রসনাবিলাস I মাটির ঘরে গ্রামের ভোজ
নিভৃত শহরতলিতে ভোজনের আয়োজন। সেখানে বাঙালির মৌলিক খাবারের সমাহার। অভিজ্ঞতার বয়ান দিয়েছেন
আল মারুফ রাসেল
গন্তব্যে নামতেই সিএনজিচালক বললেন, ‘আপনে মাটির ঘর আইবেন কইলেই তো হইত, পানজোরা কওনের কী দরকার?’ বুঝলাম, এই এলাকায় রেস্টুরেন্টখানা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শুধু এখানেই-বা কেন, সোশ্যাল মিডিয়াতেও মাটির ঘরের গুণগান। তাই গাজীপুরে হওয়া সত্ত্বেও এই রেস্টুরেন্টে প্রতি সপ্তাহান্তেই রীতিমতো মেলা বসে যায়। খানাতল্লাশি করতেই এবারের যাত্রা পানজোরা গ্রামে।
কাঞ্চন ব্রিজ থেকে ঢাকা নগর বাইপাস দিয়ে খানিকটা এগোলে এই রেস্টুরেন্ট। মূল সড়কের ধারেই। গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই ছনে ঢাকা গোল ছাউনি। এক পাশে পার্কিং লট। সেটা পেরিয়ে সোজা এগোলে রসাতল- রেস্টুরেন্টেরই একটা ছোট্ট অংশ, সেখানে কেবল পানীয়ের আয়োজন। কয়েক পদের চা, জুস আর কফি মেলে। বাকিটুকু মূল রেস্টুরেন্টের মাটির চুলার কারবার। বসার ব্যবস্থা রয়েছে দুটো কাঠের বেঞ্চিতে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেস্টুরেন্টের কর্ণধার বিপ্লব আকন্দ জানালেন আদ্যোপান্ত।
বললেন, এটার নাম আর বৈশিষ্ট্য পুরোটাই অন্যদের অবদান। মূলত এটা ছিল তার দাদার বাড়ি, সেখানে কিছু একটা করতে হবে, সেটাই ছিল মূল পরিকল্পনা। কিন্তু কী হবে, সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর বেরোল আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার ভাবনা। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, কাজ করে খাওয়া শিশুরা হবে সেখানের শিক্ষার্থী। তবে এ যুগে এখানে তো গৌরী সেন নেই, তাই রেস্টুরেন্ট থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই হবে সেই স্বপ্নের স্কুল। আর মাটির ঘরের ব্যাপারটা পুরোটাই নিজের শখের। মাটির বাড়ি তৈরির ঘরামিরা হারিয়ে যাচ্ছে শহুরে ভবনের আগ্রাসনে। তাই মাটির বাড়ি টিকিয়ে রাখার জন্যই এমনটা করা। ঘরামি খুঁজে এনে, আলো-বাতাসের জন্য বড় জানালার এক ঘর তৈরি করালেন। তবে চ্যালেঞ্জ ছিল বড় গোল জানালা নির্মাণ নিয়েই, একে তো ঘরামিরা প্রায় ভুলতে বসেছেন আদি পেশা, তার ওপরে জানালার এই নিরীক্ষা। তবে সব ঝামেলা উতরে এখন মাটির ঘর রেস্টুরেন্ট সবার সামনে। মজার ব্যাপার হলো, শুরুতে কোনো নাম ছিল না। কেউ একজন গুগল ম্যাপে এই জায়গাটাকে মাটির ঘর রেস্টুরেন্ট নামে লোকেশন ট্যাগ করার পর থেকেই তা চালু হয়ে যায়। সেটাই চলছে এখনো। রেস্টুরেন্ট মূলত দুপুরের খাবারের জন্যই। রাতে ভোজনের ব্যবস্থাও করা হয়, আগে থেকে ফোন দিয়ে রাখলে। তবে দুপুরে গেলেও ফোনে রিজার্ভেশন রাখাটাই ভালো।
