এডিটরস কলাম I কথাসৌন্দর্য
কেউ কারও সঙ্গে যখন কথা বলে, তখন সে কিছু শিখে নেয় নিজের অজান্তেই। ভালো ও সুন্দর কিছু শিখতে পারলে সমাজেরই লাভ। উল্টোটি ঘটলে ক্ষতি। এমনকি আপনার বাচনভঙ্গি, শুদ্ধ উচ্চারণ, শব্দচয়ন, স্বরের প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক ওঠানামা, তাকানো, অভিব্যক্তি- এসব থেকে শেখার ও উপলব্ধির বহু কিছু আছে
সবার মধ্যেই নিজেদের উপস্থাপনযোগ্য করে তোলার তাগিদ কমবেশি থাকে। কে কীভাবে নিজেকে অন্যদের কাছে হাজির করতে চান, তা থেকে তিনি কোথায় কাদের সঙ্গে আছেন বা তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সর্বোপরি সাংস্কৃতিক গন্ডি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সৌন্দর্যচর্চায়ও এমন কথা খাটে। কেননা, কারও সুন্দর হয়ে ওঠার ব্যাপারটি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, সব অর্থেই তা সামগ্রিক। খন্ডিত সৌন্দর্য শেষ পর্যন্ত টেকে না। সেই সুন্দরই দীর্ঘস্থায়ী, যা গড়ে ওঠে ভেতর থেকে। আপনার মনের সৌন্দর্য প্রকাশমাত্র মিলিয়ে যাবে না। বরং সবার হৃদয়কে দীর্ঘ সময়ের জন্য নাড়া দিয়ে যাবে। সুন্দর মনের প্রকাশ ঘটে আচরণে ও ভাষায়। সে প্রসঙ্গে একটু পরেই বলি।
আপনি কোন সাজপোশাকে কোথায় সুন্দর? সর্বত্র এবং সব সময় একই সাজে যে হাজির হওয়া যায় না, তা নিশ্চিতভাবেই সবার জানা। প্রতিদিন একই পোশাক তো পরা যায় না। আর বিশেষ দিনগুলোর প্রতি সম্মান জানানোর প্রধান একটি উপায় হলো আপনার পরিধেয় এবং তাতেই দিনটি স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। যেমন, ভাষা শহীদ দিবসে আমরা প্রাত্যহিক বা অন্যান্য আনুষ্ঠানিক পোশাকে বের হবো না। এত কথা বলার একটিই কারণ, সৌন্দর্য যেমন সামগ্রিক একটি ব্যাপার, তেমনি খন্ড খন্ড রূপে বিভিন্ন জায়গায় এর বিচিত্র অবস্থান, গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদন। এমনকি ব্যক্তিভেদে এর ভিন্নতা অবধারিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এর সমগ্রতা নিয়ে আমরা যত কথা ভাবি ও বলি- যথাযথ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আমরা কি ততটা মনোযোগী? যেমন ধরুন, কোনো দিবসে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে কিংবা কর্মস্থলে আমরা উপযোগমাফিক সাজপোশাকেই হাজির হই। কিন্তু আমাদের আচরণেও যে সুন্দর হওয়া দরকার এবং ব্যক্তি, সময় ও স্থানভেদে তা ভিন্ন হবে, সেই চর্চাও তো জরুরি। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ব্লুমফিল্ড আচরণকে ভাষার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। বলেছেন, আচরণ হচ্ছে ‘অশ্রুত উক্তি’, যা কেবল মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগে সাহায্য করে না, তার অবস্থা এবং কোন পরিবেশে রয়েছে, তা-ও নির্দেশ করে। অধিকন্তু আচরণ বুঝিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে আপনি কেমন আর কোন পরিবেশে বিকশিত হয়েছেন এবং অবস্থান করছেন। বলতে চাইছি, যত সাজগোজ করি না কেন, আমাদের আচরণও হতে হবে সুন্দর। এটি পরিবারে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে আপনার গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন, নিজের কাছে যেমন, তেমনি অন্যদের কাছে সুন্দর হলেই আপনি সুন্দর।
এ তো গেল ‘অশ্রুত উক্তি’র প্রসঙ্গ। শ্রুত উক্তিও হওয়া চাই সুন্দর। তাতে বিনয়, মহত্ত্ব, শিক্ষা, অন্তত শোভনতার প্রকাশ বেশি জরুরি। দেখতে যেমন সুন্দর হতে হয় আমাদের, তেমনি শুনতেও সে রকম হওয়া প্রয়োজন। অন্যরা যেন আপনার সঙ্গে আলাপ করতে পারে, সদ্য পরিচিত কারও যেন আপনাকে এড়িয়ে যেতে না হয়। সে জন্য ভালো শ্রোতাও হতে হবে। অনেকে কথার শুরুতে নিজের আভিজাত্য, সম্পদ, ক্ষমতা ইত্যাদির গল্প জুড়ে দেন। কিংবা পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেন, গর্ব করার মতো তার অনেক কিছু আছে। কিন্তু যিনি শুনছেন, তার কাছে ব্যাপারটি হাস্যকর কিংবা অর্থহীন মনে হতে পারে। অনেকেই এতে অস্বস্তি বোধ করেন, যদিও ভদ্রতাবশত অপ্রীতিকর কিছু বলেন না। এমন নয় যে সমাজের কেউ কারও সাফল্যের গল্প শুনতে চান না। বরং বেশির ভাগ মানুষ আনন্দ বোধ করেন পরিচিত বা ঘনিষ্ঠ কারও সফলতা সম্পর্কে জানতে পারলে। কিন্তু মানবজীবনের অর্জন এমন এক জিনিস, যার সৌরভ আপনাআপনিই ছড়িয়ে পড়ে।
কেউ কারও সঙ্গে যখন কথা বলে, তখন সে কিছু শিখে নেয় নিজের অজান্তেই। ভালো ও সুন্দর কিছু শিখতে পারলে সমাজেরই লাভ। উল্টোটি ঘটলে ক্ষতি। এমনকি আপনার বাচনভঙ্গি, শুদ্ধ উচ্চারণ, শব্দচয়ন, স্বরের প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক ওঠানামা, তাকানো, অভিব্যক্তি- এসব থেকে শেখার ও উপলব্ধির বহু কিছু আছে। অনেকেই ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না, আড়ষ্টতায় ভোগেন, বাগ্যন্ত্রের সমস্যাবশত কারও মুখোমুখি হতে চান না বা কোথাও গেলে চুপ করে থাকেন। আমি বলি, ‘মানুষ’ শব্দটির মধ্যে অসীম সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। গ্রিক দার্শনিক মেগাস্থিনিসের কথা তো জানেন। কিছুই বলতে পারতেন না তোতলামির কারণে; প্রবল নিষ্ঠা, অনুশীলন ও আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন তখনকার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বক্তা। আমাদের কাউকে মেগাস্থিনিস হতে হবে না; কিন্তু এই দৃষ্টান্তের শিক্ষা আমরা নিতে পারি।
শ্রুত আর অশ্রুত উক্তির সৌন্দর্য যুক্ত হোক আপনার সুন্দর হয়ে ওঠার অনুশীলনে। দেখবেন, জীবন বিপুল ঐশ্বর্যে ভরা। পৃথিবী বড় সুখকর।