ফিচার I জেট সেট ক্যাজুয়াল
কর্মসূত্রে ভ্রমণ মানেই ব্যস্ত সূচি। একের পর এক মিটিং, নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট আর সামাজিক আয়োজন। তাই ব্যবসায়িক সফরের জন্য প্যাকিং করা সহজ নয়। এ কোনো ছুটির ভ্রমণ নয়, যেখানে শুধু সানস্ক্রিন আর শর্টসই যথেষ্ট। তা ছাড়া ভ্রমণ আর ফ্যাশনের এই সম্পর্কও কিন্তু আজকের নয়
বিশ্বজুড়ে বিমান ভ্রমণের উত্থান ঘটে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, যখন আকাশপথে যাত্রা ছিল অভিজাতদের বিলাসবহুল অভ্যাস। স্পেনের মারবেলা, ইতালির রোম, ফ্রান্সের কান কিংবা গ্রিসের মাইকোনোসের মতো শহরে তারা ছুটি কাটাতে যেতেন। তখনই জন্ম নেয় এক নতুন ফ্যাশন ধারা, ‘জেট সেট স্টাইল’। বিমানবন্দরের ধাপে ধাপে হাঁটাও যেন হয়ে উঠেছিল নতুন ধারার ক্যাটওয়াক। জ্যাকলিন কেনেডি, অড্রে হেপবার্ন, রিটা হেওয়ার্থের মতো তারকারা হয়ে ওঠেন সেই সময়ের স্টাইল আইকন; যাদের কাছ থেকে প্রেরণা নিয়ে আজও আধুনিক বিজনেস ট্রিপ ফ্যাশন গড়ে উঠছে।
ষাটের দশক: ফিউচারিজমের ছোঁয়া
সেই দশকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন মহাকাশ অভিযানের উত্তেজনা পুরো পৃথিবীকে নতুন যুগের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল, ফ্যাশন জগতেও শুরু হয় এক ভবিষ্যৎধর্মী বিপ্লব। ইতালিয়ান-ফ্রেঞ্চ ডিজাইনার পিয়ের কারদিন ও স্প্যানিশ-ফ্রেঞ্চ ডিজাইনার পাকো রাবান প্রচলিত ধারা ভেঙে আনেন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। ফ্যাশনে প্রযুক্তি ও কল্পনার মেলবন্ধনে তারা ব্যবহার ঘটাতে শুরু করেন আর্টিফিশিয়াল ফাইবার, মেটাল ফ্যাব্রিক, প্লাস্টিক ও চেইন-লিংকের মতো অপ্রচলিত উপাদান। তাদের নকশা করা পোশাকে দেখা যেত তীক্ষè জ্যামিতিক কাট, গঠনমূলক সিলুয়েট এবং একধরনের স্পেস-এইজ গ্ল্যামার। এ সময়ের ফ্যাশন আইকন ব্রিজিত বার্দো ও ক্যাথরিন দেনুভ হয়ে ওঠেন নতুন ধারার প্রতীক। হাঁটু পর্যন্ত বুট, গোল ফ্রেমের সানগ্লাস, মিনি স্কার্ট ও মিনিমাল হ্যান্ডব্যাগে তারা উপস্থাপন করতেন আধুনিক, আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন নারীর চিত্র।
আজকের দিনে সেই ধারণা প্রভাব ফেলেছে বিজনেস ট্রিপ ফ্যাশনে। যদিও আর অতিরিক্ত গ্ল্যামার নয়, আধুনিক জেট সেটার ব্যবসায়িক ভ্রমণে বেছে নেন আরামদায়ক, ব্যবহারিক ও স্টাইলিশ পোশাক, যা একই সঙ্গে আত্মবিশ্বাস ও পেশাদারত্বের প্রকাশ ঘটায়। যেমন স্ট্রেচি নিটস, ট্র্যাক সেট, ওভারসাইজড ব্লেজার বা নিটেড জাম্পসুট, যা লং-হল ফ্লাইটে আরাম দেওয়ার পাশাপাশি সেমিনার বা মিটিংয়ে প্রফেশনাল লুক বজায় রাখে।
সত্তর থেকে নব্বই: আরামদায়ক স্বাধীনতা
সত্তরের দশকে বৈশ্বিক তেলসংকট সাময়িকভাবে বিমান ভ্রমণের উচ্ছ্বাস কমিয়ে দিলেও, ফ্যাশনের জগতে জন্ম নেয় এক নতুন অধ্যায়; স্বাধীনতা, স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বতঃস্ফূর্ততার যুগ। সে সময়ের স্টাইল আইকন বিয়ানকা জ্যাগার, জেন বার্কিন ও ফারাহ ফসেট তাদের পোশাকে আনেন অনায়াস গ্ল্যামার। ঢিলেঢালা প্রিন্টেড ড্রেস, হালকা কাপড়, প্রাকৃতিক রং এবং সহজ চলাফেরার ছন্দে প্রকাশ করেন সেই যুগের মুক্তচেতা মানসিকতা। জেট সেট স্টাইল তখন আরও স্বাভাবিক ও ব্যক্তিত্বনির্ভর হয়ে ওঠে।
এরপরের দুই দশক বাস্তবতা, পরিশীলন ও ব্যবহারিক বিলাসিতার যুগ হিসেবে চিহ্নিত। করপোরেট জগতে নারীর উপস্থিতি বাড়তে থাকায় ফ্যাশনে প্রয়োজন পড়ে এমন পোশাক, যা একই সঙ্গে পেশাদার, মার্জিত ও আরামদায়ক। এ সময় ক্যালভিন ক্লেইন ও ডোনা কারান প্রবর্তন করেন ওয়্যারেবল লাক্সারি ধারাটি; যেটির তাৎপর্য হলো বিলাসিতা মানে কেবল শোভা নয়, বরং দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য সৌন্দর্য।
নিউট্রাল রঙের টোন, নিখুঁত কাটের টু-পিস সেট, বড় সানগ্লাস, সিল্ক স্কার্ফ এবং ক্ল্যাসিক লুই ভিতোঁ ব্যাগ তখন হয়ে ওঠে ফ্যাশন-সচেতন ভ্রমণকারীর অপরিহার্য সঙ্গী। আজকের দিনেও বিজনেস ট্রিপ ফ্যাশনে সেই ধারণার ছাপ পাওয়া যায়, যেখানে পোশাক একই সঙ্গে আরামদায়ক, ব্যবহারিক ও পেশাদারত্বপূর্ণ এবং ভ্রমণকারীর আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশক।
আধুনিক যুগ: ভ্রমণ ফ্যাশনের পুনঃসংজ্ঞায়ন
বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে করোনা অতিমারি-পরবর্তী যুগে, ভ্রমণ ফ্যাশনে এসেছে বড় পরিবর্তন। এখন আর জেট সেটার মানে কেবল বিলাসবহুল জীবন বা প্রফেশনাল আভিজাত্য নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে আরাম, কার্যকারিতা এবং ব্যক্তিগত স্টাইলের সুষম মিশ্রণ। অনেকে এমন পোশাক বেছে নিচ্ছেন, যা দীর্ঘ বিমানভ্রমণে আরাম দেয়, মিটিং বা নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে প্রফেশনাল লুক বজায় রাখে এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে।
আজকের এয়ারপোর্ট লুক এক নতুন সংজ্ঞা পেয়েছে। স্ট্রেচি নিটস, ট্র্যাক সেট, ওভারসাইজড ব্লেজার, নিটেড জাম্পসুট বা কোমল লাউঞ্জওয়্যারই এখন ভ্রমণ ফ্যাশনের মূলধারা। এই পরিবর্তনে যুক্ত হয়েছেন সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে সাধারণ যাত্রী। সবাই খুঁজছেন এমন পোশাক, যা স্টাইলিশ, আরামদায়ক ও ভ্রমণবান্ধব। ফলে আধুনিক জেট সেট স্টাইল এখন শুধু গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যম নয়; এটি নিজেই এক যাত্রা, যেখানে ফ্যাশন মানে নিজের আরাম, স্বতঃস্ফূর্ততা ও পরিচয়ের প্রকাশ ঘটায়।
স্মার্ট প্যাকিং টিপস
ভাঁজ প্রতিরোধী কাপড় বেছে নিতে পারেন; যেমন কটন-ব্লেন্ড, উল বা পলিয়েস্টার উপযুক্ত। এগুলো ভ্রমণের পরও থাকে সুন্দর ভাঁজবিহীন।
নিউট্রাল রঙের পোশাক বেছে নেওয়া যায়; কালো, ধূসর, বেইজ বা নেভি—এগুলো সহজে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করা সম্ভব।
একটি কিংবা দুটি জুতা নিতে পারেন; তবে তা যেন কোনো কিছুর সঙ্গে মানিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে একটি ড্রেস শু এবং একটি আরামদায়ক ফ্ল্যাট বা স্নিকারই যথেষ্ট।
ওয়্যারড্রোব বাছাইয়ে আবহাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া শ্রেয়। গরমে লিনেন বা কটন, ঠান্ডায় উল বা ক্যাশমেয়ার বেছে নেওয়া যেতে পারে।
প্যাকিং কিউব ব্যবহার করতে পারেন। এতে কাপড় গোছানো থাকে, জায়গা বাঁচে, খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।
সঙ্গী করতে পারেন ক্যারি-অন ব্যাগ; এতে সময় বাঁচবে এবং ভ্রমণ হবে আরামদায়ক।
প্রতি পর্বে স্টাইল
একটি ব্যবসায়িক ভ্রমণে প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য সঠিক পোশাক নির্বাচন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ভ্রমণের সময় আপনার আরাম ও উপস্থিতি—দুটোই পেশাদার ভাব প্রকাশ করে। ফ্লাইটের সময় আরামদায়ক টপ, স্ট্রেচেবল প্যান্ট এবং সঙ্গে একটি হালকা কার্ডিগান বা ব্লেজার আপনাকে রাখবে আরামদায়ক ও স্টাইলিশ। দীর্ঘ ফ্লাইটে কম্প্রেশন মোজা রক্তসঞ্চালনে সাহায্য করে, আর স্লিপ-অন জুতা হাঁটার জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। মিটিংয়ের সময় বেছে নিতে পারেন নিউট্রাল রঙের ব্লেজার, সাদা বোতাম-ডাউন শার্ট ও কালো ট্রাউজার, যা আত্মবিশ্বাসী ও প্রফেশনাল লুক দেয়; সঙ্গে ক্ল্যাসিক লোফার, হালকা ঘড়ি বা সূক্ষ্ম জুয়েলারি আপনার উপস্থিতিকে করবে আরও পরিশীলিত। ডিনার বা নেটওয়ার্কিং ইভেন্টে নারীরা সাদামাটা কিন্তু আকর্ষণীয় ড্রেস বা জাম্পস্যুট পরতে পারেন, আর পুরুষদের জন্য উপযুক্ত ডার্ক স্যুট; নিজের স্টাইল ফুটিয়ে তুলতে হালকা অ্যাকসেসরিজ জুড়ে দিলে মন্দ হবে না। শহর ঘোরা বা অবসরে বেছে নিতে পারেন জগারের সঙ্গে কটন টপ, হালকা জ্যাকেট ও আরামদায়ক স্নিকার, যা দিনভর চলাফেরায় স্বস্তি দেবে; আর ক্রসবডি ব্যাগ বা ফ্যানি প্যাক রাখলে চলাফেরায় থাকবে আরও সুবিধা ও নিরাপত্তা। ছুটির দিনে, সফট নিট সোয়েটার, ডার্ক জিনস ও স্নিকার পরলে একই সঙ্গে পাবেন আরাম ও স্মার্টনেস; প্রয়োজনে কার্ডিগান বা ডেনিম জ্যাকেট দিয়ে লেয়ার করলে পরিস্থিতি অনুযায়ী সহজে বদলে ফেলা যাবে লুক।
জেট সেট ফ্যাশনের ইতিহাস আমাদের শেখায়, ভ্রমণ মানে শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো নয়; এটি একটি স্টাইল স্টেটমেন্টও। গেল পঞ্চাশের দশকের বিলাসিতা থেকে শুরু করে আজকের স্মার্ট ও কমফোর্টেবল ট্রাভেল লুক—সবই সময়ের প্রয়োজন ও জীবনধারার প্রতিফলন। আজকের ভ্রমণকারীর পোশাক যেমন গ্ল্যামারাস, তেমনই কার্যকারিতাসম্পন্ন। অফিস মিটিং, ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট কিংবা সপ্তাহান্তের ছুটি—সব জায়গায় ফ্যাশন এখন অভিযোজিত, বাস্তবসম্মত ও আত্মবিশ্বাসী।
শিরীন অন্যা
মডেল: আজরাফ ও প্রিয়ন্তী
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ব্লুচিজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল
