স্মরণ I ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন
কার্ল লেগারফেল্ডকে পরিচিত করানো ধৃষ্টতার শামিল। বরং তাঁর মৃত্যু ধ্রুবতারা খসে পড়ার নামান্তর। একলব্যের নিবিষ্টতায় অনুসরণ করা এই ফ্যাশন আইকনকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণের প্রয়াস পেয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান
বৈশ্বিক ফ্যাশনে ভগবান কয়জন? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক। কারণ, এঁদের কেউ কেউ ফরাসি আবার কেউ কেউ পারিতে অভিবাসিত। অন্য দেশ থেকে এসে নিজের ভাগ্য গড়ে নেওয়া, প্যারিসের জল-হাওয়ায় অভিযোজিত হয়ে ফ্যাশন ভূম-লের ঈশ্বরে উন্নীত করাদের সংখ্যাও এ ক্ষেত্রে কম নয়। তবে ২০০৮ সালের ১ জুন বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছিল এমনই এক ঈশ্বরের প্রস্থানে। কেঁদেছিল পারি। কেঁদেছিল আবিশ্ব। এরপর গুনে গুনে ঠিক ১০ বছর ৬ মাস ১৮ দিন বাদে ফেব্রুয়ারির উনিশে মহাবিশ্বের, মহাকাশ ছাড়ি মহাকালের অতিথি হলেন আরেক ঈশ্বর। আবারও রোরুদ্যমান হলো পারি ও বিশ্ব। দশককাল আগে সামাজিক মাধ্যম ছিল না বলে শোকের ঢল হৃদয়ে নেমেছিল। আর আজ নেমেছে অন্তর্জালে।
যে দুজনের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছি তাঁরা উভয়েই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। প্রথমজনের বাবা আলজেরিয়ায় ওকালতি আর বিমার দালালি করে যথেষ্ট বিত্তশালী। দ্বিতীয়জনের বাবা জার্মানিতে প্রথম কনডেন্সড মিল্ক আমদানি করে অর্থশালী। তাই দারিদ্র্য তাঁদের কখনো পিছু নেয়নি; বরং বেড়ে ওঠার পথ ছিল কুসুম বিছানো। প্রথমজন, তখন মাত্র ১৭, পারিতে পা রেখেছিলেন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়া থেকে। মায়ের হাত ধরে। আর দ্বিতীয়জন, সদ্য ১৩, বাবা ও মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে জার্মানির হামবুর্গ থেকে একা এসে মিশে গিয়েছিলেন প্যারিসের জনারণ্যে। তবে তাঁদের আগমন একই বছরে নয়।
নতুন শহরে অভিবাসীজীবনকে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগেছে বৈকি। মাত্র ৩ বছরের বয়স-ব্যবধানের দুই কিশোরের (প্রথমজন ছোট, পরেরজন বড়) প্রতিভা স্ফুরণে ততটা সময় লাগেনি। এরই মধ্যে অর্থাৎ সেই ১৯৫৪ সালে উভয়ে একে অন্যের পরিচিত হয়ে উঠেছেন কি না তা অজ্ঞাত। তবে সালটা স্মরণীয় দুজনের জন্য, ফ্যাশনবিশ্বের জন্যও বটে। অভিন্ন মঞ্চে উপস্থিত করিয়ে ছাড়ে তাঁদের ভবিতব্য।
প্যারিসের সম্মানজনক ইন্টারন্যাশনাল উল সেক্রেটারিয়েট প্রতিযোগিতার ড্রেস ক্যাটাগরিতে প্রথম হন প্রথমজন। আর কোট ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়ে সম্মানিত হন দ্বিতীয়জন। উভয়ের ঈশ্বর হয়ে ওঠার সেই শুরু। পরবর্তী সময়ে ফ্যাশনবিশ্বের শাসকে পরিণত হওয়ার সেটা ছিল আভাসমাত্র। প্রথম তখন ১৮। দ্বিতীয় ২১। এরপর উভয়েই হয়ে উঠলেন দুরন্ত বন্ধু, ক্ষুরধার প্রতিপক্ষ আর কালক্রমে ধুন্ধুমার শত্রু। বৈরিতার কারণ এক বয়ফ্রেন্ড (জাক ডি বাশার, পরে যিনি এইডসে মারা যান); যিনি প্রথমকে ছেড়ে দ্বিতীয়র সঙ্গী হন।
প্রথম যৌবনেই সাফল্যস্বাদ, খ্যাতি আর বৈভব সঙ্গী হয় উভয়ের। বৈশ্বিক ফ্যাশন নিয়মিত মাত্রাময়তায় প্রোজ্জ্বল হতে থাকে। তবে প্রথম বলগাহীন; অনিঃশেষ আকর্ষণ তার খ্যাতি, গরিমা আর নান্দনিকতায়; অপরিমেয় প্রতিভায় পৃথিবী শাসন করলেও ভেসেছেন নেশার ভেলায়। কাতর হয়েছেন নিঃসঙ্গতা আর বিরহযন্ত্রণায়। তাই তো ২০০২ সালে কাজ বন্ধ করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিদায়ের ক্ষণগণনা শুরু করেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় স্থিতধী, প্রত্যয়দৃঢ়। আত্মমর্যাদা আর অর্থের প্রতি যত্নশীল। কাজ করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
কারও শোকযাত্রায় কিংবা শেষকৃত্যে দ্বিতীয়কে দেখা যায় না; যায়নি কখনো (ব্যতিক্রম জাকের বেলায়)। প্রথমের মৃত্যুতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে একদা প্রিয় বন্ধুর, সমান্তরালে অস্তিত্ব জানান দেওয়া এক অসামান্য শিল্পীর জন্য নিশ্চয় নিভৃতে হৃদয়ে রক্তরক্ষণ হয়েছে দ্বিতীয়র। এ ক্ষেত্রে প্রথমকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। কারণ, অনেকেই হয়তো বিমূঢ় হবেন। হবেন শোকস্তব্ধ। কিন্তু বন্ধুবিয়োগের ব্যথা সেভাবে অনুভবের কেউ কি থাকল দ্বিতীয়র মৃত্যুতে!
