কভারস্টোরি I ঈদ শপিং সাগা
সে অ্যাডভেঞ্চারের থেকে কম কী! ভিড়-ভাট্টা, হই-হুল্লোড়ে পরিপূর্ণ মল। শেষ মুহূর্তের হুড়োহুড়ি আবার তার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত আউটফিটের খোঁজে অ্যাড্রেনালিন রাশ। এ তো স্বাভাবিক ঈদ শপিংয়ের চিত্র। যদিও এবার প্রি-অর্ডারের প্রকোপে ক্রেতাদের অনলাইনের আনাগোনা বেড়েছে অনেক বেশি। আরও নানা কারণে বদলেছে বাজার প্রেক্ষাপট। রাজনৈতিক দোলাচল, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পাল্টে যাওয়া সম্পর্ক, অর্থনৈতিক অবস্থা—কোনটার প্রভাবে? ভোক্তাদের বদলে যাওয়া ক্রয়নীতির সঙ্গে পাল্লায় কত দূর পারছে দেশি-বিদেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। বাজার পর্যালোচনা করে বিস্তারিত বয়ানে শেখ সাইফুর রহমান
ইংরেজ লেখক সোফি কিনসেলার অভিমত, কেনাকাটা যেকোনো সময় থেরাপির চেয়ে শ্রেয়। কারণ, দুটোর জন্য প্রায় সমান মূল্য পরিশোধ করতে হলেও শপিংয়ে অন্তত একটা পোশাক পাওয়া যায়।
তার মতো অভিন্ন সুরে কথা বলেছেন মার্কিন ইভানজেলিস্ট ট্যামি ফায়ে বেকার। তিনি মনে করেন, মনোবিদের সম্মানীর চেয়ে শপিং সস্তা।
অতএব এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, শপিংয়ের একটা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় আছে। অবশ্য করোনার কথা আমরা এত দ্রুত ভুলে যাইনি; বরং সেই স্মৃতি এখনো টাটকা। সেই সময়ে দিনের পর দিন অবরুদ্ধ মানুষ বের হতে পারলে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। ছুটে চলে গেছে শপিং মলে কিছু না কিছু কিনতে। এই দৃশ্য ছিল সারা বিশ্বের। তবে চীনের ঘটনা ছিল অভূতপূর্ব। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর তারা মন খুলে শপিং করেছে। মানসিক চাপ কমাতেই তারা এটা করেছিল। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছিলেন রিভেঞ্জ শপিং।
জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি ছিল একটা বড় চাপ। ফলে এবারের ঈদে মানুষ কিছুটা রাশ টানবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি; বরং ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে করোনা-পরবর্তী রিভেঞ্জ শপিং মনে হলেও দিন যত এগিয়ে, ততই এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে ঈদ শপিংয়ে মানুষের অংশগ্রহণ স্বাভাবিক উৎসব উদ্যাপনের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এর কারণ অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়া, মূল্যস্ফীতি কমে আসা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় থাকা ইত্যাদি; যা কিনা মানুষকে অনেকখানি মানসিক স্বস্তি দিয়েছে। এ জন্য মানুষ যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়েই শপিং করছে; যা সন্দেহাতীতভাবেই আশা জাগানো।
বাংলাদেশের; বিশেষত ঢাকার ঈদ শপিং নিয়ে বিস্তারিত আলাপের আগে কেবল শপিং নিয়ে দুকথা বলে নেওয়া যেতে পারে।
আচ্ছা, মানুষ শপিং কেন করে? কেনাকাটা কি কেবলই প্রয়োজনের তাগিদে করা, নাকি অন্য কোনো বিষয় আছে? শুরুতেই এই উত্তর খোঁজার চেষ্টা।
