কভারস্টোরি I মূলধারায় পথপ্রেরণা
সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার রাস্তায়, প্রচলিত প্রবাহের বিপ্রতীপ প্রজন্মের ফ্যাশনরূপে উঠে এসেছিল স্ট্রিট ফ্যাশন। ক্রমে ফ্যাশনের মূল জনপ্রিয় ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ধারা বর্ণনা করেছেন ফারজানা ইউসুফ
স্ট্রিট ফ্যাশন। কয়েক দশক ধরেই ফ্যাশন জগতে বিরাজমান। এই নতুন ফ্যাশন ধারার আবির্ভাব কিন্তু প্রায় আকস্মিক ও বিস্ময়কর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক বদল ঘটে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে জনজীবনে। যুদ্ধশেষে অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে উঠলে, শিল্পায়নের ফলে জীবনধারণের সব উপকরণ ক্রমশ সহজলভ্য হয়ে ওঠে। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সবকিছুরই উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। নিত্যব্যবহার্য উপাদানের আধিক্য আর প্রাচুর্যের সমারোহ সবাইকে অভিভূত করে তোলে। এই পরিস্থিতি কিছুটা হলেও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন করে। প্রচলিত জীবনধারা, স্বকীয়তা, কৃষ্টি-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সব রীতি হারিয়ে যেতে থাকে। নব্য-সৃষ্ট এই প্রাচুর্যে, একই ধাঁচের বসতবাড়ি, পোশাক-আশাক আর জীবনযাত্রায় যেন হাঁপিয়ে পড়ে মানুষ; একঘেয়ে যাপনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এর থেকে মুক্তি খুঁজতে উদ্ভব হয় নতুন এক প্রজন্মের। ক্লান্তিকর সেই জীবনকে ঝেড়ে ফেলে, তথাকথিত সামাজিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন যাপনে তারা অভ্যস্ত হতে চেয়েছে। বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে চেয়েছে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ফ্যাশন: পোশাক-আশাক থেকে অনুষঙ্গ- সবই; এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক ফ্যাশন ট্রাইব।
সময়টা ষাটের দশক। লন্ডনের রাজপথে নানা সাজের, নানা বেশভূষার কেতাদুরস্ত কিছু তরুণ-তরুণীর আবির্ভাব ঘটে। বলা যায় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের মিসফিট, তথা ভিন্নধর্মী এমনকি প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধ স্রোতে ধাবমান এক নতুন প্রজন্ম। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য সব রীতিনীতির বিরুদ্ধাচরণই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। এ বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সহজ মাধ্যম ফ্যাশন অর্থাৎ সাজপোশাক। লন্ডনের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো তরুণ-তরুণীর পোশাক, কেশবিন্যাশ, মেকআপ, অ্যাকসেসরিজের এই নতুন ধারা ছিল সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সীমা ডিঙানো প্রায় উদ্ভট আর কুরুচিপূর্ণ! ফ্যাশনের এই ধারাই পরবর্তীকালে পাঙ্ক, হিপ্পি, গ্রাঞ্জ, গথিকসহ নানান নতুন ধরনের ফ্যাশন ধারার জন্ম দেয়। নিরীক্ষাধর্মী বেশভূষার সে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার জন্য কিছু সৃজনশীল আলোকচিত্রী ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এভাবেই পরবর্তীকালে স্ট্রিট ফ্যাশন ফটোগ্রাফি নামে একটি নতুন ধারার জন্ম হয়। প্রকৃতপক্ষে সত্যিকারের স্ট্রিট স্টাইল একেবারেই সহজাত একটি আচরণ। এই প্রক্রিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বরং প্রায় অকপট। মূলত আলোকচিত্রী এবং তার ফ্যাশন দুরস্ত ‘সাবজেক্ট’ একে-অপরের ভূমিকায় প্রায় অজ্ঞাত।