পাঠক হয়তো এতক্ষণ পড়ে কেবল হেঁয়ালি ভেবে আমাকে শাপান্ত করছেন। কেউবা ধরতে পেরেছেন কাদের নিয়ে তুলনা করা হচ্ছে। আবার এ-ও ভাবছেন, কীই-বা প্রয়োজন এই তুল্যের। বস্তুত একজনকে বুঝতে হলে আরেকজনের উপস্থিতি যে বড় প্রয়োজন। তা সে সৃজনেই হোক বা সম্পর্কে কিংবা মৃত্যুতে।
প্রথম ও দ্বিতীয় উভয়েই কিংবদন্তি। ট্রেন্ডসেটার এবং ঈশ্বর। ওয়াইএসএল আর কেএল। ইভস সাঁ লোর আর কার্ল লেগারফেল্ড। একজন আলজেরিয়ান, অন্যজন জার্মান। সমান্তরালে বহমান দুটি সত্তা। অতুল্য, অনন্যসাধারণ, অমোছনীয়, অনুপেক্ষণীয়।
আপাতত আর তুলনা নয়; বরং আজ কেএলের সঙ্গেই না হয় পায়চারি করা যাক স্মরণের বালুকাবেলায়।
সেই চুয়ান্নয়, উদ্ভিন্ন যৌবনে দারুণ এক স্বীকৃতি সত্ত্বেও পাদপ্রদীপের আলো খুঁজে পেতে সময় লেগেছে তরুণ কার্লের। ১৯৫৫ সালে যোগ দিলেন বালমেঁতে। তিন বছর এই বিশ্বনন্দিত ফ্যাশন ব্র্যান্ডেই হাত মকশো করলেন। আটান্নয় যোগদান জঁ পাতোতে। ১০টি কতুর কালেকশন করেন এই হাউজের হয়ে। এরপর রোমের হাউজ তিজিয়ানোর সঙ্গে অল্প কিছুদিন কাটিয়ে হয়ে গেলেন মুক্তবিহঙ্গ। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করলেন ক্লোয়িতে। সেটা ১৯৬৪ সাল। পরের বছর কুরিয়েলে কয়েক মাস কাটিয়ে চলে যান ফেন্দিতে। শুরু কোলাবোরেশনের। এরই মধ্যে সময় গড়িয়েছে বেশ কিছুটা। ১৯৮২ সালে শ্যানেল চেয়ারম্যান এলেইন ওয়েরথেইমার কার্লকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দিলে অনেকে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন ওটা মৃত, ছুঁয়ো না; অকপটে সেকথা জানিয়েছিলেনও টাইম ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছিলেন। কারণ, জিয়নকাঠিটা তো তাঁর হাতেই ছিল। সেই জাদুস্পর্শেই প্রাণ পেল শ্যানেল। বাকিটা ইতিহাস। গত সেপ্টেম্বরেও সংগ্রহ উপস্থাপন করেছেন। আর শেষবারের মতো রানওয়েতে উপস্থিত হয়েছেন ফ্যাশন-দুনিয়ার অবিসংবাদিত কাইজার কার্ল। তত দিনে পুনরায় শ্মশ্রু-গুম্ফমন্ডিত হয়েছেন। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো। প্রথমবার মধ্যযৌবনে, সত্তর দশকে। তখন ছিল কালো। আর এবার সফেদ। অবশ্য অবিকল ছিল সেই ট্রেডমার্ক পনিটেইল, কালো আঙুলখোলা গ্লাভস; তবে কালো সানগ্লাস নয়, কালো চশমা। আর কালো পোশাক। তখনই তাঁকে অশক্ত ঠাহর হয়েছে। জানুয়ারিতে প্যারিসে ওত কতুর শোতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তাঁর পক্ষে রানওয়েতে ছিলেন ৩০ বছর ধরে কার্লের ডানহাত হয়ে থাকা ভার্জিনি ভিয়ার্দ। এরই মধ্যে যাঁকে কার্লের শূন্যস্থান পূরণের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্যানেল কর্তৃপক্ষ।
নিজের নাম একদিন কোনো দোকানের ওপর জ্বলজ্বল করবে- এমন ইচ্ছা কখনো পোষণ করেননি কার্ল। ভোগ সাময়িকীকে ১৯৮৪ সালে কার্ল একথা যখন বলেন, তখন সেটা বাস্তব। ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তাঁর নেমেসিস। যদিও বেশি দিন নিজের কাছে রাখেননি সেই অধিকার। টমি হিলফিগারকে বেচে দেন ২০০৫ সালে।
বৈভবের মধ্যে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও কার্ল নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নিয়েছেন। ডিজাইন থেকে লাইসেন্স নেওয়া, ব্যবস্থাপনা থেকে আর্থিক বিষয়াদি মায় বিজ্ঞাপন নির্মাণ- একা হাতেই সামলেছেন। আর প্রতিবছর এরই মাঝে ৮টি করে সংগ্রহ উপহার দিয়েছেন বিশ্বের ফ্যাশনপ্রিয়দের। কাজ করতেন প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা। রাজকুমারী থেকে হলিউডের ডানাকাটা পরী, উচ্চকোটির সুন্দরী থেকে ফ্যাশন কনোসিওর, সুপারমডেল থেকে বিশিষ্ট উদ্যোক্তা- ফিদা থেকেছেন কার্লের সৃষ্টিতে।
ভুবনভরা আলোর রোশনাই সত্ত্বেও, ভেসে যাননি কখনোই অপরিমেয় বিত্তের স্রোতে। ছুঁয়ে দেখেননি সুরাপাত্র আর সিগার; বাছবিচারহীন সংসর্গের গড্ডলিকায় সমর্পণ করেননি। বরং অবিচল কার্ল নিজেকে পরিণত করেছেন কাল্টে। হয়েছেন আইকন। তাই তো কার্লের কালেকশন মানে আর কেউ যা করেননি। উপস্থাপনা কল্পনাকে হার মানায়। ভারতে না গিয়েও ভারতকে নিয়ে প্যারিস টু মুম্বাই এর অন্যতম নজির। বছরের ফ্যাশন উইকগুলো বাদ দিলেও শ্যানেলের বার্ষিক আয়োজন দেখার জন্য প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকতেন সারা বিশ্বের ফ্যাশন-অনুরাগীরা। কেবল পোশাক নয়, উপস্থাপনা আর মঞ্চ- সব মিলিয়ে সৃষ্টির চূড়ান্ত। প্রতিবার ঈশ্বর যেন আবির্ভূত নতুনতর রূপে। তাই তো ভোগ সম্পাদক অ্যানা উইনটর তাঁকে আখ্যায়িত করতেই পারেন ফ্যাশনবিশ্বের বামনদের মধ্যে দৈত্য হিসেবে।
তবে বন্ধুর মতো বিরহ তাঁকেও কি আবিষ্ট করেনি! নিঃসঙ্গতার অন্তর্লীন যন্ত্রণা তাঁকে কাতর করেনি! সেটা তাঁর থেকে আর কেই-বা ভালো বলতে পারবেন। প্যারিসে তিনি থেকেছেন একা। অবশ্য একা নয়, সঙ্গী হিসেবে ছিল তাঁর বিড়াল শুপেত। তাকে দিয়ে গেছেন অর্জিত সম্পদের বেশ খানিকটা। পরিমাণ আমাদের চোখ কপালে তোলার জন্য যথেষ্ট। অন্ত্রে বাসা বেঁধে ছিল কর্কট বীজ। সে-ই অতঃপর হন্তারক হয়ে গেল। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ভর্তি করা হয় প্যারিসের একটি হাসপাতালে। কিন্তু প্রস্থানের অমোঘ আহ্বানকে আর উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি কাইজার কার্লের পক্ষে। ফলে পঁচাশিতে জীবন থেকে প্রত্যাহার করে নিলেন নিজেকে। হয়তো এই ভেবে যে: আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
পুনশ্চ: বিশিষ্ট ভারতীয় নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্রের ‘নরক গুলজার নাটকে তাঁরই লেখা স্যাটায়ারধর্মী গান থেকে ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে শিরোনামের তিনটি শব্দ। সদর্থেই কার্ল লেগারফেল্ডের মৃত্যু ভগবানের তিরোহিত হওয়ারই সমার্থক।
ছবি: ইন্টারনেট