বস্তুত, শপিং করার পেছনে মানুষের মনস্তত্ত্ব অনেক জটিল এবং বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভরশীল।
আনন্দ পাওয়ার জন্য: শপিং মানুষের মস্তিষ্কে ডোপামিন হরমোন নিঃসরণ ঘটায়, যা সুখ বা আনন্দের অনুভূতি তৈরি করে। নতুন কিছু কেনার সময় মানুষ উত্তেজনা অনুভব করে এবং এটা তাদের আনন্দ দেয়। এ জন্য অনেকে শপিংকে ‘রিটেইল থেরাপি’ বলে থাকে।
স্ট্রেস কমাতে: শপিং করা অনেকের জন্য একটি স্ট্রেস রিলিফ মেকানিজম। মানুষ মানসিক চাপে থাকলে কিছু নতুন কিনলে সাময়িকভাবে তাদের মন ভালো হয়ে যায়। এটা একধরনের কোপিং মেকানিজমও বটে, যেখানে ব্যক্তি তার সমস্যাগুলো ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
দুঃখ বা একাকিত্ব ঘোচাতে: কিছু মানুষ মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত থাকলে বা একা অনুভব করলে তখন শপিং করে। এটা তাদের মানসিক শূন্যতা পূরণে সাহায্য করতে পারে। নতুন কিছু কেনার মাধ্যমে তারা সাময়িকভাবে নিজেদের ভালো অনুভব করে থাকে।
প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য: অনেক সময় মানুষ কোনো সম্পর্কের ভাঙন, চাকরি হারানো বা খারাপ পরিস্থিতির কারণে রিভেঞ্জ শপিং করে। যেমন ধরা যাক, কেউ প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ব্রেকআপের কারণে হতাশ থেকে নিজের জন্য অতিরিক্ত খরচ করে নিজেকে প্রমাণের চেষ্টা করতে পারে। এই সময়ে দামি পোশাক, গাড়ি বা গ্যাজেট কিনে ‘আমি নিজেকে প্রমাণ করব’ মানসিকতাকে প্রতীয়মান করে।
সামাজিক স্ট্যাটাস প্রদর্শনে: কিছু মানুষ শপিং করে নিজেকে জাহির করতে চান যে, তারা সমাজের উঁচুতলার। তারা ব্র্যান্ডেড পোশাক, দামি গয়না বা গাড়ি কেনেন এই কারণে।
আসক্তি থেকে কেনাকাটা: কিছু মানুষ কমপালসিভ বায়িং ডিজঅর্ডারে (সিবিডি) ভোগে। এই রোগে আক্রান্তরা বারবার অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনে এবং এটা একধরনের আসক্তিতে পরিণত হয়। এটা তাদের মানসিক চাপ বা অতিরিক্ত উদ্বেগ থেকে বাঁচার একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের ঈদ শপিং
তাহলে হিসাবের গরমিল হওয়া বাংলাদেশের মানুষের শপিংকে কী বলা যায়। কারণ, বাংলাদেশের যেকোনো কিছুকেই এখন কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা কঠিন।
ঈদের সময় দোকানে গিয়ে শপিং করা শুধু পোশাক কেনার জন্য নয়, বরং এটা একটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাও বটে। অনলাইনে কেনাকাটা বাড়লেও ঈদের মতো বিশেষ উপলক্ষে দোকানে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো এবং নিজের হাতে পছন্দ করে কেনার আনন্দ এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বাংলাদেশে ঈদের সময় মানুষ দোকানে গিয়ে শপিং করতে বেশি পছন্দ করে। তার পেছনে আছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ।
উৎসবের অংশ: বাংলাদেশে ঈদের শপিং শুধু কেনাকাটার বিষয় নয়, বরং এটি উৎসবের একটি বড় অংশ। পরিবার, বন্ধু বা প্রিয়জনদের সঙ্গে মার্কেটে যাওয়া, হাঁটাহাঁটি করা, দরদাম করা—এসব অভিজ্ঞতা মানুষ উপভোগ করে। এটা একধরনের ঈদের রিচুয়াল বা ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে। এখানে একটা কথা উল্লেখ প্রয়োজন, মুসলমানদের উৎসব রং ধরতে ধরতেই যেন মিলিয়ে যায়। যেখানে আবার আচরিক বিষয় এত বেশি থাকে যে উদ্যাপনের যথাযথ অবকাশই মেলে না। তাই এই শপিং বাঙালি বাদ দেয় না।
মার্কেটের জমজমাট পরিবেশের আকর্ষণ: বড় শপিং মল, বিপণিবিতান বা ফুটপাতের দোকানগুলো ঈদের সময় উৎসবের মেজাজে থাকে। আলো-ঝলমলে পরিবেশ, ঈদের গান বাজতে থাকা, মানুষের ভিড়—এই সবকিছু মানুষকে আনন্দ আর শপিং করার উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।
পরখ করে কেনার প্রবণতা: অনেকে কাপড়, জুতা বা গয়নার মতো পণ্য অনলাইনে না কিনে হাতে ধরে, ছুঁয়ে দেখে, ফিটিং চেক করে কিনতে চান; বিশেষ করে ঈদের পোশাক বা শাড়ি কিংবা জুতা কেনার সময় অনেকে চান নিজের চোখে রং, কাপড় ও ডিজাইন মিলিয়ে নিতে।
দরদাম করার সুযোগ: দরদাম করে কেনাকাটা করা বাঙালির সহজাত প্রবণতা। বাংলাদেশে দরদাম করা শপিংয়ের বড় একটা অংশ। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় শোরুমেও কিছুটা দাম কমানোর সুযোগ থাকে। অনলাইনে এই সুবিধা না থাকায় অনেকে দোকানে গিয়ে শপিং করতে স্বচ্ছন্দবোধ করেন।
সপরিবারে আনন্দ উদ্যাপন: ঈদের শপিং অনেক সময় পুরো পরিবারের একটি গেট-টুগেদার হয়ে যায়। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী বা বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে শপিং করতে গিয়ে আনন্দ পান, খাওয়াদাওয়া করেন, গল্প করেন—এটি নিছক কেনাকাটা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। আর ঢাকা শহরে এন্টারটেইনমেন্টের বড়ই অভাব। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায়, শপিং একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
ট্র্যাডিশন ও অভ্যাসগত কারণ: অনেকের জন্য দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করা ছোটবেলা থেকেই ঈদ আনন্দের অংশ। অনলাইনে কেনার সুবিধা থাকলেও অভ্যাসগত কারণে তারা ফিজিক্যাল শপিংকেই বেছে নেন।
অনলাইনে ডেলিভারি ও মানের সমস্যা: বাংলাদেশে অনলাইনে শপিং জনপ্রিয় হলেও এখনো অনেকে ডেলিভারি পেতে দেরি হওয়া, সঠিক পণ্য না পাওয়া, কিংবা সাইজ ও রং না মেলার ভয় পান। বিশেষ করে ঈদের মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে ভুল হলে সময়মতো ঠিক করা কঠিন। তাই মানুষ সরাসরি দোকানে গিয়ে কিনতে পছন্দ করেন।
এবার একটু শেষের কারণটায় আসি। তাহলে কি মানুষ অনলাইন শপিং করছে না? হ্যাঁ, করছে তো বটেই; বরং সংখ্যা বেড়েছে। এবারের ঈদে অফলাইন মার্কেট জমজমাট হলেও অনলাইন শপিংও জনপ্রিয়। পরিসংখ্যান বলছে, এই আগ্রহ আরও বেড়েছে। একটা জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, আগামী চার বছরে অনলাইনে কেনাকাটা করার সংখ্যা হবে ১ কোটি ৩০ লাখ। প্রাথমিকভাবে ৪৪ লাখ ভাবা হলেও ১০ বছর টানা বৃদ্ধি নতুন লক্ষ্য নির্ধারণে বাধ্য করেছে। আর এই বৃদ্ধি বর্তমানের তুলনায় প্রায় ৫২ শতাংশ বেশি। এটা কেবল ফ্যাশন ই-কমার্সের পরিসংখ্যান।
বাংলাদেশে অনলাইন শপিংয়ে সবচেয়ে বেশি তৎপর হলো ২৫-৩৪ বছর বয়সীরা। এরপরেই আছে ১৮-২৪ বছরের। এর কারণ, এদের হাতে খরচ করার মতো টাকা থাকা। আরও একটা মজার তথ্য হলো, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই অনলাইনে বেশি শপিং করে।
অবশ্য এর বাইরেও তরুণেরা অফলাইনে অর্থাৎ শপে গিয়ে কেনাকাটা করছে। এটা একধরনের আনন্দ। যেটাকে কোনোভাবে ব্রাকেটবন্দী করা যাবে না; বরং এটাই বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য।
প্রচারণা রমরমা
সামাজিক মাধ্যমের এই সময়ে প্রচারণা হবে না, তা তো হয় না। ফলে ট্র্যাডিশনাল মিডিয়াকে তোয়াক্কা করার প্রয়োজন নেই; বরং প্রতিটি ব্র্যান্ড ফটোশুটে নিজেদের পণ্য তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সঙ্গে আছে ভিডিও, রিলস ইত্যাদি। তারকাদের এনডোরস করাটাও নতুন কিছু নয়; বরং আরও জোরেশোরে হচ্ছে। ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ায় আওয়াজটা তুলনায় কম বলেই মনে হচ্ছে। কেন যেন আগের সেই জৌলুশ, সেই হাইপ এখন আর নেই। টেলিভিশনগুলোও ম্রিয়মাণ।
তবে ঈদ এলে; মানে, রোজা শুরু হয়ে গেলে হারিয়ে যাওয়া ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার অভাব বোধ করেন অনেকে। ১৯৮৬ সালে সেই সময়ের নিরিখে ওই উদ্যোগ ছিল সমকালীন। পরে সেটা আবেদন হারায়। অথচ এই সময়ে এসে এখনকার মতো প্রতিযোগিতার আয়োজন করাই যায়। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা আর সদিচ্ছার।
তবে প্রতিবারের মতো এবারও শীর্ষ সারির ব্র্যান্ডগুলো ঈদের প্রচারণায় বড় অঙ্কের বাজেট রেখেছে। দেশের খ্যাতিমান মডেলদের পাশাপাশি জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদেরও প্রচারদূত হিসেবে নিয়েছে। ছোট ব্র্যান্ডগুলোও এ ক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। ফলে ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে তারা সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।
এবার শপিংয়ের ধারা
এ বছর ১৫ রোজার মধ্যে একটা বড় অংশেরই শপিং বলতে গেলে শেষ। এর কারণ, এবার রোজা শুরু হয়েছে মাসের প্রথমে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেতন দিয়েছে। আবার মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেও অনেকের বেতন হয়েছে। অন্যদিকে ফ্যাশন হাউসগুলো এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে, কেউবা শবে বরাতের পরপরই ঈদ সংগ্রহ আউটলেটে দিয়েছে। ফলে ক্রেতারা অনেকটা সময় পেয়েছেন দেখেশুনে কেনার।
৭ মার্চ বাংলাদেশের ফ্যাশন আর লাইফস্টাইলের ইতিহাসে একটি রেড লেটার ডে হয়ে থাকবে। কারণ, এদিন আড়ং খুলেছে তাদের সবচেয়ে বড় আউটলেট। ৮ তলাবিশিষ্ট এই আউটলেট কেবল তাদের ফ্ল্যাগশিপ স্টোরই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্র্যাফট স্টোরও। প্রথম দিন থেকে এই স্টোরে উপচে পড়া ভিড়। শুধু এই স্টোর নয়, আড়ংয়ের সব স্টোরেই ভিড়। বরাবরের মতো আড়ং অন্য যেকোনো ব্র্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে। কোনো সন্দেহ নেই, আড়ং থেকে কেনা স্ট্যাটাস সিম্বল। তা ছাড়া আড়ংয়ে সব ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। সাধ্যের মধ্যে পণ্য যেমন থাকে, তেমনি আবার বেশি দামের পণ্যও। বৈচিত্র্য থাকে। ফলে এখনো বেশি মানুষের প্রথম পছন্দ আড়ং। আড়ংয়ের আরেকটা বিষয় হলো প্রস্তুতি। যেটা অন্য যে কারও চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ফলে আড়ংকে আলাদা করে রাখতেই হয়। এ জন্য আড়ংয়ের বিক্রি দিয়ে বাজার বোঝা সম্ভব নয়।
এথনিক ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি মন্দ না হলেও অনেকাংশে আশাব্যঞ্জক নয়। এর কারণও আছে। কারও কারও প্রস্তুতি ভালো না। কারও প্রোডাক্ট আবার একঘেয়ে। ফলে তরুণেরা বা বিশেষত জেন-জিরা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অবশ্য কোনো কোনো হাউস এ বছর জেন-জিদের প্রাধান্য দিয়ে বেশ সুন্দর কিছু পোশাক তৈরি করেছে।
অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন বা ফিউশন ব্র্যান্ডগুলোর অবস্থা বেশ ভালো। স্টোরগুলোতে পা ফেলার অবস্থা নেই। সপ্তাহের সাধারণ দিনগুলোতে তাদের বিক্রি উল্লেখ করার মতোই। আর শুক্র-শনিবারগুলোতে তো কথাই নেই।
এ বছরের লক্ষণীয় বিষয় হলো, ঈদ কালেকশনে জেন-জিদের অগ্রাধিকার; বলতে গেলে সব ব্র্যান্ডই তাদের রুচি আর পছন্দকে মাথায় রেখে সংগ্রহ সাজিয়েছে।
কেনাকাটার প্যাটার্নেও একটা পরিবর্তন এ বছর পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেন-জিরা জবরজং কিছু নিচ্ছে না। তাদের পছন্দ প্লেন অ্যান্ড সিম্পল; বিশেষ করে পাঞ্জাবির ক্ষেত্রে। আমাদের এথনিক ব্র্যান্ডগুলো মিনিমালিজমকে গ্রহণ করতে পারে না। এ জন্য তারা জেন-জিদের টানতে পারছে না। আবার যারা সেটা করেছে, তারা এগিয়ে আছে।
অন্যদিকে একটা বড় অংশই প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শপিং করছেন। যেভাবেই বলি না কেন, আর্থিক সংকটে আছে একটা বড় সংখ্যার মানুষ। আবার ঈদে কেনাকাটা করতেই হয়; তাদের জন্য অবশ্যই এই পরিস্থিতি উভয় সংকটের। ফলে তারা একটু নিয়ন্ত্রিত শপিং করছেন। পকেট বুঝে কিনছেন।
আবার বিপরীত ছবিও দেখা যাচ্ছে। লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোর অবস্থা রমরমা। হট কেকের মতো বিকোচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা রেঞ্জের পাঞ্জাবি। মধ্যবিত্তের ব্র্যান্ডগুলোয় ২-৫ হাজার টাকার পাঞ্জাবি বিক্রির সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বিত্তবানদের একটা অংশ দেশের বাইরে। ফলে লাক্সারি ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রিতে কিছুটা ভাটা।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিক্রিও সমান্তরালে আশাজাগানিয়া। তাদের অনেকের কাজে নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। পণ্যও আকর্ষক। ফলে সেসব পণ্য বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া তাদের নির্দিষ্ট একটা ক্লায়েন্টেল আছে। সেই নির্ভরতাও ফলপ্রসূ হচ্ছে।
বিদেশি পণ্য বাংলাদেশের রূঢ় বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে এবার পণ্যে এগিয়ে পাকিস্তান। ভারতীয় পণ্য এখন ব্যাকফুটে। মানের তুলনামূলক বিচারে ভারতীয় পণ্যের চেয়ে পাকিস্তানি পণ্য শ্রেয়। অন্যদিকে তাদের ডিজাইনার কালেকশনও এখন বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের একটা বড় অংশ পাকিস্তানি পণ্য কিনছে। এখানে বিদেশি পণ্যপ্রীতি একটা আছে। অন্যদিকে আছে কষ্টের টাকায় মানসম্মত পণ্য কেনার আগ্রহ।
আমাদের দেশীয় ব্র্যান্ডগুলোকে এই জায়গায় কাজ করতে হবে। এবারও অনেক বড় ব্র্যান্ডের পণ্যের মানে সন্তুষ্ট হওয়া যায়নি। অনেক দামি পোশাকের ফিনিশিংয়ে মেলেনি সেই নিখুঁত সৌন্দর্য; যা আকর্ষণ করে।
অন্যদিকে দেশীয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানোর দায়িত্ব অবশ্য সরকারের ওপরও বর্তায়। কারণ, এই ইন্ডাস্ট্রির কলেবর নেহাত ছোট নয়; বরং অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে। এমনকি এই ইন্ডাস্ট্রিতে নারী একটা বড় চালিকা শক্তি। ফলে উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট যেমন হচ্ছে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের অনেকগুলো এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে অর্জিত হচ্ছে। ফলে স্বাধীনতার অর্ধশতকের বেশি সময় পার হয়ে এসে এখন এই খাতে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। অন্যদিকে ১৭ কোটির বাজারটাও বেশ বড়। ফলে সঠিক পরিকল্পনা এই খাতকে একটা অবস্থানে নিতে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে ঠেকানো যাবে বিদেশি পণ্যের আগ্রাসন। একথা উল্লেখ হয়তো অত্যুক্তি হবে না, যে ধরনের সহায়তা, প্রণোদনা ও নীতিসহায়তা বছরের পর বছর ধরে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাত পেয়ে আসছে, তার ছিটেফোঁটাও এই দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি পেলে এর অবস্থা অন্য রকম হতো। পাশাপাশি বিদেশি পণ্য আমদানিতে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা না হলে এই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকবে।
বাজার বাস্তবতায় এবার পণ্যের দাম বেড়েছে ১০-১৫ শতাংশ। সেই প্রভাবও অবশ্যম্ভাবী পড়েছে এবারের কেনাকাটায়।
নববর্ষের কেনাকাটা
গেল বছর ঈদ আর পয়লা বৈশাখ ছিল গলাগলি করে। এবার আছে পিঠোপিঠি। দুই সপ্তাহের ব্যবধান। ফলে অনেকে এবার এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছেন। ঈদ শপিংয়ের সঙ্গে সেরে ফেলছেন নববর্ষের কেনাকাটা। অনেক ফ্যাশন হাউসের সংগ্রহ তৈরিতে এই বিষয়টাও মাথায় রাখা হয়েছে। যদিও আশা করা যায়, ঈদের ছুটির আমেজ শেষ হলে বাংলা নতুন বছরের জন্য মানুষ আবার নতুন পোশাক কিনবে। অন্তত অনেক উদ্যোক্তাই এই আশায় বুক বাঁধছে। তবে সেটা কতখানি হবে বলা দুষ্কর। কারণ, সমাজের একটা অংশ ছাড়া সিংহভাগের আর্থিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। ফলে আবার কেনাকাটায় অর্থ ব্যয় তাদের জন্য কঠিনই হবে।
ঈদে কেন মানুষ কেনে
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে উৎসব বলতেই দুই ঈদ। তবে কোরবানির ঈদের চেয়ে ঈদুল ফিতরের ধুমটা বেশি। মধ্যবিত্ত সারা বছর কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে রাখে পোশাক-আশাকের বাইরেও অন্যান্য জিনিস কেনার জন্য। বাসাটা সুন্দর করে সাজিয়ে উৎসবমুখর করে রাখতে চায়। এ জন্য ঈদুল ফিতর সামনে রেখে শপিং বেশি হয়। তাই জীবনের নানা জটিলতা, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আর নানা নেতিবাচকতার ভিড়ে কয়েকটা দিন একটু স্বস্তিতে থাকতে চায়, সবার সঙ্গে মিলেমিশে হাসি-আনন্দে দিনগুলো কাটাতে চায়। কারণ, আবার তো জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
ঢাকা থেকে অসংখ্য মানুষ গ্রামমুখী হয় সপরিবারে ঈদ উদ্যাপনের জন্য। তারাও শপিং করে নিয়ে যায় প্রিয়জনের জন্য। সেটাও একধরনের আনন্দ ও প্রশান্তি।
আনন্দ আর আত্মবিশ্বাসে মাখামাখি
এবার সমে আসা যাক। উৎসবের সময় মানুষ শপিং করে এবং নতুন জামাকাপড় পরে মূলত আনন্দ প্রকাশের জন্য। সংস্কৃতিকে ধরে রাখা আর সামাজিকতা প্রকাশেও। এখানে আরও কিছু বিষয় প্রাধান্য পায়। এই যেমন উৎসব উদ্যাপন করতে চায় সবাই। সেটা সম্ভব হয় নতুন পোশাক পরে, সবার সঙ্গে খুশি ভাগ করে নিয়ে। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আন্তরিকতা আর আবেগ। যেটা কিনা ভালো লাগাকে মাত্রা দেয়। আবার উৎসবের সময় পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হয়। সবাই চায় নিজেকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে। নতুন পোশাক এ জন্যই সবাই পরে। উৎসব তো আনন্দেরই উপলক্ষ। ফলে নতুন পোশাক কেনা ও পরা হয়। নতুন পোশাক মানুষকে কেবল আনন্দিতই করে না, আত্মবিশ্বাসীও করে। নিজেকে বেশ চনমনে আর বিশেষ মনে হয়। অন্যের প্রশংসাও এ ক্ষেত্রে অনুঘটক হয়। আবার নিজের বাচ্চাদের খুশি হওয়া অভিভাবকদের মানসিক প্রশান্তি দেয়।
সর্বোপরি, এই উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটা দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। বিশেষ অবদান রাখে। নানা অফার মানুষকে উৎসাহিত করে শপিং করতে। বস্তুত মানুষ টাকা জমায় খরচ করার জন্য। সেই খরচ সারা বছর যেমন হোক, ঈদের সময় হয় সবচেয়ে বেশি। ওই যে সেই ডোপামিন নিঃসরণ।
ফলে এবার ঈদে গ্রাফটা যত নেতিবাচক ধরে নেওয়া হয়েছিল, সেটা হয়নি; বরং এখন পর্যন্ত তা ঊর্ধ্বমুখী। দিন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই বাড়বে। দুটো করে শুক্র ও শনিবার আরও পাওয়া যাবে। ফলে যাদের লক্ষ্যমাত্রা এখনো পূরণ হয়নি, তাদের সেই অর্জনের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। আর ক্রেতারাও এখন সুযোগ পাচ্ছেন কেনার; বিশেষ করে এ মাসের শেষে হয়তো আরেক দফা বেতন হবে; সঙ্গে বোনাসও। ফলে মার্চের শেষ সপ্তাহে শপিংয়ের গতি আরও বেগবান হবে বলেই বাজার বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ফ্যাশন হাউসগুলোও সেই আশায় বুক বাঁধছে।
এই শপিংয়ের সমান্তরালে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, এই শপিং মানে এর নেপথ্যের লাখ লাখ কুশীলবের মুখে হাসি ফোটা। তাদের সন্তানদের মুখে হাসি ফোটা। তাদের উৎসব আনন্দময় হওয়া।
অন্যদিকে টেকসই পৃথিবীর কথা মাথায় রেখে আমরা অন্তত বিশিষ্ট ফ্যাশন ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউডকে অনুসরণ করতেই পারি—দেখে কিনি, ভালো কিনি।
হ্যাপি শপিং।
লেখক: ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল সাংবাদিক, হেরিটেজ টেক্সটাইল এক্সপার্ট
মডেল: নুসরাত ফারিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সানায়া কুটর বাই সানায়া চৌধুরী
ছবি: কৌশিক ইকবাল