ইভেন্ট I মেইড ইন বাংলাদেশ
তৈরি পোশাকশিল্পের জগতে দারুণ সমাদৃত একটি লাইন। বিশ্বজুড়েই রয়েছে যার কদর। দেশীয় এই শিল্পকে বিশ্ববাসীর কাছে ভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়াসে গত ১২ থেকে ১৮ নভেম্বর উদযাপিত হয়েছে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ উইক’। অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা ও আয়োজনে ছিল বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (বিএই)।
সপ্তাহব্যাপী আয়োজনটির প্রথম দিন দুপুর ১২টায় রাজধানীর একটি হোটেলে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ সম্মেলনে এই আয়োজনের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
মেইড ইন বাংলাদেশ উইক উপলক্ষে ঢাকায় সাত দিনব্যাপী এক উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত দেশি-বিদেশি মানুষ এই আয়োজনে অংশ নেন।
ফারুক হাসান বলেন, মেইড ইন বাংলাদেশ উইক আয়োজনের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের পোশাকের ব্র্যান্ডিং বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরা। তিনি আরও বলেন, ‘করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছি আমরা। তখন কারও সঙ্গে করমর্দন পর্যন্ত সম্ভব ছিল না। সে সময়েও আমরা অর্ডার গ্রহণ করেছি, সঠিকভাবে পোশাক উৎপাদিত হয়েছে এবং সেগুলো বায়ারের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক অর্থনীতির চলমান সংকটে আমাদের করার মতো তেমন কিছু নেই। এ সময়ে ব্যবসা ধরে রাখার পাশাপাশি তা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সে কারণে এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশের পোশাকশিল্পের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে চাই।’
ডলার সংকটবিষয়ক প্রশ্নে ফারুক হাসান আরও বলেন, ‘এই আয়োজন ডলার সংকটের ওপর নতুন করে কোনো চাপ সৃষ্টি করবে না; বরং মেইড ইন বাংলাদেশ উপলক্ষে প্রায় ৭০০ বিদেশি অতিথি আমাদের দেশে আসছেন, আবার বেশ কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিও এই আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তাই আশা করা যাচ্ছে, রিজার্ভে বাড়তি কিছু ডলার সংযুক্ত হবে।’
মেইড ইন বাংলাদেশ উইকে মোট ইভেন্ট ছিল ১৭টি। প্রথম দিন, ১২ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের আগে সকাল সাতটায় কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক অ্যাপারেল ফেডারেশনের গলফ টুর্নামেন্ট। ১২টায় বনানীর শেরাটন হোটেলে সংবাদ সম্মেলন এবং সন্ধ্যায় র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে আয়োজিত হয় নৈশভোজের। সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের বোর্ড মেম্বাররা। তারা একটি প্রি-বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেন।
দ্বিতীয় দিন ১৩ নভেম্বর মেইড ইন বাংলাদেশ উইকের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে যুবকদের বিনা জামানতে ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল তৈরি করে দিয়েছে। করোনা মোকাবিলায় পোশাকশিল্পে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সারা দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। এর ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগ ও সোর্সিংয়ের জন্য সর্বাধিক অনুকূল গন্তব্য হয়ে উঠেছে। দেশের বিনিয়োগবান্ধব নীতি, একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে।’
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এপিক গ্রুপের নির্বাহী চেয়ারম্যান রঞ্জন মাহতানি, স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম, পানাম গ্রুপের এমডি অমল পোদ্দার, স্নোটেক্স গ্রুপের এমডি এস এম খালেদ ও ফোর্টিস গ্রুপের এমডি শাহাদাত হোসেনের হাতে বিশেষ সম্মাননা তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দুটি কফি টেবিল বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
মেইড ইন বাংলাদেশ উইকে দুটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। ঢাকা অ্যাপারেল এক্সপো ও বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো। অনুষ্ঠিত হয় দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ৩৭তম বিশ্ব ফ্যাশন সম্মেলন ও ঢাকা অ্যাপারেল সামিট। এ ছাড়া ছিল পরিবেশবান্ধব কারখানা পরিদর্শন, আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ আন্তর্জাতিক অ্যাপারেল ফেডারেশনের বোর্ড সভা ও সম্মেলন। পুরস্কার দেওয়া হয় টেকসই নকশা ও উদ্ভাবন, প্রবাসী বাংলাদেশি ও আলোকচিত্রে বাংলাদেশ—এই তিন ক্যাটাগরিতে। এই আয়োজনে একটি টেকনিক্যাল ওয়ার্কশপও অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজনের শেষ দিনে রাখা হয় বিজিএমইএ সেন্টার ফর ইনোভেশন, এফিশিয়েন্সি অ্যান্ড ও এস এইচের গ্লোবাল লঞ্চিং।
ঢাকা অ্যাপারেল এক্সপো
আইসিসিবির রাজদর্শন হলে ১৪ থেকে ১৬ নভেম্বর ঢাকা অ্যাপারেল এক্সপো আয়োজিত হয়। যেখানে দেশি-বিদেশি ৬৪টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পোশাক, কাপড় ও সরঞ্জাম প্রদর্র্শিত হয়।
বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো
দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপোতে এবার অংশ নেয় বাংলাদেশ, চীন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, স্পেন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, সান মারিনো, হংকংসহ ৮৪টি প্রতিষ্ঠান। আইসিসিবির নবরাত্রি হলে ১৫ নভেম্বর এই এক্সপো শুরু হয়। শেষ হয় ১৬ নভেম্বর।
ঢাকা অ্যাপারেল সামিট
১৫ ও ১৬ নভেম্বর এ সামিটে পোশাকশিল্পের বিভিন্ন দিক ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন বক্তারা। প্রথম দিনের প্রথম বক্তা ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, শিল্পকারখানা জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাস-সংকটে ভুগছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে গ্যাস সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করছে।
বিজিএমইএ সহসভাপতি মিরান আলীর সভাপতিত্বে পোশাকশিল্পের পথনকশা: সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে শীর্ষক অধিবেশনে ইন্ডিটেক্সের টেকসইবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ফ্রান্সিসকো জাভিয়ার লোসাডা মনট্রো টেকসই পোশাকশিল্প গড়তে চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পোশাক তৈরিতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য তন্তুর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। সরবরাহব্যবস্থার প্রতিটি ধাপে ডিজিটালাইজেশন জরুরি; একই সঙ্গে প্রয়োজন স্বচ্ছতাও। টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে পানির অপচয় বন্ধ ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে।’
শেষ দিনের আয়োজনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেনের শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়ে তৈরি একটি বিশেষ ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। পাঁচ বছর আগেও তিনি ছিলেন পোশাককর্মী। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন থেকে পলিটিকস, ফিলোসফি এবং ইকোনমিকসে গ্র্যাজুয়েশন করেন তিনি। বর্তমানে কাজ করছেন নারীদের কাছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের সহজলভ্যতা তৈরিতে। শিক্ষা গ্রহণের পুরো সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও তার প্রতিষ্ঠান তাকে মজুরি দিয়েছে, যা তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। ফলে আর্থিক সংকটের ভয় না থাকায় সাবিনার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ সহজ হয়ে যায়।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, এবারের উইকের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করা। ক্রেতাদের সামনে দেশের বদলে যাওয়া পোশাক খাতের সামর্থ্য তুলে ধরা। দেশে পোশাকশিল্পের যে উদ্ভাবনী পরিবর্তন দেশে এসেছে, তা উপস্থাপনের পাশাপাশি এই শিল্পের ইতিবাচক দিকগুলো আন্তর্জাতিক মহলকে জানানোর উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয় এই মেগা ইভেন্ট।
সারাহ্ দীনা
ছবি: আয়োজকদের সৌজন্যে