টেকসহি I রিওয়্যারিং রুল
একটা পোশাক কতবার পরলে আসলে পয়সা উশুল হয়? ব্যাপারটা শুধুই কি ভোক্তার পকেটের ওপর চাপ ফেলে, নাকি এর প্রভাব পড়ে প্রকৃতি আর পৃথিবীতে? উত্তর খুঁজেছেন স্বর্ণা রায়
আজকের হাই-স্পিড ফ্যাশন আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অনেকের ওয়্যারড্রোবই ভর্তি থাকে নতুন নতুন ট্রেন্ডে। প্রতি সপ্তাহে নতুন কালেকশন, ইনফ্লুয়েন্সারদের ‘গেট দ্য লুক’ আর অনলাইন সেলের অফুরন্ত হাতছানিতে অনেকে দিশেহারা। ফলাফল- আলমারি ভরা পোশাক। কিন্তু সকালে তৈরি হওয়ার সময় মনে হয়, পরার মতো কিছুই নেই। এই সমস্যার গভীরে লুকিয়ে আছে স্টাইল, খরচ ও পরিবেশ নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সেটি হলো একটি পোশাক আসলে কতবার পরা উচিত?
প্রশ্নটির কোনো নির্দিষ্ট উত্তর নেই। তবে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষার মতো গুরুতর আলোচনার এই সময়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিও এখন কঠোর নজরদারির আওতায়। তাই একজন স্মার্ট ও সচেতন ব্যক্তি হিসেবে পোশাকের মূল্য কেবল দামের ওপর নির্ভর করে না; বরং কতবার ও কতটা স্টাইলিশভাবে তা পরা যাচ্ছে, তার ওপরও নির্ভরশীল।
দায়িত্বশীল ফ্যাশন
একটা সময় ছিল যখন পোশাককে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হতো। পুরোনো প্রজন্মের কাছে এখনো প্রায় সেই গল্প শোনা যায়। একটি ভালো কাপড়ের স্যুট বা দামি ফ্যাব্রিকের শাড়ি- এমন চিন্তা করে কেনা হতো, যা বছরের পর বছর বিশেষ অনুষ্ঠানে পরা যায়। প্রয়োজনে দর্জির কাছ থেকে অলটার বা মেরামত করে। উদ্দেশ্য, পোশাকের মেয়াদ বাড়ানো। পোশাকের সঙ্গে তখন সম্মান ও যত্নের একটি গভীর সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ফাস্ট ফ্যাশন এসে এই ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। এখন পোশাক মানেই ক্ষণস্থায়ী ট্রেন্ড। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, কিছু দেশে একটি পোশাক গড়ে মাত্র ৭ থেকে ১০ বার পরার পরই ফেলে দেওয়া হয়। এটি কেবল অর্থের অপচয় নয়; পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী, যা সমস্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও সামুদ্রিক শিপিংয়ের সম্মিলিত নিঃসরণের চেয়ে বেশি। তবে আশার কথা হলো, সচেতন প্রজন্ম এই ধারার বিপরীতে হাঁটছে। ‘কম কিনুন, কিন্তু ভালো মানের কিনুন’ এই দায়িত্বশীল দর্শনই এখন রুচিশীল মানুষের নতুন পরিচয় হয়ে উঠছে।
স্মার্ট ফ্যাক্টর
পোশাকের ধরন ও ব্যবহার
সব পোশাক এক নিয়মে ব্যবহৃত হয় না। ব্যায়ামের পোশাক বা মোজা হয়তো একবার পরার পরেই ধুতে হয়; কিন্তু একটি ভালো মানের ব্লেজার, ডেনিম জ্যাকেট বা ওভারকোট না ধুয়েও অনেকবার পরা সম্ভব। যেমন ভালো মানের র-ডেনিম জিনস যত কম ধোয়া হয়, ততই এর রং ও ফিটিং ভালো থাকে। সাধারণত একটি জিনস ৫ থেকে ৭ বার পরার আগে ধোয়ার প্রয়োজন পড়ে না; যদি না সেটি খুব বেশি ময়লা হয়।
কাপড়ের গুণগত মান
পোশাকের আয়ু অনেকটা নির্ভর করে এর কাপড়ের গুণগত মানের ওপর। প্রিমিয়াম কটন, লিনেন বা উলের মতো প্রাকৃতিক ফ্যাব্রিক অনেক বেশি টেকসই ও আরামদায়ক। এসব কাপড়ে সহজে দুর্গন্ধ হয় না। অন্যদিকে, সস্তা পলিয়েস্টারের মতো সিনথেটিক কাপড়ে ঘাম জমে এবং তা দ্রুতই পুরোনো হয়ে যায়। একটি ভালো ব্র্যান্ডের শার্ট ৩০-৫০ বার পর্যন্ত পরা সম্ভব, যেখানে একটি ফাস্ট ফ্যাশন ব্র্যান্ডের টি-শার্ট ১০-১২ বার পরার পরই তা আকার ও রং হারাতে শুরু করতে পারে।
যত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ
পোশাকের যত্ন নেওয়া মানে এর আয়ু বাড়ানো। দামি পারফিউম সরাসরি কাপড়ে স্প্রে না করে ত্বকে ব্যবহার করা শ্রেয়। যেকোনো দাগ লাগলে পুরো পোশাক না ধুয়ে শুধু ওই জায়গা পরিষ্কার বা স্পট-ক্লিন করা যেতে পারে। স্যুটের মতো ফরমাল পোশাক হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা এবং মাঝে মাঝে বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া দরকার। এই ছোট ছোট অভ্যাস প্রিয় পোশাকগুলোকে দীর্ঘদিন নতুনের মতো রাখতে সাহায্য করে।
ব্যক্তিগত স্টাইল ও জীবনধারা
জীবনধারার ওপরও পোশাকের ব্যবহার নির্ভর করে। করপোরেট পেশাজীবীদের ফরমাল শার্ট, ট্রাউজার্স, কামিজ বা অন্য যেকোনো পোশাক ঘন ঘন পরতে হয়। আবার বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য কেনা শেরওয়ানি বা লেহেঙ্গা হয়তো বছরে দু-একবারই পরা হয়। তবে মূলকথা হলো, ওয়্যারড্রোবে এমন কিছু ক্ল্যাসিক পোশাক রাখা, যা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও বিভিন্নভাবে স্টাইল করে পরা যায়।
মনে রাখা প্রয়োজন
টেকসই ফ্যাশনের জগতে ‘৩০ ওয়্যারস রুল’ বা ৩০ বার পরিধানের নিয়ম একটি জনপ্রিয় ধারণা। এর প্রবক্তা লিভিয়া ফার্থ বলেন, কোনো নতুন পোশাক কেনার আগে নিজেকে একটি সহজ প্রশ্ন করা উচিত, ‘আমি কি এই পোশাক অন্তত ৩০ বার পরব?’ যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবেই কেনা উচিত। এই ধারণা হুট করে কেনাকাটা করার প্রবণতা থেকে বাঁচায় এবং একজন মানুষকে চিন্তাশীল ক্রেতা হিসেবে তৈরিতে সাহায্য করে।
একটি টি-শার্ট বানাতে প্রায় ২ হাজার ৭০০ লিটার পানি খরচ হয়। যদি সেই টি-শার্ট ৩০ বারের বেশি পরা হয়, তবেই এর পরিবেশগত ও আর্থিক মূল্য সার্থক হয়। এই প্রশ্ন মানুষকে এমন পোশাক কিনতে উৎসাহিত করে, যা টেকসই, ক্ল্যাসিক এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিগত স্টাইলের সঙ্গে মানানসই।
বারবার পরায় পরিতৃপ্তি
একটা সময় ছিল, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার শুরুর যুগে, যেখানে একই পোশাকে বারবার ছবি পোস্ট করাকে ফ্যাশন-সচেতনতার অভাব মনে করা হতো। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন বিশ্বের নামীদামি তারকারাও একই আউটফিট রিপিট করছেন এবং এটিকে পরিবেশ-সচেতনতার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছেন। বলিউড তারকা আলিয়া ভাট বা কৃতি শ্যানন প্রায়ই তাদের পোশাক পুনরাবৃত্তি করার কথা বলেন, যা টেকসই ফ্যাশনকে উৎসাহিত করে। শুধু তা-ই নয়, মেটা প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গের মতো সফল ব্যক্তিরা একই ধরনের পোশাক বারবার পরার জন্য পরিচিত। এটি তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার জন্য মানসিক শক্তি সঞ্চয় করতে এবং পোশাক নির্বাচনের জটিলতা এড়াতে সাহায্য করে। তাই একই পোশাক নতুন নতুন উপায়ে স্টাইল করে পরা এখন আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতার পরিচায়ক। এটি প্রমাণ করে, মানুষ ট্রেন্ডের দাস নয়; বরং নিজের ব্যক্তিগত স্টাইলে বিশ্বাসী। প্রিয় শার্টটি একবার জিনসের সঙ্গে, আবার চিনোসের সঙ্গে, কিংবা ব্লেজারের নিচে লেয়ার করার মধ্যেও একধরনের সৃজনশীলতা লুকিয়ে আছে। আর এই সৃজনশীলতার মাধ্যমে একই পোশাক ব্যবহার করে পাওয়া সম্ভব সম্পূর্ণ নতুন একটি লুক।
তাহলে একটি পোশাক কতবার পরা উচিত? এর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। মূল উদ্দেশ্য হলো পোশাকের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। সবচেয়ে টেকসই ও স্টাইলিশ পোশাক সেটিই, যা আলমারিতে ইতিমধ্যে আছে। তাই পরেরবার আলমারি গোছানোর সময় কোনো পুরোনো পোশাকে হাত দিয়ে ভাবা যেতে পারে, এটা কি আরও কয়েকবার পরা যায়? নতুন কোনো উপায়ে স্টাইল করা সম্ভব কি না?
সচেতন ব্যবহার আর সামান্য যত্ন সাধারণ একটি পোশাককেও অসাধারণ করে তুলতে পারে। একই সঙ্গে দায়িত্বশীল ও ফ্যাশনেবল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত করে তুলতে পারে যে কাউকে। কারণ, স্টাইল শুধু নতুন পোশাকে নয়; বরং স্মার্ট মানসিকতায়ও প্রকাশ পায়।
মডেল: তৌহিদা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ব্লুচিজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল
