skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I লাক্সারি স্লোডাউন

ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে শক্তিশালী সেগমেন্ট। সম্প্রতি পড়েছে দারুণ তোপের মুখে। অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতি, উচ্চমূল্য নাকি অবাক করা ডিজাইনের অভাব—কারণ আসলে কোনটা?

করোনার সময় পেরোনোর পর কী হয়েছিল মনে আছে? লকডাউন শেষ। ক্রেতাদের ‘রিভেঞ্জ স্পেন্ডিং’ শুরু। এত মাসের জমানো বেতন-ভাতা, জমতে থাকা টাকা খরচ হতে শুরু করে এলোমেলো বেহিসেবি শপিং স্প্রিতে। জামা, জুতা, ব্যাগ, ঘর সাজানোর জিনিস থেকে ট্রিপ—সে সময় কিসে খরচ করেনি মানুষ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মূলত জীবনের ওপর পুনরায় নিজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার পন্থা হিসেবে প্রতিফলিত হয় এমন আচরণ। কিন্তু এটা হয়তো অনেকে ভুলে গিয়েছিলেন, কোনো মার্কেট মুখ থুবড়ে পড়ার আগে সব সময় তুঙ্গে থাকে। থাকে রমরমা, চাঙা। গেল বছর বা তার খানিকটা আগে থেকেই ভোক্তাদের মধ্যে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে। মুদ্রাস্ফীতি আর সুদহারের ঊর্ধ্বগতি এ ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে বিবেচিত বিশেষজ্ঞদের কাছে। ভোক্তারা বুঝতে শুরু করে, মহামারি-পরবর্তী উন্মত্ততাকে পুঁজি করে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডগুলোও সচেতনভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। উপলব্ধির ফল—শুধু ২০২৪ সালেই গ্লোবাল লাক্সারি মার্কেট হারিয়েছে ৫০ মিলিয়ন কাস্টমার।
কেরিঙ্গ এবং এলভিএমএই। নিঃসন্দেহে বিশ্বের বৃহত্তম বিলাসবহুল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষ দুই নাম। সম্প্রতি তাদের থেকেও মিলেছে আয়ের হার হ্রাসের রিপোর্ট। ২০২৩ এ ১৪ শতাংশে নেমে যাওয়া মুনাফা গেল ত্রৈমাসিকে অর্গানিকভাবে বেড়ে এসে ঠেকেছে ৩ শতাংশে। এরই মধ্যে এর চামড়াজাত পণ্য এবং ফ্যাশনের আয় ৫ শতাংশ কমেছে। ওয়াইন এবং স্পিরিটের ব্যবসাও নিম্নগামী। কমেছে ৬ শতাংশ। আর কেরিঙ্গের আয় কমেছে ২০ শতাংশ, তা-ও শুধু বছরের প্রথমার্ধে। এখানেই শেষ নয়, ব্রিটিশ লাক্সারি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ফারফেচকে অধিগ্রহণ করে সাউথ কোরিয়ার আমাজন হিসেবে পরিচিত কুপ্যাঙ। কারণ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। সুইজারল্যান্ডের রিচমন্ট তাদের অনলাইন ফ্যাশন রিটেইলার ইওক্স নেট-আ-পোর্টারকে বিকিয়ে দেয় জার্মান বেসড ই-কমার্স কোম্পানি মাই থেরেসর কাছে। সে কারণও একই। তবে এত সব ঝঞ্ঝার মাঝেও প্রাদা, মিউ মিড আর মনক্লেয়ার মতো ব্র্র্যান্ডগুলোর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ডাবল ডিজিট গ্রোথের রিপোর্ট ছিল মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো খবর। কারণ, রিচমন্টের মতো বাঘা প্রতিষ্ঠান যাদের কাছে কার্টিয়ের মতো লাক্সারি ঘড়ি এবং গয়নার ব্র্যান্ডের মালিকানা, তারাই লাক্সারি মার্কেটে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছিল।
বোঝাই যাচ্ছে, ফ্যাশনে বিলাসবহুল বাজার তার প্রসিদ্ধি হারাতে বসেছে। ব্যাংক অব আমেরিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, লাক্সারি সেক্টরের গতি মন্থর হতে শুরু করেছে। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি-সংশ্লিষ্ট অনেকের ধারণা, দুই বছর ধরে যে মন্দা নিয়ে চর্চা চলেছে, সেটার প্রভাবে পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাজার
২০২০ এ শুরু হওয়া করোনাকাল পার হওয়ার পরপর রিভেঞ্জ স্পেন্ডিংয়ের কারণে লাক্সারি সেক্টরের বিক্রি-বাট্টা হুড়হুড়িয়ে বাড়তে শুরু করে। এমনকি অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধির প্রতিবেদনও মিলেছে। ২০২৩ সালে ক্রেতাদের সে ঝোঁক কমতে শুরু করে। প্যানডেমিকের আগে যেমনটা ছিল, সেই স্বাভাবিকতায় ফিরে যায়। এর কারণে বাজার পড়তে শুরু করে। এ ছাড়া জিওপলিটিক্যাল আর মাক্রোইকোনমিকের মতো বৈশ্বিক পরিস্থিতির দরুনও মানুষের আগ্রহের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে বলে ধারণা এলভিএমএইচের ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার জো জ্যাক গিয়োনির। ফলাফল—আয় কমেছে ডাবল ডিজিট পরিমাণ। এই মন্দার জন্য চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থরতাও দায়ী। এক দশক ধরে চীন ছিল লাক্সারি মার্কেটের চালিকাশক্তি। খোদ নিজের দেশে তো বটেই, গণ্ডি পেরিয়েও। ফলে এলভিএমএইচের প্রবৃদ্ধি করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। ভোক্তার ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার কারণেও সরাসরি প্রভাবিত হচ্ছে লাক্সারি মার্কেট। জাপান বাদে পুরো এশিয়ার বিক্রি কমেছে ১৪ শতাংশ অব্দি।
চায়নার এই পতনের পেছনেও রয়েছে বহুমুখী কারণ। রিয়েল এস্টেট সেক্টরে সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিরতা আর সরকারের ‘সাধারণের সমৃদ্ধি’ ড্রাইভ; যার মূল লক্ষ্য সম্পদের বৈষম্য রোধ। চীনে পর্যটক কমে যাওয়ার কারণেও বিশ্বব্যাপী লাক্সারি সেল প্রভাবিত হয়েছে। এর ফলে এলভিএমএইচের স্বত্বাধিকারী বার্নার্ড আরনল্ট (যার কাছে ডিওর, লুই ভিতোঁ, সেলিন আর সেফোরার মতো বাঘা ব্র্র্যান্ডগুলো আছে) হারিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির খেতাব। তার প্রতিষ্ঠানের স্টকের দাম ২০ শতাংশ পড়ে যাওয়ার তিনি এক ঝটকায় ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারান। তবে এখনো ১৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক তিনি।
ভোক্তার পরিবর্তিত মূল্যবোধ
শ্যানেলের মতো ব্র্যান্ডগুলো প্রতিবছর তাদের পণ্যের দাম বাড়ায়। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের বরাতে জানা যায়, ২০০৮ এ শ্যানেল ২.৫৫ ব্যাগটির দাম ছিল ১ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার। ২০২৩ এ যার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ২০০ মার্কিন ডলারে। ডাটা কোম্পানি এডিটেড-এর মতে, ২০১৯ এর পর থেকে এখন অব্দি বিলাসী পণ্যের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এমনকি জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সারদেরও এমন অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরব থাকতে দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে।
অনেকের হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে, কিন্তু রিসার্চ কোম্পানি বার্নস্টেইনের জরিপে উঠে এসেছে অপ্রিয় সত্য। ডিওর আর শ্যানেলের এভারগ্রিন প্রোডাক্টগুলোর দাম ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, শুধু ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে। বারবেরি তার পণ্যের দাম বাড়ানোর পরপরই পতনের মুখ দেখে। একটা নিটেড ডাক হ্যাটের জন্য ৩ হাজার মার্কিন ডলার কারই-বা যৌক্তিক মনে হবে!
বেশির ভাগ লাক্সারি ব্র্র্যান্ডের টার্গেট কাস্টমার মূলত অতি ধনী মানুষজন। কিন্তু এ কৌশলের ফলে বিপুল অংশের ক্রেতা হারায় এই ব্র্যান্ডগুলো; যারা ব্র্যান্ডের ভ্যালু প্রোপোজিশন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তবে প্রাদা আর মিউ মিউ-এর মতো অনেক ব্র্যান্ডই তাদের কালেকশনের দাম নির্ধারণের সময় সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে, এমনকি দাম কমিয়েও দিয়েছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ ক্রেতা আকর্ষণে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার এ সময় যখন মানুষ অহরহ চাকরি হারাচ্ছে, আর্থিক চাপে দিন কাটাচ্ছে; সে সময় এভাবে দাম বাড়ানোর অযৌক্তিক এ চর্চার নামকরণ করা হয়েছে ‘গ্রিডফ্লেশন’। প্রশ্ন উঠছে, লাক্সারি ব্র্র্যান্ডগুলো কি শুধু প্রফিট মার্জিনকে প্রাধান্য দিচ্ছে? তাদের কাছে মান, কারিগরি আর স্বাতন্ত্র্যের মূল্য নেই? মূল্যের সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধির প্রস্তাব না দিয়ে কেবল দাম বাড়ানোর এমন ঝোঁক ব্র্যান্ডের প্রতি ভোক্তার আস্থা নষ্ট করে দিতে পারে নিমেষেই। খোঁজ বাড়ে আরও সাশ্রয়ী বিকল্পের। কাটতি বাড়তে শুরু করে রিসেল আর ভিনটেজ মার্কেটের।
যত দোষ নন্দ ঘোষ
ধীরগতির চীনা অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি আর হোয়াইট-কলার কর্মসংস্থানের মন্দা নিঃসন্দেহে লাক্সারি স্লোডাউনের পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু ব্র্র্যান্ডের অভ্যন্তরীণ কৌশলের ভূমিকাকে এ ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা অদূরদর্শী হবে। আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে ব্র্যান্ডগুলোর অনেক ধরনের ভুল পদক্ষেপ নজরে আসে, যা এক্সটারনাল মার্কেট ফোর্সের প্রভাবকে উসকে দিতে যথেষ্ট।
উদ্ভাবনের ওপর টিকে থাকা লাক্সারি ইন্ডাস্ট্রির সাম্প্রতিক কিছু প্রোডাক্ট লঞ্চ দারুণ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। মৌলিকতার অভাব আর ক্রেতার কল্পনাপ্রসূত পণ্য তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়ার দরুন। যেমন লুই ভিতোঁ নেভারফুল ইনসাইড আউট ব্যাগ লঞ্চ করার মাধ্যমে এমন একটি টেন্ডকে পুঁজি করার চেষ্টা চালিয়েছে, যা সম্পর্কে ভোক্তারা এরই মধ্যে জ্ঞাত। বুদ্ধিমানদের চোখ এড়াতে পারেনি এ কৌশল; বরং ব্র্যান্ডগুলো প্রকৃত উদ্ভাবনে যথেষ্ট বিনিয়োগ করছে, নাকি পুরোনো সূত্র ব্যবহার করে একই পণ্যের পুনঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

 জাহেরা শিরীন
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top