ফরহিম I দ্য সফট কিং এরা
চোখের কোণে তারার মতো ঝিলিমিলি, কোনাচে আইব্রাও, মেয়েলি বলে ব্যঙ্গ করলেও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই; পুরুষত্বের নিত্যনতুন সংজ্ঞা লিখছে কে-পপ ম্যান। বিস্তারিত বিদিশা শরাফের লেখায়
পুরুষত্বের সংজ্ঞায় এ যেন নতুন এক আপডেট। পুরুষদের কর্কশতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তেই যেন আবির্ভাব এই কে-পপ আইডলদের। স্কিন কেয়ার, হেয়ার রিমুভাল, মেকআপ, অ্যাসথেটিক—এসব ক্ষেত্রে ছিল নারীদের রাজত্ব; আর পুরুষদের সৌন্দর্যের সীমাবদ্ধতা ছিল আফটার শেভ, হেয়ার জেল এবং ভালো একটি বডি ওয়াশ কিংবা পারফিউমে। ম্যাসকুলিন থাকা মানেই নিজেকে নিজের মতো মেনে নেওয়া—এমন ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে পুরো কে-পপ ইন্ডাস্ট্রি। সৌন্দর্যের টেক্সটবুককে শিকেয় তুলে, কাগজে-কলমে নয়, প্রতিটি পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্সে মেনজ গাইড টু বিউটির নতুন ধ্যানধারণা গড়ছেন কে-পপ আইডলরা। আইলাইনার, লিপস্টিক নিয়ে কটাক্ষের সুযোগ নেই; বিষয়টি এর চেয়ে বেশ জটিল। স্নিগ্ধ শব্দের মৌলিক অধিকারী শুধু নারীরাই হবেন, তা ভাবার অবকাশ নেই। পিরিয়ড ড্রামা, স্টেজে কে-পপ স্টারদের ফ্যানডম দেখলে নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে, পুরুষদের মাঝেও স্নিগ্ধতার দেখা মিলতে পারে। শিমারি চোখ, রিবন্ডিং করা চুল, টান টান করে পরা কাপড়—পুরোটা দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো গ্রিক দেবতার প্রতিচ্ছবি; এমন করেও পুরুষালি সৌন্দর্য তুলে ধরা সম্ভব!
মেকআপ শুধু সৌন্দর্যের অংশ নয়; আত্মপ্রকাশের সুযোগ করা যায় এর মাধ্যমে। বৈশ্বিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ, সামাজিক বিষয়ে নিজ অভিমত উপস্থাপন, স্টোরিটেলিংয়ের সঙ্গেও জড়িত থাকে মেকআপ। এর প্রয়োগ বাড়ায় আত্মবিশ্বাস; আর তা কোনো একটি নির্দিষ্ট লৈঙ্গিক পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নিশ্চয় কখনো হতে পারে না?
লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের বাইরেও একটি জগৎ আছে, যে জগতে পুরুষেরা দৈনন্দিন কাজে বের হন, ডেটিংয়ে যান কিংবা নিজের সঙ্গে সময় কাটান। প্রচলিত প্রথার ঊর্ধ্বে গিয়ে পুরুষদের কাজ শুধু অর্থ উপার্জনে সীমাবদ্ধ না; বরং এর পরিধি ছড়িয়েছে তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্যের সচেতনতায়। বিনোদনের জগৎ থেকে দূরে, নিজের যত্ন নেওয়া সম্ভব—এই ধারণাকেই প্রতিনিয়ত প্রমাণ করছেন কে-পপ আইডলরা। তামাটে রং, রোদে পোড়া আনইভেন স্কিন টোন, ফ্রেকেলস ত্বক থাকা মানেই ভাবা হতো এই পুরুষ বুঝি কর্মঠ, ব্যক্তিত্ববান; সেই আন্দাজের দিনও শেষ! কে-পপ আইডলরা যদি কোনো শ্যাম্পু বা ডিওডোরেন্টের নাম উচ্চারণ করেন, সেই প্রোডাক্টের প্রমোশনের প্রয়োজন হয় না খুব একটা; স্টকআউট হয়ে যায় বিনা পরিশ্রমেই। স্টেডিয়াম কিংবা স্ক্রিন ফ্যান ফলোয়াররা জানতে পারলেই হলো, অক্ষরে অক্ষরে মানা চাই আইডলদের নির্দেশনা।
আইডলদের পরিধি কি স্ক্রিন, বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ডেই সীমাবদ্ধ? না। লিভিং অ্যাডভারটাইজমেন্ট হিসেবে কে-পপ আইডলরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন চারপাশে। কখনো গুচির জ্যাকেট গায়ে, কিংবা লুই ভিতোঁর মাফলারে নিজেরাই বনে যাচ্ছেন লাক্সারি ব্র্যান্ড। কে-পপ তারকা হিউনজিন, স্ট্রে কিডসের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছেন ঠিকই; তবে এই খ্যাতিকে আরও বাড়িয়েছে ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্ট। শুধুই কি ভারসাচির ফ্যাশন শোতে প্রথম সারিতে বসার জন্য গ্লোবাল স্টার বনেছেন তিনি? ব্র্যান্ডের প্রতি তার ভালোবাসার ছবি ফুটে উঠেছে চুলে ভারসাচি সংবলিত রঙের খেলায়। শুধু তা-ই নয়; চোখ, নখ, এমনকি পোশাকের মাধ্যমে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন একজন চলমান ভারসাচি ম্যান! একই পথে হেঁটেছেন বিটিএসের জিন, স্ট্রে কিডসের আরেক তারকা ফেলিক্স প্রমুখ।