পরবর্তী দশকগুলোতে এই প্রক্রিয়া আরও জনপ্রিয়তা পায়। ফ্যাশন ফটোগ্রাফির এই ধারা ব্যবহৃত হতে শুরু করে ফ্যাশন প্রকাশনার নানা মাধ্যমে। ফ্যাশনের নতুন নতুন ট্রেন্ড রাজপথে কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, কোন ফ্যাশন ধারা বেশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে- এসব পর্যবেক্ষণের কাজে বারবার স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশন উঠে আসতে থাকে ফ্যাশন সংবাদে। এমনকি আজকের দিনের ফ্যাশন ব্লগার, স্টাইলিস্ট, ডিজাইনাররা পর্যন্ত স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশন থেকে নিত্যনতুন অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকেন। স্ট্রিট স্টাইল বা ক্যাজুয়াল পোশাকরীতি শুধু ছেঁড়া জিনস, অদ্ভুত টি-শার্ট আর উদ্ভট সাজপোশাককে উপস্থাপন করে না। বর্তমানে এটি ফ্যাশন জগতের প্রধান একটি ধারা হিসেবে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত। স্ট্রিট স্টাইল আজকের দিনে তাই ফ্যাশনের নতুন একটি চেতনা। এটি শুধু তাৎক্ষণিক, অনাড়ম্বর অথবা মলিন নয়; বরং স্বকীয়তা, সৃজনশীলতা আর অভিনবত্বে ভরপুর। আর এ কারণেই জাঁদরেল সব ফ্যাশন হাউজ প্রণোদিত হয়েছে এই অভিনব ধারাকে আলিঙ্গন করতে। প্যারিস-মিলান-নিউইয়র্ক-লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী ও প্রসিদ্ধ সব ফ্যাশন হাউজ ট্র্যাডিশনাল, ফরমাল স্টাইল থেকে বেরিয়ে এসে আটপৌরে, ক্যাজুয়াল এমনকি প্রায় সাধারণ ধারার এই পোশাকরীতিকে উপস্থাপন করেছে নিজস্ব ঢঙে।
আজকের গতিশীল ও প্রসারমাণ ফ্যাশন জগতে স্ট্রিট স্টাইল নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যমের কারণে পার্সোনাল স্টাইলিং উঠে এসেছে নতুন আঙ্গিকে। বর্তমানে স্ট্রিট স্টাইল শুধু ফ্যাশন দুরস্ত সাধারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এ অভিব্যক্তির গন্ডি বহুদূর প্রসারিত হয়েছে। ফ্যাশন উইক প্রতিবছর দুবার পৃথিবীবিখ্যাত ফ্যাশন ক্যাপিটাল প্যারিস-লন্ডন-মিলান-নিউইয়র্কে আয়োজিত হয়। এর সুবাদে গ্লোবাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মিলনমেলা বসে এসব শহরে। প্রতিবছর ফ্যাশন উইক চলাকালে ফ্যাশন জগতের লোকজন যেন বহ্নিশিখায় ধাবমান পতঙ্গের মতো সমবেত হয় এসব ফ্যাশন ক্যাপিটালে। লন্ডন-প্যারিস-মিলান-নিউইয়র্কের রাজপথে পৃথিবীর নামকরা ফ্যাশন এডিটর, বায়ার, মডেল, সাংবাদিক, চিত্রতারকা, সোশ্যাল সেলিব্রিটি এমনকি সর্বশেষ সংযোজন ফ্যাশন ব্লগার- সবাই উপস্থিত হন নিজেদের সহজাত মহিমা নিয়ে। এ কারণেই পুরো ফ্যাশন জগৎ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী ফ্যাশন সিজন আর নিত্যনতুন ফ্যাশন ধারণা পাবার জন্য। এই ধারার ফ্যাশন এখন এতটাই প্রকট যে ফ্যাশন উইকের সময় ফ্যাশন ক্যাপিটালগুলোতে সৃষ্টিশীল ফ্যাশন উপস্থাপনের হিড়িক পড়ে যায়। নান্দনিক, সৃজনশীল, রুচিসম্মত- এই ধারণাগুলোর সীমারেখায় আচ্ছন্ন ফ্যাশনবোদ্ধারা নিজেদের উপস্থাপন করেন তাঁদের স্বকীয় সৃজনসম্ভার। সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে শিল্প, পপ কালচারের নানা মেলবন্ধনে নিজেদের সাজিয়ে উপস্থাপন করেন। আর তাদের সাজপোশাককে ফ্রেমবন্দি করার জন্য ফ্যাশন ফটোগ্রাফাররা গভীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ থাকেন রেড কার্পেটের আশপাশে। ফ্যাশন ফটোগ্রাফাররা চটজলদি এসব ফ্যাশন উপাস্য ব্যক্তিকে নিজেদের ক্যামেরাবন্দি করেন আর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন সারা বিশ্বে, ফ্যাশন-সচেতন তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এভাবে অতীতের স্ট্রিট ফ্যাশন বর্তমানে তার সহজাত স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে হয়ে উঠেছে ফ্যাশন বিপণনের আরেকটি মাধ্যম। স্ট্রিট ফ্যাশন গোড়াতে যে ধ্যান ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করে, বর্তমানে তা থেকে সরে এসেছে। অতীতে এর উপস্থাপনা ছিল সাবলীল। কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যদিকে বাস্তবিকভাবে বর্তমানের স্ট্রিট স্টাইল অনেকটাই কৃত্রিম। এটি মূলত পরবর্তী সিজনের ফ্যাশনকে সহজেই গণমাধ্যমে জনপ্রিয় করার একটি প্রচ্ছন্ন প্রয়াস ছাড়া আর কিছুই নয়।
এত কিছুর পরেও ফ্যাশনে এগিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কাছে স্ট্রিটস্টাইল তার সহজাত মহিমায় টিকে আছে। ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা, নিজেকে উপস্থাপনের সবচেয়ে পছন্দনীয় এবং সহজাত মাধ্যম হিসেবে স্ট্রিট ফ্যাশন এখনো অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রতিদিন নিজেকে স্বকীয় ঢঙে উপস্থাপনার জন্য, সৃজনশীলভাবে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য এর চেয়ে সহজ কোনো উপায় আর নেই। উপমহাদেশীয় ফ্যাশন এই ধারার বাইরে নয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ফ্যাশন মানচিত্রে তাকালে দেখা যায়, নানা মাত্রিক ফ্যাশনবোধের মেলবন্ধনে দেশটি বেশ এগিয়ে। মূলধারা আর প্রাদেশিক সব ধরনের পোশাকের সঙ্গে সৃজনশীল ওয়েস্টার্ন পোশাকের সংমিশ্রণ এখানে সহজেই লক্ষণীয়। মূলত লৌকিক দেশীয় মোটিফ এবং চারু ও কারুশিল্পের ব্যবহার, সমৃদ্ধ-প্রাচীন-ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র শিল্প, ফ্যাশনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা- সবকিছুই এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভারতীয় ডিজাইনার ওয়্যার তাই এখন বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন দুরস্ত ক্রেতাদের মধ্যে এত জনপ্রিয়! ফলে প্রতিবছর সারা পৃথিবীর ফ্যাশন বায়ার আর ফ্যাশন উৎসুক সবাই গভীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকে ভারতীয় ফ্যাশন উইকের দিকে!
অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশন তার রূপ বদলেছে। ইউরোপীয় আর মার্কিন ফ্যাশন যেমন ভিন্ন, তেমনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের পোশাকের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও এগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে সৃজনশীল মেলবন্ধন। বিশ্বায়নের এই যুগে তাই ছেঁড়া ব্লু-জিনসের সঙ্গে জামদানির শার্ট দেখা যায় নিউইয়র্কের রাজপথে। আবার একই সঙ্গে পুরোনো কাঁথায় তৈরি টেকসই এবং ফ্যাশনসম্মত পোশাক টোকিওর ফ্যাশনমনস্ক তরুণীর আলমারিতে স্থান করে নেয়। স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশন আজকের গ্লোবাল ভিলেজে ফ্যাশনের প্রধান একটি ধারা। তাই বর্তমানের যান্ত্রিক-গতিশীল সমাজে এই ফ্যাশনধারা নিজেকে উপস্থাপনের এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাই আমরাও আজ স্ট্রিট ফ্যাশনের অনুসারী হয়ে উঠেছি। চর্চা করছি। ঢাকার রাজপথে আজকাল সে রকম তরুণ-তরুণীদের দেখা মিলছে। নিত্যদিনের কাজ আর বন্ধুদের সঙ্গে কফিশপে আড্ডা- উপলক্ষ যা-ই হোক না কেন, ফ্যাশনসম্মত ঢঙে নিজেকে সাজাতে এ প্রজন্ম পিছিয়ে নেই। দেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোতে তাকালেও একই চিত্র দৃশ্যমান। ফ্যাশনেবল, রেডি-টু-ওয়্যার ধাঁচের পোশাকের চাহিদা সর্বাধিক। এর প্রধান একটি কারণ দৈনন্দিন জীবনে ফ্যাশন সচেতনতা। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়, ফ্যাশনপ্রীতি পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকের দিকেই বেশি। ডিজাইন হাউজ, ডিজাইনার ব্র্যান্ড, ফ্যাশন সংবাদমাধ্যম, ফ্যাশন আইকন, ক্রিয়েটিভ ফ্যাশন এডিটরিয়াল, গবেষণা ও শিক্ষা, পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা সর্বোপরি এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি না করলে দেশীয় মূলধারার ফ্যাশনের সঙ্গে পশ্চিমা ফ্যাশনের সৃজনশীল সংযুক্তি অসম্ভব। লোকাল ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে গতিশীল করতে এর বিকল্প নেই। দেশীয় সাংস্কৃতিক-শৈল্পিক চিন্তাধারা আর বৈশ্বিক প্রভাবের যথাযথ মেলবন্ধন ঘটলে আমরা হয়ে উঠবো সত্যিকারে ‘গ্লোবাল ফ্যাশন ট্রাইব’।
লেখক: ডিজাইনার, আরশী ডিজাইন স্টুডিও
মডেল: অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মিম
ওয়্যারড্রোব: টুয়েলভ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন ও ইন্টারনেট