রেস্টুরেন্টের গল্প শোনার পুরোটা সময় আমাদের সঙ্গ দিয়েছে অজস্র ঝিঁঝি পোকা, লালী নামের এক বন্ধুবৎসল কুকুর, আর একটা বিড়াল। মজার ব্যাপার, এই জুটির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, একজন আরেকজনের গায়ে হেলান দিয়ে খানিক ন্যাপও নিল এই আলাপের ভেতরেই। এমন সময় দৃশ্যপটে আবির্ভাব এখানকার রসবতীর রাজা সুরত রঞ্জন চাকমার। দেশি আর পাহাড়ি খাবার নিয়ে আড্ডা হলো তার সঙ্গে। তখন বিপ্লব জানালেন, শুরুতে বিশুদ্ধ বাংলা খাবারের জন্য বাবুর্চিই পাওয়া যায়নি। যারাই এসেছে, রেঁধেছে, তারা আন্তর্জাতিক কুজিনের ছাপ ভুলতে পারেনি। শেষে এই সুরতদার রান্নাটাতেই মাটির ছোঁয়া মিলল খানিক।
রসাতলের ঠিক পাশেই খানিকটা খোলা জায়গা, সেখানে কিছু কাঠের বেঞ্চি আর হ্যামক রাখা। শেষ প্রান্তে একটা কুঁড়েঘর, ছনে ছাওয়া। পুরোটাজুড়ে গাছের সমারোহ। আম, কাঁঠাল, কামিনী, দাতিনা, বাঁশ, মানিপ্ল্যান্ট, সেনসেভেরিয়া, কচু, পাম, অর্কিডসহ আরও অনেক গাছে পোষা কবুতরের আনাগোনা। মাটির ঘরের দরজার ঠিক আগেই একটা ছোট্ট স্টলে রাখা হয়েছে হ্যান্ডপেইন্ট টি-শার্টসহ আশপাশের গ্রামের নারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হ্যান্ডিক্র্যাফট। পুরো এলাকা প্রায় তিন বিঘা হলেও রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কেবল একখানা টিনের চারচালা মাটির ঘর। ছোট্ট স্টল পেরিয়ে ঢুকলে প্রথমে পড়ে রসুইঘর। বেশ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। মূলত ভাজাভাজির কাজ হয় সেখানে। সেটা পেরিয়ে প্রবেশ করলে হাতের বামে সারি সারি খাবারের বাটি- মাটির তৈরি। সেগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে বাঁশের সরপোশ দিয়ে। তারপর কাউন্টার। সেখানে মাধবের মুরালি রাখা হয়েছে দুটো কাচের বয়ামে। এরপরেই আরেকটি দরজা, সেটা দিয়ে বের হলে হাত ধোয়ার বেসিন। বাকিটা অতিথিদের বসার জায়গা। প্রায় ৩৩ জন একসঙ্গে এখানে বসে খেতে পারেন। টেবিলগুলো সবই কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো, চেয়ারগুলো গাছের গুঁড়ি কেটে। বড় জানালা রয়েছে ৬টি, দুই প্রান্তে দুটো গোল জানালা, আর ভেন্টিলেশনের জন্য চারটি ছোট। মাথার ওপরে হারিকেন দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে ছোট ছোট অনেকগুলো ফ্যান, বাঁশের বর্গার সঙ্গে ঝোলানো। আর একদম শেষ প্রান্তে দুটো বাবুই পাখির বাসা। ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি আর চাপালি দিয়ে। টেবিলে মাটির জগ-গ্লাস রাখা, এমনকি খাবার পরিবেশনও করা হয় মাটির থালায়।
খাবারের কিছু ছবি তোলার পর যখন হ্যামকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছি নিজেকে, ঝিঁঝির ডাক, আম-কাঁঠালের ছায়ায়, ঘুম ঘুম একটা ভাব সবে এসেছে- তখনই চলে এলো দুপুরের খাবারের ডাক। মেকশিফট ম্যানেজার আর পুরোদস্তুর শিল্পী আবির (যিনি অপেক্ষায় আছেন স্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার) আপ্যায়নে এগিয়ে এলেন। বিরই চালের ভাত, কচুমালার চপ, ইলিশ মাছ ভর্তা, পুঁটি শুঁটকির সিঁদল, শিমবিচি দিয়ে দেশি মুরগি, বাটা মাছের পাতুরি, তেঁতুল টকে পঞ্চপদী ডাল আর শসা টমেটোর স্যালাড। প্রথমেই অ্যাপাটাইজার হিসেবে কচুমালার চপেই কামড় দিলাম, না জানা থাকলে অনায়াসে যেকোনো আমিষ বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে বেসনে ভাজা এই অতি সাধারণ সবজি। নেত্রকোনার দিকে নাকি এটা বেশ চলে। এরপর পুঁটি শুঁটকির সিঁদল। কাঁচা মরিচের ঝাঁজে অসাধারণ স্বাদ। এটাও উত্তরাঞ্চলের খাবার। ইলিশ মাছের ভর্তাটাও বেশ, এর আগে মাওয়া ঘাটে ইলিশ মাছের লেজ ও কাঁটা দিয়ে তৈরি ভর্তা খেলেও মাছের ভর্তা এই প্রথম। তবে আশার কথা, ইলিশের উমদা স্বাদই তার পরিচয়, তাই নির্ভয়ে খাওয়া যায়, আর তার সঙ্গে যদি যোগ হয় বাবুর্চির মুনশিয়ানা, তবে তো পোয়াবারো। সাধারণত বড় মাছের পাতুরিই খাওয়া হয় সব সময়, তবে কাঁটার আঘাত সহ্য হলে বাটা মাছের পাতুরিও অনবদ্য এক পদ হতে পারে ভাতের সঙ্গে। সবশেষে শিমের বিচি দিয়ে দেশি মুরগি। এই পদটা একটু আলাদা, তবে দারুণ। দেশি মুরগি শেষ কবে খাওয়া হয়েছে, তা রীতিমতো ক্যালেন্ডার দেখে বের করতে হয়। কারণ, ঢাকা শহরে দেশি মুরগির নামে যা বিকোয়, তা বাইরেরই। শিমের বিচি দিয়ে এর আগে শুঁটকি খেয়ে দেখা হয়েছে চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে। মুরগিতেও যে শিমের বিচি এমন দারুণ সঙ্গ দিতে পারে, তা কে জানত! এরপর ডাল দিয়ে খাওয়া শেষ করার পালা, তেঁতুলের টক আর নানা পদের ডাল মিলে অসাধারণ এই পদটাও। বিরই চালের ঝরঝরে ভাত খেয়ে মনে হলো, একটা ভাতঘুম দেওয়ার ব্যবস্থা হলে মন্দ হতো না! জানা গেল, যতটা সম্ভব প্রতিটি শস্যই প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা কি না, তা নিশ্চিত করে কেনা হয়।
ডেজার্টের জন্য পেটে আর জায়গা ছিল না, ব্যাপার অনেকটা গোপাল ভাঁড়ের মতোই। পেটে যদি ওষুধের জন্য আর একটু জায়গা থাকত, তবে আরেক মুঠো ডাল-ভাতই খেয়ে নিতাম। তাই খেজুর গুড়ের মহিষের দই বা কফি দই চেখে দেখা হয়নি। তবে মেইন কোর্সের অনবদ্য পারফরম্যান্সের পর তা নিয়ে কোনো সন্দেহ পুষে না রাখাই শ্রেয়। খাওয়া শেষে বিপ্লব শুধোলেন, কোনো সাজেশন? শুধু বলতে পেরেছিলাম- গ্রামের এই স্বাদ অটুট রাখুন, অবিকৃত রাখুন, তবেই চলবে।
ঠিকানা: মাটির ঘর, ঢাকা সিটি বাইপাস, ১৭২০ পানজোরা। (৩০০ ফুট কাঞ্চন ব্রিজ থেকে হাতের বামে ৭ কিলোমিটার)।
ফোন: ০১৭১৬৮৮৩১২০।
ছবি: লেখক