skip to Main Content

মনোজাল I আবরণের আড়ালে

বিয়ের দিন কনের অবয়বে ঘোমটার সংযোগ তৈরি করে এক মায়াময় রহস্য। তাতে ঠিকরে বেরোয় সৌন্দর্যের অন্যতর দ্যুতি। যেন তৈরি হয় পৌরাণিক আবহ

ঘোমটা ছাড়া বিয়ের কনে কল্পনা করা যায়? পৃথিবীর প্রায় সব দেশীয় সভ্যতায় বিয়েতে কনে ঘোমটা পরেন। ধাঁচ হয়তো আলাদা। কনে-সাজে সবচেয়ে মায়াবী অংশই যেন এই ওড়না বা ঘোমটা; যা লাজ, সৌন্দর্য আর আনন্দের এক রঙিন মেলবন্ধন। কারণ, যতই গয়না ঝলমল করুক, লাল-সোনালি শাড়ি ঝলসে উঠুক, কনে-সাজে ঘোমটা না থাকলে সেটি যেন পূর্ণতা পায় না। এটি কনের সৌন্দর্যে এক দারুণ রহস্যময়তা যোগ করে। অনেকটা আবরণের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রূপের প্রধান আকর্ষণের মতো। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কনের মানসিক সংবেদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি তার নতুন সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভূমিকায় রূপান্তরকে চিহ্নিত করে। প্রাচ্য সভ্যতায় ঘোমটাকে কেবল এক টুকরো আলাদা ফ্যাব্রিক নয়; বরং ইতিহাস, শ্রদ্ধা, রহস্য এবং নারীসুরক্ষার প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। সিনেমার স্বপ্নময় বিয়ের দৃশ্য থেকে বাস্তব জীবনের আচার-অনুষ্ঠান পর্যন্ত, ঘোমটা বিয়ের পোশাকের অন্যতম প্রতীকী উপাদান হয়ে আছে, থাকবে।
ঐতিহাসিকভাবেও ঘোমটাকে একসময় বিনয়, শ্রদ্ধা ও লজ্জাশীলতার সঙ্গে যুক্ত মনে করা হতো, যা নববিবাহিত নারীর নতুন ঘরে প্রবেশের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত। আবার কারও কারও মতে, এটি একজন কনের কন্যা থেকে নারীতে রূপান্তরের প্রতীক। তা ছাড়া প্রবীণদের সামনে বা পবিত্র আচার-অনুষ্ঠানের সময় মাথা ঢেকে রাখা নম্রতা ও শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটায় বলে গণ্য করা হতো। প্রাচীনকাল থেকে এমন ধারণা চলে এসেছে। সুদূর অতীতে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ঘোমটা কনের পবিত্রতা নির্দেশ করে, সব জাগতিক বিভ্রান্তি থেকে তাকে সুরক্ষিত রাখে। আর আধ্যাত্মিক অর্থে মনে করা হয়, বিয়ের ঘোমটা জ্ঞাত ও অজ্ঞাত, ব্যক্তিগত ও পবিত্র—এমন দুই জগতের মধ্যে একটি পর্দা হিসেবে কাজ করে। এটি জীবনের এক নতুন পর্যায়ের দৃশ্যমান রূপক, যেখানে কনে তার প্রথম পরিচয় ত্যাগ করে স্ত্রী ও পুত্রবধূর ভূমিকায় পা রাখেন।
তবে বিয়ের ঘোমটার সঙ্গে সম্পর্কিত সবচেয়ে স্থায়ী বিশ্বাসগুলোর অন্যতম হলো কনেকে কুনজর থেকে রক্ষা করা। একজন কনে, যিনি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন, তাকে ঈর্ষা, বিদ্বেষ বা দুর্ঘটনাজনিত নেতিবাচক শক্তির ঝুঁকিতে না ফেলার কাজটি একমাত্র ঘোমটাই করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়। যেন এটি একটি আধ্যাত্মিক ঢাল, যা কনেকে অদৃশ্য শক্তি থেকে সুরক্ষিত রাখে।
বর্তমান সময়ে কি এত কিছু মনে করে কনেরা ঘোমটা পরেন? এককথায় উত্তর হচ্ছে, না। বেশির ভাগ কনের কাছেই এটি জাস্ট একটি স্টাইল স্টেটমেন্ট। আবার কারও কারও কাছে একরকম পর্দাও, যা অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তাকে বিশেষ গোপনীয়তার অনুভূতি দেয়। পর্দা করার কাজটি যে শুধু তার ধর্মীয় দুর্বলতা এমন নয়; তিনি একটি নতুন জীবনে, নতুন পরিবারে প্রবেশ করছেন, যেখানে অচেনা মানুষজন ঘনিষ্ঠভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে, তা থেকে নিজেকে আড়াল করার একটি পন্থা হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপ তো রয়েছেই। ভারতীয় সভ্যতায় যেমন মনে করা হয়, ঘোমটা বিনয়, নম্রতা ও ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্যের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার সাংস্কৃতিক বা বৈবাহিক রীতিনীতির প্রতি কনের আত্মসমর্পণেরও ইঙ্গিত দেয় এই আব্রু।
আমাদের লোককথায় কনের ঘোমটার কথা বহুবার এসেছে। কোথাও বলা হয়েছে, কনে যেন লজ্জায় মুখ ঢাকেন ঘোমটার নিচে; আবার কোথাও বলা হয়েছে, ঘোমটা আসলে কনের স্বামীর বাড়ি যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী। ‘ঘোমটা টানা বউ’ শুনলেই মনে হয় সেখানে লাজুকতা, সৌন্দর্য আর রূপকথার মতো মায়া একসঙ্গে মিশে আছে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের বিয়েতে এখনো প্রথমবার কনের ওড়না বা ঘোমটা সরানোর মুহূর্তকে সবচেয়ে আবেগময় সময় হিসেবে ধরা হয়। হাসিঠাট্টা, গানের সুর আর লাজুক কনের মুখ ঘিরে থাকা পুরো পরিবার; সব মিলিয়ে ভালোবাসার এক অন্য রকম আবহের কাজ করে তখন ঘোমটা। মনোবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঘোমটার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হচ্ছে, এটি কনের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। মুখ আংশিক ঢাকা থাকলেও তার চোখের ভাষা তখন আরও জাদুকরি হয়ে ওঠে। ঘোমটার আড়ালে দাঁড়িয়ে তিনি যেন নতুন পৃথিবীর দিকে পা বাড়ানোর সাহস পান।
ফ্যাব্রিক ও রং ব্যবহারের দিক থেকে আমাদের দেশের কনে-ঘোমটার ইতিহাস যত রঙিন, ততই বৈচিত্র্যময়। প্রাচীনকালে গ্রামীণ বাংলায় একমাত্র লাল শাড়ির আঁচলই ছিল ঘোমটা। বরের সামনে কনে যখন প্রথম আসতেন, মাথায় থাকত সেই আঁচল। আলাদা করে ওড়নার ব্যবহার হতো না বললেই চলে। মোগল প্রভাবের সময় এই অঞ্চলে ভারী কাজ করা ওড়না জনপ্রিয়তা পায়। তখন জমকালো জরি, পাড় আর কড়ির নকশা দিয়ে তৈরি হতো কনের বিয়ের পর্দা। ঔপনিবেশিক যুগে আবার ব্রিটিশ প্রভাবে শুরু হয় লেইস, নেট বা হালকা কাপড়ের ব্যবহার। ইউরোপীয় স্টাইলের ভেইল বা ঘোমটাও তখন রাজবাড়ি ও নবাববাড়ির কনেদের সাজে ঢুকে পড়ে। এদিকে, আজকালকার কনেরা তো নিজেদের পছন্দমতো ওড়না বেছে নেন। শাড়ি বা লেহেঙ্গার সঙ্গে মিলিয়ে কিংবা কনট্রাস্ট ওড়না কাস্টমাইজ করে নেওয়া হয়। অবশ্য স্টাইলে বৈচিত্র্য এলেও লাল রঙের জনপ্রিয়তা এখনো তুঙ্গে। লাল বেনারসি ওড়না জড়িয়ে তৈরি কনের ঘোমটাকে আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক ধরা হয়। আর সোনালি জরি কাজের ঘোমটা আভিজাত্যের ছোঁয়া দেয়। যেখানে হালকা নেটের ঘোমটা আধুনিকতা ও স্নিগ্ধতার মেলবন্ধন ঘটায় বলে মনে করা হয়।
ফুল দিয়েও এখন ওড়না বা ঘোমটা বানানো হয়। তবে সেটি গায়েহলুদের দিনে পরার চলই বেশি। শহুরে বিয়েতে পশ্চিমা ধারার ভেইলও পরেন কোনো কোনো কনে। সাদা গাউনের সঙ্গে লম্বা ভেইল, হীরার গয়না আর হাতে ফুল—একেবারে ছবির মতো পশ্চিমা বউ। ইদানীং আবার লাল বেনারসির ওপর সাদা নেট ভেইল পরে আনকোরা ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি করছেন কেউ কেউ। মিনিমালিস্ট ভেইল, থ্রিডি ফুলের কাজ কিংবা হালকা রঙিন নেট—যে যা-ই ব্যবহার করেন না কেন, ফটোশুটের সময় এই ওড়না বা ঘোমটাই সবচেয়ে নাটকীয় দৃশ্য তৈরি করে। বাতাসে উড়ে যাওয়া ওড়না, সূর্যের আলোতে ঝলমল করা তার গর্জাস এমব্রয়ডারি, আড়ালে কনের লাজুক মিষ্টি হাসি—সবই বিয়ের ছবিতে অসাধারণ প্রাণবন্ততা এনে দেয়।
আসলে কনের ঘোমটা বা ওড়না কেবল অনুষঙ্গ নয়, বরং একরকম স্টেটমেন্ট। যার কাজ কনেকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা, রহস্যময় ও মায়াময় করে তোলা। যার আবেদনে এতটাই, শুনলে মনে হয়, এ যেন শত বছরের লোকগাথা, ঐতিহ্য আর আনন্দের বার্তাবাহক দূত!

 রত্না রহিমা
মডেল: বনি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top