পোর্টফোলিও I বাংলাদেশের শাড়ি
বাঙালির শাড়ি পরার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। অনবদ্য পরিধাননৈপুণ্য এবং প্রয়োজন-বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখেই হয়ে থাকে শাড়ির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস। বিস্ময়কর এই সৃজনশীল নৈপুণ্যের নেপথ্যের কুশীলবেরা আমাদের পূর্বপুরুষ; ‘শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী’ হিসেবেই তাঁরা কিংবদন্তি। পৃথিবীর যে কটি জাতিগোষ্ঠী তাদের হাজার বছরের যেসব প্রাচীন পোশাকের ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে, বাঙালি এবং তার শাড়ি সেগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। বহু শতাব্দী ধরেই বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে তাঁতে শাড়ি বোনার প্রচলন ছিল। সেই চর্চা আজও অব্যাহত রয়েছে। এবার পাঁচটি অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি উপস্থাপন করা হলো। এর উদ্দেশ্য আমাদের বয়নশিল্পীদের সৌকর্যকে প্রতীয়মান করা। ঐতিহ্যকে অবিকল রেখে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছেন আমাদের হালের শিল্পীরা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন
জামদানি
এই মসলিনেরই একটি ধরন নকশাদার মসলিন বা জামদানি হিসেবে সুপরিচিতি পায়। আজও নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই বয়নশিল্পের চর্চা জামদানি বয়নশিল্পীরা বহমান রেখেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার কয়েকটি গ্রামে। জামদানি বয়নশিল্প এক বিস্ময়কর বয়নকৌশল; শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর। একবারে সরল গর্ততাঁতে (পিটলুমে) কাপড় বোনার সময় বয়নশিল্পীরা নকশা ফুটিয়ে তোলেন। এই অসামান্য বয়ননৈপুণ্যের নেপথ্যে রয়েছে বয়নশিল্পীদের প্রজন্মান্তরের নিরন্তর চর্চা। এই মূলত বাঁশ ও সামান্য কাঠের দন্ডের সহায়তায় তৈরি তাঁতে বিশ্বকে বিস্মিত করে বয়নশিল্পীরা সৃষ্টি করে চলেছেন অনন্য বয়নকাব্য। জামদানি তাঁতে দুজন অসমবয়সী বয়নশিল্পী সমান্তরালভাবে বসে বোনার কাজ সম্পাদন করেন। এই শাড়ি বোনা হয় ৮৪ কাউন্ট সুতি সুতার টানায় আর একই কাউন্টের সুতি সুতার ভরনায়। ইঞ্চি পাড়ের এই শাড়ির আঁচলে রয়েছে বাস্ক মোটিফ। আর জমিনে জাল কাজ ও বিচি ফুল।
শাড়ি: আবুল কালাম জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি
কৃতজ্ঞতা: মো. শফিকুল ইসলাম শফি
মডেল: তৃণ
টাঙ্গাইল
সিন্ধু নদের অববাহিকা থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে ধামরাই। সেখান থেকে টাঙ্গাইল। এ এক সুদীর্ঘ সফর। কয়েক হাজার বছরের ধারাবাহিকতা। টাঙ্গাইল শাড়ির বয়ন-ঐতিহ্য আজও সমুজ্জ্বল নানা সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। সময়ের সঙ্গে নানা পরিবর্তন হয়েছে সঙ্গী। প্রজন্মান্তরে বয়নশিল্পীরা আজও অব্যাহত রেখেছেন বয়নশৈলীর সৌকর্য।
১০০ কাউন্ট সুতি সুতার টানা ও ৮২ কাউন্ট সুতি সুতার টাঙ্গাইলের গর্ততাঁতে জ্যাকার্ড বয়নকৌশলে বোনা হয়েছে এই শাড়ি। বর্ণময় উইভিং ডিজাইনের চওড়া পাড় সাদা জমিনকে ফুটিয়ে তুলেছে।
শাড়ি: জগেশ্বর অ্যান্ড কোম্পানি, চন্ডী, পাতরাইল, দেলদুয়ার।
কৃতজ্ঞতা: খোকন বসাক
মডেল: ওশিন
শাহজাদপুর
তাঁত এবং তাঁতিজীবনের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক নিবিড়। বৃহত্তর পাবনায় তা সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য- দুটিই বয়ে এনেছে। সেখানে যমুনা যেন নীল নদ। পাবনা-সিরাজগঞ্জে যমুনার জোয়ারভাটার সঙ্গেই বহমান তাদের তাঁতিজীবনের বাস্তবতা। পাবনা ভাগ হয়ে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ পৃথক জেলা হয়েছে। বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলের শাড়ি বোনার ঐতিহ্য বহমান থাকলেও উন্নত মানের শাড়ি এখন কেবল সিরাজগঞ্জে বোনা হয়ে থাকে। এখানে জ্যাকার্ডে যেমন শাড়ি বোনা হয়, তেমনি সম্পূর্ণ হাতেও বোনা হয়ে থাকে। শাড়ির অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে বহতা সময়ের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই বয়নশিল্পীরা সেখানে শাড়ি বুনে থাকেন। এই শাড়ি বোনা হয়েছে চিত্তরঞ্জন তাঁতে। ৮০ কাউন্টের টানা সুতার সঙ্গে ৮০ কাউন্টের ভরনার সুতায়। মোটিফের আকার রজনীগন্ধা ফুলের মতো হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে রজনীগন্ধা।
শাড়ি: সানিন উইভিং ফাক্টরি
কৃতজ্ঞতা: আলহাজ আজমল কবীর
মডেল: মাইশা
বেনারসি
বেনারসি এই ভূখন্ডের বয়নশৈলী না হয়েও মিশে গেছে এখানকার জলহাওয়ায়। বাংলাদেশে এই শিল্প পরিযায়ী পরিস্থিতি থেকে এ-মাটিরই হয়ে গেছে। একে বলা যেতে পারে লোকজ শিল্পের যথার্থ অভিবাসন। অনন্য এই শাড়ির এবং এর বয়নশৈলীর ক্রমবিবর্তনও উল্লেখযোগ্য। এই শাড়ি বোনা হয়েছে ২০-২১ কাউন্টের কাতান টানায় একই কাউন্টের ফাইভ প্লাই ভরনায় পিউর সিল্ক সুতায়।
শাড়ি: আসির আহমেদ
সামা সিল্ক
কৃতজ্ঞতা: রফিকুল ইসলাম
মডেল: তানিয়া
মণিপুরি
মণিপুরি সম্প্রদায়ের মধ্যে শাড়ি পরার চল ছিল না। ঊর্ধ্বাংঙ্গে পরার জন্য তারা যে ইনাফি ব্যবহার করে, তা থেকেই শাড়ির উৎপত্তি। স্থানীয় বাঙালিদের আগ্রহ, চাহিদা ও উৎসাহে। সেটা আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুতে। মণিপুরি সম্প্রদায়ের ব্যবহার্য বস্ত্র সুতি ছাড়া কখনোই হয়নি। তবে শাড়িও তাই সুতি সুতায় বোনা শুরু হয়। পরে টেট্রন সুতা সুতি সুতার জায়গা দখল করে। অবশ্য সুতি সুতায় শাড়ি বোনার চল পুনরায় শুরু হয়েছে। শাড়িতে ব্যবহৃত একটি টেম্পলকে বলে মৌরাং। আর একাধিক টেম্পল নকশাকে বলা হয় কেওয়া। এ ছাড়া শাড়ির পাড়ের ডিজাইন পরিচিত মৌরাংকাবি হিসেবে। একেকটি শাড়ি বুনতে একজনের ১০-১২ দিন সময় লাগে। দুজনের ৫-৬ দিন। এই শাড়ি ৮০ কাউন্টের টুইস্ট সুতায় টানা ও ৬০ কাউন্টের সিঙ্গল প্লাই সুতার ভরনায় বোনা হয়েছে।
শাড়ি: মৌরাং, এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)
কৃতজ্ঞতা: লক্ষ্মীকান্ত সিংহ ও নোংপকলৈ সিন্হা
মডেল: অন্তরা