ফিচার I ফ্যাশনেবল আবায়া
মধ্যপ্রাচ্যে এর উদ্ভব। তবে এটি আগের মতো নেই। পোশাকটির আদল নারীর রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে
আগে আবায়া বলতে একধরনের ঢিলেঢালা পোশাক বোঝানো হতো। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ধারণা করা হয়, এটি ধর্মীয় পোশাক হিসেবে গণ্য। তখন সৌদি আরবসহ অন্যান্য মুসলমান-অধ্যুষিত দেশে নারীদের আবায়া না পরে ঘরের বাইরে যেতে দেখা যেত না বললেই চলে। তবে আবায়া এখন আর শুধু ধর্মীয় পোশাকে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি বর্তমানে ফ্যাশনের লক্ষণীয় একটি উপকরণ।
মূলত পর্দা প্রথার কারণেই আবায়ার উদ্ভব। সেকালে এর ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। বর্তমানে এর প্যাটার্নে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শুধু শালীনতা রক্ষাই নয়, ফ্যাশনের অংশ হিসেবেও আবায়া ব্যবহৃত হচ্ছে। তাতে পরিবর্তনও ঘটে চলেছে। আবায়া এখন লং থেকে রূপান্তরিত হয়েছে শর্ট এবং থ্রি-কোয়ার্টারে। আজকাল নারীরা ফ্যাশনেবল আবায়া পরে সমকালীনতা ফুটিয়ে তুলছেন নিজেদের লুকে।
বলা হয়ে থাকে, সত্তরের দশকে আবায়াতে কালো সিল্কের বেশ ভারী এক ধরনের কাপড় ব্যবহার করা হতো। সে সময় সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানগুলোতে এর ব্যবহার নারীদের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে ভূমিকা পালন করতো। এরপর আশির দশকে এর ধরন ও ব্যবহারে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তখন আবায়ার কাঁধের ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন আসে। শুধু তা-ই নয়, আগে আবায়া তৈরির কাজে যে ধরনের কাপড় ব্যবহার করা হতো, তাতেও খানিকটা তফাত পরিলক্ষিত হয়। তখন এতে ব্যবহৃত কাপড় ওজনে তুলনামূলকভাবে হালকা ও টেকসই করা হয়। নব্বই দশকে বিভিন্ন রকম সুতার কাজ এবং চুমকি, ফিতা ইত্যাদির ব্যবহার যোগ করা হয়। এরপরই আবায়ার নতুন অধ্যায়ের শুরু।
মূলত, ২০০০ সাল থেকে এতে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কাঁধে কিংবা কোমরের দুপাশে আলগা কাপড় বসানোর প্রচলন শুরু হয়। একাধিক স্তরে সাজানো বিভিন্ন নকশা ও সুতার কাজের আধিক্য তখন থেকেই সবার দৃষ্টি কাড়ে। ২০১০ সালের দিকে এর শেপ ও ডিজাইনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এ সময় রঙিন ও পাতলা বিভিন্ন ধরনের সুতায় বোনা কাপড়ে আবায়ার উদ্ভব হয়। নতুন ট্রেন্ড হিসেবে নারীদের পছন্দের তালিকায় মাল্টি-লেয়ারড অর্থাৎ একাধিক স্তরবিশিষ্ট আবায়া যুক্ত হয়। দুই স্তরবিশিষ্ট এ পোশাকে সাধারণত ভেতরের স্তরটি অপেক্ষাকৃত ভারী ও গাঢ় রঙের হয়ে থাকে। আর বাইরের স্তরে পাতলা ও হালকা রঙের কাপড়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। একইভাবে, তিন স্তরবিশিষ্ট আবায়ার ভেতরের স্তরটি সবচেয়ে লম্বা ও ভারী হয়ে থাকে। অনেক সময় এতে প্রিন্টেড কাপড় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মাঝের স্তরটির দৈর্ঘ্য ভেতরের স্তর অপেক্ষা কম হয়ে থাকে এবং এতে অপেক্ষাকৃত হালকা রঙের পাতলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। বাইরের স্তরটি দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে ছোট হয়ে থাকে। এতে বেশির ভাগ সময় হালকা কিংবা স্বচ্ছ কাপড় ব্যবহৃত হয়।
কয়েক বছর ধরে, নকশা ও ধরনে আবায়া ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে এর রূপান্তর ও ব্যবহারের বিভিন্নতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানা এবং ক্যারোলিনা হেরেরার মতো লাক্সারি ব্র্যান্ডও আবায়ার নতুন কালেকশন নিয়ে আসছে। আধুনিক নকশার আবায়ায় জমকালো ও হালকা রঙ দুটোই বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। আবায়া এখন লং থেকে রূপান্তরিত হয়েছে শর্ট ও থ্রি-কোয়ার্টারে। ইদানীং, গয়নার মতো বিভিন্ন নকশা করা আবায়া বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত, এগুলোকে বোতাম, ধাতব পাত বা পাথর, মুক্তা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে।
অন্যদিকে, চেইন দেওয়া পকেট ও কোমরে এডজাস্টেবল ফিতার ব্যবহার ফ্যাশনের জগতে নতুন সংযোজন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু চুমকি ও সুতার ব্যবহারের মাধ্যমে আবায়াকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়।
বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের সব শপিং মলেই বাহারি রঙ ও ডিজাইনের আবায়া পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য ৪০০ থেকে ১০,০০০ টাকা। সাধারণত আবায়ায় ব্যবহৃত কাপড়ের মান ও ডিজাইনের ওপর এর দাম নির্ভর করে। আবার অনেকেই পছন্দমতো কাপড় কিনে এই পোশাক বানাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কাটিং মাস্টার ও কারিগরের সহায়তায় যার যার চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা আবায়া সহজেই মেলে। আজকাল অনলাইন অর্ডার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বলা যায়, এ যুগে আবায়ার ব্যবহার শুধু আব্রু রক্ষাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা নতুন ট্রেন্ড ও ফ্যাশনের জগৎকে স্পর্শ করেছে। একই সঙ্গে এটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। তাই অন্যান্য পোশাকের মতো এটিও ফ্যাশন ও ট্রেন্ডকে প্রাধান্য দিয়ে নারীর পোশাকরুচির মতোই হয়ে উঠেছে পরিবর্তনশীল।
স্পোর্টস আবায়া
হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে জিপার দেওয়া জাম্পসুট। কিন্তু এই পোশাক তা নয়; বরং দারুণ গতিবান্ধব এই পোশাককে বলা হচ্ছে স্পোর্টস আবায়া। বর্ণময় এই আবায়া গাউন এখন সৌদি নারীদের ফ্যাশন। জনপ্রিয় হচ্ছে অতিদ্রুত। জেদ্দায় গেল মাসে এই পোশাক পরিহিত নারী অ্যাথলেটদের দৌড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রক্ষণশীল এ দেশের নারীদের পোশাক-স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে বিতর্কও উঠছে। এমনকি আবায়া এখন আর বাধ্যতামূলক নয় সে দেশে। এ নিয়ে কিছুদিন আগেই ফরমান জারি করেছেন রাজপুত্র সালমান। সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছেন ইমান জোহারজির মতো ডিজাইনাররা। গাউনের জনপ্রিয়তা এখন কাজে লাগাচ্ছেন এভাবেই। পোশাকের রকম বদলে দিয়ে। সেখানে স্বাক্ষর রাখছেন সৃজনশীলতার।
এই জিপার দেওয়া স্পোর্টস আবায়া আসলে একধরনের জাম্পসুট। এতে সাপও মরবে অথচ লাঠি ভাঙবে না। কারণ, আব্রু রক্ষা হবে আবার মেয়েদের রাখবে গতিশীল। মানে, এই আবায়া পরে হাঁটা, ব্যায়াম করা সহজ হবে। কিংবা কোথাও যেতে হলে আটপৌরে পোশাক হিসেবে ব্যবহারও করা যাবে। জোহারজি অবশ্য এই প্যাটার্নের আবায়া প্রথম প্রচলন করেন ২০০৭ সালে। তখন তাঁর এই প্রয়াসকে সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। নানা গঞ্জনার মুখে পড়তে হয়েছে। অথচ দশক পেরিয়ে আজ কল্কে পাচ্ছে এই ক্রীড়াবান্ধব আবায়া।
তিনি আবায়ার বহুল ব্যবহৃত কালো রঙকে উপেক্ষা করেছেন। ব্যবহার করেছেন বেজ। অন্যদিকে, জোহারজিই এবার করেছেন ফুটবলপ্রাণিত আবায়া। সেখানে স্থানীয় দলের জার্সির রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। অবগুণ্ঠনমুক্ত সৌদি আরবের নারী ফুটবল সমর্থকেরা এই আবায়া পরে প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে পারবেন স্টেডিয়ামে গিয়ে।
এই খোলা হাওয়ায় জোহারজি প্রাণিত ফ্যাশন ট্রেন্ড দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। সৌদি আরবে মেয়েদের শারীরশিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। তা আবার চালু করা হয় ২০১৪ সালে। ফলে হালের মেয়েরা অবশ্যই চাইবে এমন ট্রেন্ডি অথচ আব্রু রক্ষার পোশাক। এখানেই শেষ নয়, রিয়াদ ইন্টারন্যাশনাল ম্যারাথন এত দিন পর্যন্ত ছিল কেবল পুরুষদের জন্য। আগামী বছর থেকে এই আসরে অনায়াসে অংশ নিতে পারবে নারীরাও।
কিছুদিন আগে শরিয়া অনুযায়ী মেয়েদের পোশাক কেমন হবে, তা নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুবরাজ সালমান যে কথাগুলো বলেন, তাতে আরও উৎসাহিত হয়েছেন সে দেশের নারীরা। একইভাবে সেখানকার বিশিষ্ট মৌলানা শেখ আহমেদ বিন কাশেম আল-ঘামদি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, আবায়ার কালো রঙ ইসলাম-নির্ধারিত নয়।
নম্র-ভদ্র পোশাকের পক্ষেই তারা কথা বলেছেন। কিন্তু আবায়া কোন রঙের হতে হবে বা ডিজাইনের, সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।
সৌরীন রহমান
ছবি: ইন্টারনেট