ফিচার I উপোসে উপশম
রূপরুটিনে সাময়িক বিরতি। প্রসাধন বা সৌন্দর্যসামগ্রীর প্রয়োগ বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে। ময়শ্চারাইজেশন থেকে মেকআপ- সংযম চাই সবেতেই
কিছুদিন ধরে তেলমসলাযুক্ত ভারী খাবার খেলে তার পরে হালকা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ত্বকেও তাই। দিনের পর দিন মেকআপের ভারে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ত্বক, তখন তাকেও কিছুদিনের জন্য রেহাই দেওয়া প্রয়োজন। যাকে বলা হচ্ছে স্কিন ফাস্টিং। জাপানিজ স্কিন কেয়ার কোম্পানি ‘মিরাই ক্লিনিক্যাল’-এর মাধ্যমে গেল বছর জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই বিউটি ট্রেন্ড। বছর ঘুরে এবারও এ নিয়ে চর্চা চলছে। মূলত ফাস্টিং বা সংযমের সনাতন ধারা থেকে অনুপ্রাণিত এটি। শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে সংযম। ঠিক একই পদ্ধতিতে কাজ করে স্কিন ফাস্টিং। ত্বকের স্বাভাবিক নিরাময় ক্ষমতা উসকে দেয়। সনাতন সংযমে যেমন আহার থেকে বিরত থাকা হয়, ঠিক তেমনি ত্বকের যত্নে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের সৌন্দর্যপণ্য আর সাজ-উপকরণের প্রয়োগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্বক প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা, পুষ্টি আর যত্নের জন্য সৌন্দর্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে এর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে যায়। সেটা সচল রাখতেই দরকার স্কিন ফাস্টিং। জাপানিজদের দাবি, এই পদ্ধতি চেহারার স্বাভাবিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। ত্বক তার প্রাকৃতিক তেল থেকেই আর্দ্রতার অভাব সারাতে সক্ষম হয়ে ওঠে। ত্বকের ডিটক্সিফিকেশন অর্থাৎ দূষণ দূর করার সহায়কও এটি। ফলে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখায় স্কিন। তবে ডার্মাটোলজিস্টদের মধ্যে ভিন্নমত আছে এই ট্রেন্ড নিয়ে। এক দল বলছেন, শতভাগ বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ নেই এর কার্যকারিতার। তাই হুট করে স্কিন কেয়ার পণ্যের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া ঠিক নয়। হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ত্বকের প্রয়োজন বুঝে কাস্টমাইজড স্কিন কেয়ার রুটিন মেনে চলতে হয়। দরকার বুঝে পণ্য ব্যবহার এবং বিরতি দিতে হবে। অন্য দলের অভিমত আবার ভিন্ন। তারা বলছেন, স্কিন ফাস্টিং ট্রেন্ডের ফলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় আসছে। কয়েক বছরে সৌন্দর্যচর্চার ধাপ এবং পণ্য নিয়ে যে বাড়াবাড়ি চলছিল, সে সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেছেন সৌন্দর্যসচেতনেরা। তারা বলছেন, যত বেশি সাদাসিধে ও সহজ হবে বিউটি রুটিন, তত সুফল মিলবে। আর সেটাতেই সাহায্য করে ‘স্কিন ফাস্টিং’। যদি সৌন্দর্যচর্চার কোনো ধাপ কিংবা পণ্য ত্বকের জন্য সুবিধাজনক মনে না হয়, তা বাদ দেওয়ার সুযোগ করে দেয় এ পদ্ধতি। এ ছাড়া বাড়তি পণ্য ব্যবহারে বিরতি দেওয়া হয় বলে অ্যাকনে, অ্যাকজিমা, প্রদাহ ও চুলকানি তুলনামূলকভাবে দ্রুত সারে। ওভার ক্লিনজিং আর পিলিংয়ে ত্বকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায় অনেকখানি। বিশেষজ্ঞদের মত, সপ্তাহে দুদিন যদি হালকা মেকআপ করা যায় কিংবা মেকআপ ছাড়া থাকা যায়, ত্বক আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। কারণ, রোজ ভারী মেকআপ করলে ত্বকের কোলাজেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়, দ্রুত বয়সের ছাপ পড়ে। মেকআপে থাকা রাসায়নিক লোমকূপ বন্ধ করে দেয় অনেক সময়। অ্যালার্জিও সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সপ্তাহে দুদিন কম মেকআপ করলে ত্বক নতুন কোষ সৃষ্টির সুযোগ পায়।
কীভাবে করা হয় স্কিন ফাস্টিং? শুরুতে সপ্তাহে এক বা দুই দিনই যথেষ্ট। ত্বকের প্রতিক্রিয়া বুঝে পরে সময় বাড়ানো বা কমানো যেতে পারে। প্রথমে সুবিধাজনক একটা দিন বেছে নেওয়া দরকার। সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিনটাই সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কারণ, ফাস্টিংয়ের ফলে ত্বকে কোনো সমস্যা দেখা দিলে পরের দিন তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ মেলে। এ সময় ত্বক কোনো ধরনের প্রসাধনীতে আবৃত থাকবে না। সে জন্য বালিশের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। ফাস্টিংয়ের দিন এগুলো পরিষ্কার রাখা দরকার। কারণ, অপরিচ্ছন্ন বা ব্যবহৃত কাভারে পুরোনো তেল, ময়লা, ব্যাকটেরিয়া জমে থাকে, এগুলো ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। ঘরের তাপমাত্রা খুব কম বা বেশি যেন না হয়। সম্ভব হলে জানালা খুলে প্রাকৃতিক হাওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। যথেষ্ট পানি পান করা চাই ফাস্টিংয়ের পুরো দিন। এতে শরীর আর ত্বক ভেতর থেকে আর্দ্র থাকবে। কফি কিংবা মিষ্টিপানীয় খাওয়া যাবে না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ক্লিনজার দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করতে হবে। কিন্তু স্কিন ফাস্টিংয়ের নিয়ম হচ্ছে এমন ক্লিনজারের ব্যবহার, যা ত্বকের প্রাকৃতিক তেলের কোনো ক্ষতি করবে না। হবে না রুক্ষ, শুষ্ক। বেনজয়েল পার-অক্সাইড, অ্যালকোহল আর সুগন্ধিমুক্ত হতে হবে। কোমল ফোমিং ফেসওয়াশ অথবা মাইসেলার ওয়াটারও ব্যবহৃত হতে পারে। পরিষ্কার হাতে আলতো চাপড়ে চাপড়ে ম্যাসাজ করতে হবে ত্বক। ব্যস! শেষ রাতের রূপচর্চা। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে শুধু পানিতে মুখ ধুয়ে নিতে হয়। কোনো ধরনের ক্লিনজার ব্যবহার করা যাবে না। তবে খুব প্রয়োজন হলে সামান্য ময়শ্চারাইজার অথবা সেরাম মেখে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই লেয়ারে লেয়ারে প্রডাক্ট মাখা যাবে না।
মেকআপ করা থেকে বিরত থাকলেও ত্বক পরিষ্কার রাখা এবং সূর্যরশ্মি থেকে বাঁচানো সব সময়ই জরুরি। সানস্ক্রিন এ ক্ষেত্রে জুতসই। পানি দিয়ে বারবার মুখ ধুতে হবে। এ সময় ডিটক্সিফিকেশনের জন্য ক্লে মাস্ক ব্যবহার করা যায়। ময়শ্চারাইজারও চলতে পারে। যদিও ডিটক্সিফিকেশনের পর ত্বকে দাগছোপ দেখা দিতে পারে, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। তবে ত্বকে উপকারের চেয়ে ক্ষতির মাত্রাটা বেশি হলে স্কিন ফাস্টিং এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
জাহেরা শিরীন
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন