ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ইকো প্রিন্টিং
পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া। প্রকৃতিজাত সব উপকরণ ব্যবহারে। ক্র্যাফটিংয়ে আগ্রহীদের জন্য
বাগানের ফুল, লতা, পাতা ছাপ ফেলে যাবে কাপড়ের জমিনে। স্টিমিং, বয়েলিং অথবা পাউন্ডিং প্রক্রিয়ায়। ন্যাচারাল ডাইংয়ের আনকোরা এ পদ্ধতিগুলোর নাম খানিকটা খটমটে শোনালেও কৌশল একদমই সহজ। বাসায় বসে সেরে নেওয়া যায় অনায়াসে। পছন্দের ফুল-পাতার আকার আর রং ফুটিয়ে তোলা যায় পোশাকে এমনকি প্রতিদিনকার ব্যবহারের বিছানার চাদর, পর্দা কিংবা কুশন কাভারে। মূলত ইকো প্রিন্টিংয়ের ফলে ফুল-লতা-পাতায় পোরা প্রাকৃতিক রংগুলো নিষ্কাশিত হয়ে হুবহু ফুটে ওঠে কাপড়ে।
পাউন্ডিং বা হ্যাপাজম
হ্যাপাজম শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘লিফ ডাই’। এটি প্রাচীন জাপানিজ প্রিন্টমেকিং টেকনিক। কাপড়ের ওপর ফুল-লতা-পাতার ন্যাচারাল পিগমেন্টের ছাপ তৈরি করাই এ প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য। টেক্সটাইল আর্টিস্ট ইন্ডিয়া ফ্লিন্ট এই কৌশলের আবিষ্কারক এবং নামকারক। কাপড়ের ওপর পছন্দসই ফুল-পাতা-লতা সাজিয়ে নিয়ে পাউন্ডিং অর্থাৎ আস্তে আস্তে বাড়ি দিয়ে সেগুলোতে থাকা প্রাকৃতিক পিগমেন্টের ছাপ ফুটিয়ে তোলা হয় এই প্রক্রিয়ায়। তবে সে জন্য আগে থেকে প্রস্তুতির প্রয়োজন। প্রথমে বেছে নিতে হবে কাপড়। ট্র্যাডিশনাল ন্যাচারাল ডাইংয়ের জন্য সাধারণত প্রোটিন ফাইবারে তৈরি ফ্যাব্রিক বেছে নেওয়া হয়। কারণ, সেলুলোজ ফাইবারে তৈরি ফ্যাব্রিকের বদলে এ ধরনের কাপড় রং দ্রুত শুষে নিতে পারে। দেয় তুলনামূলকভাবে গাঢ় প্রিন্ট। এ ক্ষেত্রে সিল্কের কাপড়ে পাউন্ডিং সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে ফুটে ওঠে। তবে সুতি, লিনেন আর হেম্পেও হবে হ্যাপাজম। কিন্তু প্রিন্টিংয়ের ছাপে তারতম্য হতে পারে। আর কাপড় অবশ্যই হালকা রঙা হওয়া প্রয়োজন। তাতে রং ফুটবে ভালো।
পাউন্ডিংয়ের জন্য প্রয়োজন পড়বে টুলের। হাতুড়ি, রাবার ম্যালেট, বড় পাথর কিংবা সার্ভিং স্পুন— চলবে সবই। যেটা দিয়ে কাজ করতে সুবিধা হবে, সেটা বেছে নিলেই চলবে। আরও কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র লাগবে। যেমন হাতের কাছে থাকা চাই একটা ওয়াক্স বা পার্চমেন্ট পেপার। ইমপ্রিন্টের প্রক্রিয়ার সময় পিগমেন্ট যেন এদিক-সেদিক ছড়িয়ে না যায়, সে জন্য। মাস্কিং টেপও লাগবে। এটা কাপড়কে একটা জায়গায় স্থির রাখতে সাহায্য করবে। টুইজারও প্রয়োজন পড়তে পারে। পাউন্ডিংয়ের পর পলকা ফুলের পাপড়ি বা পাতা কাপড় থেকে তোলার জন্য। যা দিয়ে প্রিন্ট করা হবে— অর্থাৎ আসল উপকরণ ফুল-লতা-পাতা বাছাইও এ ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হলুদ, লাল, বেগুনি, গোলাপি আর নীলের মতো গাঢ় রঙেরগুলো বেছে নেওয়াই ভালো। এগুলো বেশি প্রাকৃতিক পিগমেন্টযুক্ত হওয়ায় প্রিন্টিংয়ের পর কাপড়ে রংটাও দেখায় দারুণ উজ্জ্বল। এ ক্ষেত্রে জবা, অপরাজিতা, গোলাপ, গাঁদা, কসমস, জিরানিয়াম, পিটুনিয়া, পপি, ডালিয়া, ক্যালেন্ডুলা, ভায়োলার মতো ফুলগুলো ইকো প্রিন্টিংয়ে বেশি জুতসই। আর পাতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এর আকারগুলো আনকোরা হলে ভালো। এতে প্রিন্টে সুন্দর দেখাবে। যেমন বিভিন্ন ধরনের ফার্ন, তুলসী, পুদিনা, ধনে, টমেটো, গোলাপগাছের পাতা এ ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া যেতে পারে।
প্রক্রিয়ার শুরুতে একটা ওয়াক্স পেপার বিছিয়ে নিতে হবে। এর ওপর বিছাতে হবে প্রিন্টিংয়ের কাপড়। এর ওপর পছন্দসই ফুল-পাতা বিছিয়ে নিতে হবে, পছন্দের নকশা অনুযায়ী। তার ওপর আবার আরেকটি ওয়াক্স পেপার দিয়ে ঢেকে মাস্কিং টেপ দিয়ে সব কটি লেয়ার আটকে দিতে হবে। শুরু করতে হবে পাউন্ডিং। পছন্দসই টুল নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি দিতে হবে কাপড়ের ওপর। তবে বেশি জোরে বাড়ি না দেওয়াই ভালো। এতে পিগমেন্ট ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভালোভাবে পাউন্ডিং শেষে ওয়াক্স পেপার সরিয়ে কাপড় শুকানোর জন্য রেখে দিতে হবে। শুকিয়ে যাওয়ার পর ব্যবহারের উপযোগী হবে। তবে শুকানোর পর ইস্ত্রি করে নিলে এর স্থায়িত্ব বাড়বে। অন্যদিকে, বেশি ধোয়াধুয়ি না করাই ভালো পাউন্ডিং প্রিন্টেড কাপড়।
বান্ডলিং
ইকো প্রিন্টিংয়ের এ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফ্যাব্রিক প্রথমে হাতে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর মরড্যান্ট করে নিতে হবে। এতে ন্যাচারাল ডাইয়ের রং সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল দেখাবে কাপড়ে। মরড্যান্টিং ডাইয়ের সঙ্গে বন্ড তৈরি করে, ফলে ফ্যাব্রিক শুষে নেয় সুন্দরভাবে। বান্ডেল ডায়িংয়ের অন্তত এক দিন আগে মরড্যান্ড সেরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পটাশিয়াম অ্যালুমিনিয়াম সালফেট অথবা ফেরাস সালফেট পানিতে মিশিয়ে অন্তত এক ঘণ্টা তাতে প্রিন্টিংয়ের কাপড় ডুবিয়ে রাখতে হবে। আর এত ঝামেলা করতে না চাইলে রয়েছে ‘পট অ্যাজ মরড্যান্ট’ অপশন। এতে ফ্যাব্রিক কপার, আয়রন অথবা অ্যালুমিনিয়াম পটে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর কাপড়টা ঘণ্টাখানেক ফুটিয়ে নিতে হবে। সারা রাত সেই পানিতে রেখে দিতে হবে ফ্যাব্রিক।
এটাও সম্ভব না হলে আরেকটি উপায় আছে। পুরোনো তামার পয়সা অথবা জং ধরা ধাতু পানিতে ছেড়ে দিয়ে তাতে ফ্যাব্রিক ডুবিয়ে রাখতে হবে। এ ছাড়া ডাইংয়ের এক ঘণ্টা আগে ভিনিগার পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে ফ্যাব্রিক। এ ক্ষেত্রে চার ভাগ পানিতে এক ভাগ ভিনিগার থাকা চাই। সবচেয়ে ভালো ফল পেতে প্রিন্টিংয়ের জন্য রাখা ফুল-লতা-পাতাও ভিজিয়ে রাখা যায় মরড্যান্ট পানিতে। তবে ডাইংয়ের এক ঘণ্টা আগে এটা করলেই চলবে। কাপড় ভালোভাবে নিংড়ে নিয়ে এর অর্ধেক ফুল, পাতা বিছিয়ে নিতে হবে। তারপর বাকি অর্ধেকটা কাপড় দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিতে হবে। তারপর একটা লাঠিতে কাপড়টা পেঁচিয়ে রোল তৈরি করে নিয়ে সুতা বা রশি দিয়ে ভালো করে বেঁধে দিতে হবে। জিগজ্যাগ প্যাটার্নে। তারপর এই রোল স্টিমের জন্য দিয়ে দিতে হবে। এক থেকে দুই ঘণ্টা ভালো করে স্টিম করে নেওয়ার পর রাতভর রেখে দিতে হবে ফ্যাব্রিকের রোল। পরের দিন সকালে বান্ডেল খুলে নিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে। আয়রন করে নিলে দীর্ঘস্থায়ী হবে প্রিন্টের রং।
i অর্চনা সাহা
ছবি: ইন্টারনেট