সুযোগ করে দেন।
দিওর মনে করতেন, পারফিউম ছাড়া গাউন অসম্পূর্ণ। তাই ১৯৪৭ সালে তিনি বাজারে আনেন পারফিউম- মিস দিওর। এই সুরভি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বোন ক্যাথরিন দিওরকে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পোশাক প্রত্যেক নারীকে রাজকুমারী বানাবে।’ সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তিনি পোশাকের নকশা করতেন।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি অর্জিত সব অর্থ হারিয়ে নিঃস্ব হন। ৩০ বছর বয়সে নতুন চাকরির জন্য নতুন করে কাজ শেখেন। আর ব্যবসা শুরু করেন ৪২ বছর বয়সে। তাই যারা মনে করেন, তিরিশে গোছাতে না পারলে সারা জীবনে আর গুছিয়ে ওঠা সম্ভব নয়, তাদের মিথ্যে প্রমাণ করেছেন দিওর।
এক্সিবিশন হল ঘুরে এই কিংবদন্তির জীবনাখ্যান দেখতে দেখতে ফিরে গেছি গ্রানভিল থেকে মন্তেকাতিনি। সেই ২১ জানুয়ারি ১৯০৫ থেকে ২৪ অক্টোবর ১৯৫৭। বর্ণাঢ্য জীবন। পরতে পরতে পড়া প্রতিভার দ্যুতি।
উন্নত বিশ্বে ইতিহাসকে সুন্দর করে নতুন প্রজন্মের সামনে উপস্থাপন করা হয়। হয়তো কোনো একদিন আমরা আমাদের বয়নশিল্পীদের তৈরি খাদি, মসলিনের মতো ঐতিহ্যকে এভাবে দেখাতে পারবো, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করবে। তাদের সৃষ্টির প্রেরণা হবে।
ছবি: লেখক