বলিউডে যেখানে যেকোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন নারীর আবেদনশীলতা ছাড়া ভাবা প্রায় সম্ভব হয় না; সেখানেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কে-পপ দেখিয়েছে, পুরুষদের পক্ষেও সম্ভব নিজের সৌন্দর্যের মাধ্যমে গ্রাহকের নজরকাড়া। পুরুষত্বের কড়া ব্যবহার নয়; বরং কত সাবলীলভাবে নিজেদের ব্র্যান্ড প্লেসমেন্ট ফুটিয়ে তোলা যায়, তা নিয়ে ব্র্যান্ডগুলোও নতুন করে ভাবছে।
কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিতে যেন হাহাকার নেই সৌন্দর্যের। একে অন্যের প্রশংসায় মুখর; তবু নিজেকে ভেঙে ভেঙে নতুন করে গড়ছেন তারকারা। ২০২৫ সালের শুরু থেকে শেষে, শুধু স্টেজেই রচনা করেছেন সৌন্দর্যের ব্যঞ্জনা। এ বছর গুঞ্জনের শীর্ষে থেকেছে কে-পপ ডেমন হান্টার্স। বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, তবু দর্শকের মনে নিজেদের ছাপ খুব সন্তর্পণে রেখেছে ডেমন হান্টার্সের ফিকশনাল চরিত্রগুলো। এর মধ্য দিয়ে সাজা বয়েজের লিডার জিনু নিজের শক্ত জায়গা করেছেন দর্শকদের মনে। উচ্চতার জন্য স্টেজে যাকে ইগনোর করা অসম্ভব, সেই মিনো সব কে-পপ মডেলকে পেছনে ফেলে দেবেন তার মনোমুগ্ধকর কারিশমা দিয়ে, এতে অবাক হওয়ার কী আছে! স্টেজের বাইরেও নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক একইভাবে ধরে রাখেন তিনি। ফ্যানদের মনে তাই গুডবয় চরিত্রটিও থাকে বহাল।
নিজেদের সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার এই তালিকায় চা ইউন সোর নাম বাদ দেওয়া যায় না কোনোভাবেই। শান্ত স্বভাবের অধিকারী এই তারকা নিজেকে সব সময় রাখেন আপাদমস্তক ফিটফাট। কমনীয়তাও যে পুরুষত্বের অংশ হতে পারে, তার পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্সে সে কথার প্রমাণ পাওয়া যায় বারবার। ২০২৫ সালের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম কে-পপ আইডল হিসেবে শীর্ষে আছেন বিটিএসের ভি। নিজের কোমল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে বাকি গুণাবলিকেও প্রতিনিয়ত করেছেন আরও ধারালো। সৃষ্টিশীলতা, সংগীতচর্চায় তুখোড়তা—সব মিলিয়ে ভক্তদের মনের শীর্ষ অবস্থানে ভি রয়েছেন এ বছরও।
গ্লো-বয় এরা টিপস
টিন্টেড বাম বা গ্লসি ঠোঁটে শাইনি লুক দেওয়া যেতে পারে;
হালকা ব্লাশ কিংবা ব্রোঞ্জারে গালে রাখা যায় ট্যানড ভাইব;
চোখে শিমার, হালকা কাজল, স্মাজ অথবা আর্দি ব্রাউনই জুতসই। একটু বাড়াবাড়ি করতে চাইলে রঙিন কোনো আইশ্যাডো সই;
চুলের ক্ষেত্রে বেসিক কিংবা ব্রোঞ্জ রং যথেষ্ট;
ড্রামাটিক কিছু চাইলে হেয়ার কালার স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন।
লাইভ, স্টেজ, রিয়েল লাইফ—সব জায়গায় বদলেছে আইডলদের প্রতি ভক্তদের ধ্যানধারণা। এনহাইপেনের সুনু ডিউই ব্লাশকে বানিয়েছেন বৈশ্বিক আলোচনার বিষয়বস্তু। স্মোকি আইলাইনার যে পুরুষদের চোখে আবেদনজাগানিয়া লাগতে পারে, তা বুঝিয়েছেন আটিজ ব্যান্ডের সান। সাদা চুল, ফ্রেকেলস আর বড় চশমায় দর্শকদের মন কেড়েছেন স্ট্রে কিডসের ফেলিক্স। কমনীয়তায় যে পুরুষত্ব আরও উদ্ভাসিত হয়, তা নিজেদের হাবভাবে বুঝিয়েছেন কে-পপ আইডলরা।
ভক্তদের জন্য কেবল পোশাক নয়; ব্যক্তিত্বও হওয়া চাই অনুকরণীয়। সৌন্দর্য মানে অভিব্যক্তি, আর তার প্রকাশ ফুটে ওঠে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে। কে-পপ আইডলরা সেই বার্তাই ছড়াতে চান বিশ্বজুড়ে।
মডেল: আজরাফ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল
