অর্গানিক I রূপযোগে সাবেকিয়ানা
নানি-দাদিদের আমলের সিক্রেট সৌন্দর্যচর্চা। এ যুগেও চর্চিত হতে পারে এই ম্যাজিক রিক্রিয়েট। হালের কনেদের জন্য
নানি-দাদিদের গল্পে কিংবা সেকেলে সাদাকালো অ্যালবামের পাতা ওলটালেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মস্ত উঠানসমেত বাগানঘেরা ঘরবাড়ি। দুপুর গড়াতেই যেখানে বাড়ির মেয়ে-বউ, মা-খালারা আয়েশি আড্ডায় মশগুল। সংসারের টুকিটাকি কাজের ফাঁকে নিয়মিত রূপটান। কখনো লাইন বেঁধে বসে একে অপরের চুলে সুগন্ধি তেল মেখে বিনুনি বাঁধতে ব্যস্ত, কখনোবা গোসলের আগে গায়ে সর-ময়দার মিশ্রণ মেখে পরিচর্যার পালা। বিয়েবাড়ির দৃশ্যপটেও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আটপৌরে শাড়ি মোড়ানো, চোখে টানা কাজল, মুখে কুমকুমের প্রলেপ, পায়ে আলতা পরা কোনো সাবেকি বাড়ির কনে। তেল, মধু, গোলাপজল, দুধের সরের মতো একদম ঘরোয়া উপাদানেই তখন সারা হতো বিশেষ রূপচর্চা। তাতেই একেকজন হয়ে উঠতেন পেলব ত্বক, মসৃণ তনু আর রেশম ঘন চুলের নারী। তাদের সৌন্দর্য বর্ণনায় কত যে বিশেষণের ব্যবহার ছিল! রূপসী বলতেই তিলোত্তমা। গায়ের রঙের বর্ণনায় দুধে-আলতা, চুলের জন্য দীঘল কালো আর চোখের বয়ানে পটোলচেরা। আজও টিকে আছে নানি-দাদির সৌন্দর্যের সেই গল্প। এ ছাড়া বিয়েবাড়িতে হঠাৎ যখন কেউ বলে ওঠেন, ‘বউয়ের গায়ের রঙটা ঠিক আমার দাদির মতো’ কিংবা বিয়ের আগে মাসখানেকের বিউটি প্যাকেজ নেওয়া, নিয়মিত পার্লারে চক্কর কাটা কনের মুখেও যখন আফসোস- ‘নানির মতো ত্বক আর হলো কই!’ তখন সেকেলে রূপচর্চার কৌতূহলী হওয়াটাই এখনো স্বাভাবিক।
ত্বককল্পে
তখনকার দিনে নানি-দাদিরা কিন্তু অষ্টপ্রহর রূপচর্চার উপকরণ সঙ্গে নিয়ে বসে থাকতেন না। ছিল না ঝাঁ-চকচকে বিউটি স্যালনের হাতছানিও। রূপচর্চা চলত সকাল বা দুপুরের গোসলের আগে। উপকরণ হিসেবে থাকত তেল। সরিষার তেল ও নারকেল তেল- দুটোই চলত। সর, ময়দা আর দুধের মিশ্রণ সারা মুখে আর হাতে-পায়ে মাখা হতো। শুকিয়ে গেলে আলতো হাতে ঘষে তুলে, পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলাই ছিল রীতি। রূপচর্চায় দারুণ জনপ্রিয় ছিল মধু। মিহি করে বাটা কমলালেবুর খোসার সঙ্গে এটা মিশিয়ে তৈরি হতো পরিচর্যার উপকরণ। ত্বক উজ্জ্বল করতে যা ছিল জাদুকরি। এটা চলত শীতকালে। আর গরমকালের জন্য সর-মধু। হলুদ ব্যবহৃত হতো বিশেষ উপলক্ষের জন্য প্রস্তুতির সময়। কাঞ্চনবর্ণ রঙ পেতে কাঁচা হলুদ, দুধ, সর, ময়দা মিশিয়ে কনের সারা গায়ে মাখিয়ে রাখার চল ছিল। শুকিয়ে গেলে পানি দিয়ে ধুয়ে নেওয়া হতো। এই পুরো পরিচর্যায় সময় লাগত দেড়-দুই ঘণ্টা। বেসন আর দইয়ের সঙ্গে হলুদ মিশিয়েও তৈরি হতো প্যাক। দাগছোপ থেকে বলিরেখা সারাতে। রোদে পোড়া দাগ দূর করার জন্য হলুদের সঙ্গে মেশানো হতো বেসন আর দুধ। এ থেকে তৈরি পেস্ট মুখে মাখিয়ে রাখা হতো শুকানো পর্যন্ত। তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই দূর দাগ, ধুলো আর ময়লা। শুধু কি হলুদ! বেসন আর দুধে কখনো মেশানো হতো লেবুর রস আর বাদামবাটাও। এটাও ছিল ত্বক উজ্জ্বল করার দারুণ দাওয়াই। নতুন ধানের সময় তা থেকে করে নেওয়া চালের গুঁড়ায় শুধু পিঠাপুলি তৈরিই নয়, চলত ত্বকের পুরোদস্তুর পরিচর্যা। এর সঙ্গে সামান্য দুধ মিশিয়ে ব্যবহার করার চল ছিল। একে স্ক্রাবাবের সাবেকি রূপ বললে ভুল হবে না একদমই। হাত-পায়ের যত্নআত্তিও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে মেয়েদের হাত খুব শক্ত, তাদের লেবুর রস মাখার পরামর্শ দেওয়া হতো। পা ফাটার সমস্যায় নারকেল তেল গরম করে তাতে লেবুর রস মিশিয়ে মেখে নেওয়া হতো গোড়ালির চৌচির ত্বকে। পরে সর-ময়দার পেস্টের প্রলেপের পর ঝামা দিয়ে পরিষ্কার করে গ্লিসারিন মাখানো হতো। পেলব-মসৃণ পায়ের জন্য। আর বনেদি বাড়ির মেয়েরা ব্যবহার করত চন্দনবাটা। সংগৃহীত চন্দনকাঠ পাথরে ঘষে ঘষে তৈরি হতো এ পেস্ট। সেটি মুখত্বকে মেখে নেওয়ার চল তো ছিলই, মাঝেমধ্যে এতে মেশানো হতো দুধ। কখনো কখনো বাদামবাটা। চকচকে, দাগমুক্ত ত্বকের জন্য।
কেশকাব্যে
চুলচর্চায় তখন প্রকৃতিই ছিল ভরসা। নারকেল অথবা সরিষার নির্যাসে তৈরি খাঁটি তেলের নিয়মিত ব্যবহার ছিল নিয়ম। বিশেষ উপলক্ষে অবশ্য সুগন্ধ ছড়াত তেল। চুল উজ্জ্বল কিংবা কালো করতে, পড়া থেকে রক্ষায় এমনকি নতুন চুল গজাতেও তেলই ছিল মূল ভরসা। মাঝেমধ্যে তেলের বোতলে পুরে দেওয়া হতো জবা, দূর্বা, মেথি- আরও কত রকম ভেষজ। এগুলোর মিলিত রসায়নে আরও পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়ে উঠত মাথায় মাখার সাধারণ তেল। আর চুল পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত হতো রিঠা। তা সেদ্ধ করে ঘষে নিলেই প্রচুর ফেনা হয়। সেটাই করা হতো। এতে পরিষ্কারের পাশাপাশি চুল হয়ে উঠত কোমল, মসৃণ। ছিল আমলকীর ব্যবহার। তেলে ছেড়ে দেওয়া হতো আস্ত আমলকী। যা ব্যবহারে চুল হয়ে উঠত ঘন, কালো ও উজ্জ্বল। এ ছাড়া আমলকী রোদে শুকিয়ে, গুঁড়া করে ব্যবহারও জনপ্রিয় ছিল তখনকার নারীদের মধ্যে। এতে মেশানো হতো লেবু। চুল পড়া কমানোর পাশাপাশি খুশকি রোধেও দারুণ সহায়ক ছিল এ প্যাক।
বলে রাখা দরকার, আজকাল সৌন্দর্যচর্চায় সাবেকিয়ানার যোগ মামুলি মনে হতে পারে, কিন্তু কার্যকারিতা বিবেচনায় রূপচর্চার রুটিনকে সমৃদ্ধ করতে এগুলোর জুড়ি মেলা ভার।
জাহেরা শিরীন
মডেল: পিউলি
ওয়্যারড্রোব: মাহমুদা শাড়ি হাউজ
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন